এবিএম সালেহ উদ্দীন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র:
মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্বহীন মানুষ অনেকটা মেরুদণ্ডহীন। জ্ঞানান্বেষণ এবং জ্ঞানীলোকের সংস্পর্শ ছাড়া ব্যক্তিত্ব অর্জন করা কঠিন। মানুষের ব্যক্তিত্ব তখনই অর্থবহ হয়, যখন সে স্বাধীন ও দ্বিধাহীনভাবে তার মনন ও সৃষ্টিশীলতার পরিস্ফুটন ঘটাতে পারেন। জ্ঞানার্জনের জন্য পড়াশোনা ও অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। আর মেধা ও মননের সঠিক পথ পেতে হলে জ্ঞানী ও মননশীল মানুষের সান্নিধ্যে জ্ঞানার্জনের পথ সুগম হয়। সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের ছায়াপথে যে তৃপ্তি ও আনন্দ আনে, তার সঠিক অনুসন্ধান করতে পারলে শিল্প-সাহিত্যের পথ সুগম হতে পারে। শিল্প ও সংস্কৃতিতে যে প্রেম, দ্রোহ ও মানবিকতার ছোঁয়া রয়েছে, তার স্বাদও নিতে হয়। মনের ঐকান্তিক নিবিষ্টতায় সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্য রচনার জন্য সাহিত্য সভা এবং সৃজনধর্মী যোগসাজশ ঘটিয়ে নিজের জন্য একটি মননশীল উজ্জ্বলতর পথ সুগম ও পরিশীলিত হতে পারে। কবিতা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বের ওপর নিজের স্তম্ভকে সোজা রাখার প্রথম সিঁড়ি হিসেবে পাঠাভ্যাস ও বইপড়ার প্রতি আত্মনিয়োগ এবং তার অনুশীলনে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। একজন সাহিত্যিক তার মেধা ও মননের পরিস্ফুটনের জন্য যে সৃজন-পদ্ধতি গ্রহণ করেন, সেটাই নানা ভঙ্গিতে সামগ্রিক বিষয়াবৃত্তির চৌকাঠে শৈল্পিক সৃষ্টিনন্দন অবয়বে তার প্রকাশ ঘটান। এই প্রকাশভঙ্গি প্রত্যেকের এক নাও হতে পারে। প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতায় দোষের কিছু নেই। যথার্থ ও যথাযথভাবে তার প্রতিফলনটাই মুখ্য।
সাহিত্যের শাখা-প্রশাখায় অনেক সৌন্দর্য আছে। সাহিত্যের বিত্তবৈভবের মধ্যে যে আনন্দ আছে, সেটি প্রকাশের একটি বড় মাধ্যম হলো সাহিত্যের আসর এবং শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠান। একজন সাহিত্যিক তার সৃষ্টিকে পাঠকের কাছে এবং জনসম্মুখে প্রকাশ করতে পারলে বেশি আনন্দ পায়। তেমনি দর্শক-শ্রোতা, পাঠকও পেয়ে যেতে পারেন চাহিদা মোতাবেক তাদের মনের খোরাক। এতে কবি ও সাহিত্যিক উভয়েই আনন্দিত হন। পুলকিত হন।
সাহিত্যের সকল ক্রিয়াশৈলীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি হচ্ছে কবিতা। কবিতা সুন্দরের প্রতীক। কবিতার ভাষা ও ছন্দের বন্ধনে কবিকে এমন এক কৌশল অবলম্বন করতে হয়, যার অনুপম ক্যারিশমায় পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। পাঠককে কবিতার কাছে টানে। হৃদয়ের একান্ত অনুভব ও অনুভূতির অনুপম ছন্দময় শব্দাবলির সমন্বয়েই মূলত কবিতার বহিঃপ্রকাশ। কবিতার ভাষাকে নানান রং ও বৈচিত্র্যের বর্ণবিভায় সাজিয়ে প্রকাশ করার জন্য কবিকে আত্মমগ্ন ও যত্নবান থাকতে হয়। একজন কবির এটি একটি ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য।
কবিকে সর্বদা আমি একজন আলোকিত মানুষ মনে করি। একজন সত্যিকার মননশীল কবিকে যখন সকল হীনম্মন্যতা ও কৌলিন্যের ঊর্ধ্বে সত্যিকার মানুষরূপে পেয়ে যাই, তখন আনন্দের সীমা থাকে না। এই শিক্ষাটি প্রথম পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। তিনি বলতেন, প্রকৃত মানুষ তিনি, যিনি মানুষ ও প্রাণিজগৎ এবং প্রকৃতির কল্যাণে নিবেদিত থাকেন।’
প্রজাপতি যখন মধুপানের আশায় ফুলে বসে, তখন অজান্তেই তার পায়ে লেগে যায় মায়াবী পরাগ। ফুল থেকে ফুলে বসার মধ্য দিয়ে মায়াবী পরাগের মিলনের মতোই একজন কবি আরেকজন কবির সাথে মিশে যেতে হয়। যেকোনো হীন স্বার্থের ঊর্ধ্বে একজন প্রকৃত কবি সব সময়ই তার কবিতায় অসম্ভব বীজগুলোকে সবার জন্য উজাড় করে দেন। এভাবেই একটি ভালো কবিতা মানুষের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা ও মমত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে পারে। এই মতের বাইরে চিন্তা করার আর কোনো পথ আমি চিনে উঠতে পারিনি। অন্য কেউ এতে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার দেখার মাঝে কোনো আড়ষ্টতা কিংবা গোঁজামিলের সুযোগ নেই।

নিউইয়র্ক পৃথিবীর একটি সর্বোন্নত শহর। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিবাসীদের মতো বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য অভিবাসী এখানে রয়েছেন। এখানে গড়ে উঠেছে সর্ববৃহৎ বাঙালি সমাজ। সেই সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য ও বাংলা সংস্কৃতির একটা বিশাল ভুবন তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে সাহিত্যজগৎ-সংক্রান্ত ভূমিকা ও অবস্থানের বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্যই মূলত এই বিশ্লেষণ।
মানুষ মাত্রই সমাজবদ্ধ জীবন। মানুষের সান্নিধ্য ও সাহচর্য ব্যতীত জীবন অর্থহীন। মানুষের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতাবোধ ও একাকিত্ব আমাদের হৃদয়বৃত্তির জন্য ক্ষতিকর। নিঃসঙ্গতা মানুষের এক ধরনের কঠিন ব্যাধি। এটি খুব পীড়াদায়ক। আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বোধের উন্নয়ন ও উৎকর্ষের জন্য তাই আমরা সমাজবদ্ধ কোলাহলের মধ্যে থাকতে পছন্দ করি। এই কোলাহল যেকোনো ধরনের হতে পারে। তবে আমাদের লক্ষ্য সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সাহিত্য তা-ই, যা জগতের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক ও সংযোগ ঘটায়।’ আর গ্যাটে বলেছেন, ‘কবিতা মানুষের চিরায়ত সম্পদ। শতাব্দীর পর শতাব্দী সর্বত্র সবখানে মানুষের হৃদয়ে তাকে স্থাপন করা প্রেরণা জোগায়।’ অতএব, কবিতা কিংবা সাহিত্যের যেকোনো শাখায় সর্বোতভাবে হৃদয়ঙ্গম করার জন্যই আমাদের সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।
গল্প, উপন্যাস ছোট পরিসরের লেখা। আবার গল্প, উপন্যাসের চেয়ে ছোট অথচ অর্থবোধক লেখাও বিশ্লেষণধর্মী হয় এবং পাঠকের হৃদয় কাড়ে। একজন লেখক তার গল্পের মাঝে পরিকল্পিত যেকোনো বিষয় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন আর উপন্যাসে বৃহৎ পরিসরে বহুমুখী প্রসঙ্গ ফুটিয়ে তোলেন। এছাড়া প্রবন্ধ-নিবন্ধও সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ শাখা। কোনোটাই ফেলনা নয়। গল্প-নাটক সবই শব্দশক্তির সাহিত্যসম্ভার।
আমার এই প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে কবি, কবিতা এবং সাহিত্য একাডেমি। সাহিত্য একাডেমি নিয়ে আলোকপাত করতে গেলে অনেক স্মৃতি হৃদয়ে বাজতে থাকে। অনুরণিত হতে থাকে অতীতের ১২ বছরের স্মৃতি। অর্থাৎ সুনিয়ন্ত্রিত ও নিয়মিত সাহিত্য আসরের এক যুগ, যার পল অনুপলজুড়ে রয়েছে অসংখ্য স্মৃতি। স্মৃতি আর স্মৃতির পরশে কতজন ও মনের সাথে আমাদের মিশে যাওয়া। কতজনকে টেনে আনা ও তাদের সান্নিধ্য লাভ করা। সাহিত্য একাডেমির অনুষ্ঠানকে শীলিত ও মার্জিত মননধর্মী করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করা।
মনে পড়ে, নভেম্বরের (২০১০) সেই এক শুক্রবারে একেবারে হাতে গোনা কয়েকজন কবি ও কবিতাপ্রেমীর মিলিত প্রয়াসে সাহিত্য একাডেমির যাত্রা শুরু হয়েছিল। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের উপকণ্ঠে ‘ইস্ট ওয়েস্ট কোচিং সেন্টার’ এর কর্ণধার মোশারেফ হোসেন এবং সেই সঙ্গে প্রতিটি আসরে নিরলসভাবে লেগে থাকলেন নিরলস উদ্যমশীল কয়েকজন মানুষ। প্রথম আসরে যুক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাহিত্য আসর চলমান। ক্ষুদ্রকায় হলেও সাহিত্য একাডেমির শুরুটার মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল, তা এখনো আছে বলে আমার বিশ্বাস। সবার আন্তরিকতার ফলেই নিয়মতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সাফল্যে সাহিত্য একাডেমি এখন বহুল আলোচিত। কোনো বন্যা-বাদল, ঝড়-বৃষ্টি ও তুষারপাতের মধ্যেও সাহিত্য একাডেমি আসর অনুষ্ঠানের ব্যত্যয় ঘটেনি। এই নিয়মতান্ত্রিকতার ফলেই নিউইয়র্কের সাহিত্যাঙ্গণে সাহিত্য একাডেমির ব্যাপক পরিচিতি ও প্রশংসা কুড়িয়েছে। যেকোনো লক্ষ্যে পৌঁছানো এবং উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিষ্ঠাবোধ এবং আন্তরিকতা থাকলে কোনো শ্রমই বিফলে যায় না। সাহিত্য একাডেমি অনায়াস কর্মতৎপরতাই তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যেখানে কবি ও কবিতার সমন্বিত প্রয়াস ও বুদ্ধিদীপ্ত মননের সম্মিলন। কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, কলাকুশলী, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিসেবীসহ সকল অংশগ্রহণকারীর আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও অপরিমেয় সম্ভাবনার অনন্ত সমাহার। প্রবীণ ও নবীনের মেলবন্ধন।
বিগত দিনগুলোতে সাহিত্য আসর ও এতদসংক্রান্ত কার্যসূচিতে পারিপার্শ্বিক কানাঘুষা, আলোচনা-সমালোচনা ও সকল বৈপরীত্য উতরে বর্তমানে সাহিত্য একাডেমি একটি চমৎকার অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এখন তার পরিসরও বেশ বড়। সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত দেওয়ার মতো সাহিত্য একাডেমির বেশ কিছু সাফল্য আছে। বড় বড় আলোচনা সভা এবং সেমিনারসহ নিউইয়র্ক শহরের বাইরে সুদূর আলবেনিতেও সাহিত্য একাডেমির উদ্যোগে চমৎকার অনুষ্ঠান হয়েছে। সেসব উল্লেখ করলে লেখার কলেবর বেড়ে যাবে। তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সাহিত্য একাডেমির এসব সাফল্যের ক্ষেত্রে আয়োজকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দায়িত্ববোধ এবং এখানে যারা অংশগ্রহণ করেন, তাদের সবারই নিষ্ঠাবোধের ফসল। বিশেষ করে, প্রতিটি অনুষ্ঠানকে সর্বোতভাবে সফল করে তুলতে কয়েকজন সম্মানিত সাহিত্যকর্মীর নিরলস পরিশ্রম ও কর্মতৎপরতা অতুলনীয়। তাদের নিষ্ঠাবোধ ও অবদানে আগামী দিনগুলোতেও সাহিত্য একাডেমির মর্যাদা ও গৌরবকে অক্ষুন্ন রাখবে বলে আমার একান্ত প্রত্যাশা।
বিগত দুই বছরে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপে পৃথিবী স্থবির ও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সবকিছু থেমে গিয়েছিল। পৃথিবীর মানুষের করুণ মৃত্যুতে সদা জাগ্রত নিউইয়র্ক শহরেও বয়ে গেছে মৃত্যুর মিছিল! চতুর্দিকে স্বজনহারার আর্তনাদ, বেদনাঝরা শোক, আশঙ্কা, উৎকণ্ঠায় সমগ্র পৃথিবী নিশ্চল, নিস্তব্ধ। পৃথিবীর দুঃসহ যন্ত্রণার অবসানকল্পে এবং সবার সুস্থতা ও সুখময় জীবনের প্রত্যাশায় একাকিত্বের নিঃসীম নির্জনে আমার একান্ত প্রার্থনা। সর্বপ্রকার জীর্ণতা ও স্থবিরতা কাটিয়ে পৃথিবী আবার জেগে উঠুক। সাহিত্য একাডেমিও হয়ে উঠুক প্রাণবন্ত। সাহিত্য একাডেমির যুগপূর্তিতে সবাইকে অফুরন্ত শুভেচ্ছা।