মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত, রিয়াদ, সৌদিআরব:
পরিবারে অর্থনৈতিক সচ্চলতা নিয়ে আসা কিংবা একটু স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে প্রতিবছর বিদেশে পা বাড়ায় লক্ষ বাংলাদেশি। উদয়াস্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করে অর্থনীতির ভিত মজবুত করে চলেছেন বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকরা। এসব অভিবাসী শ্রমিকদের বিশাল অংশের গন্তব্য মূলত মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, জর্ডান, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া সহ কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবে। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ২৫ লক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছে। কিন্তু সৌদি আরবের পরিবর্তিত অভিবাসন আইন ও করোনাত্তোর বৈশ্বিক মন্দা সহ নানান কারণে হাজার হাজার প্রবাসী চাকরি হারা হয়েছেন এবং হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
অর্থনৈতিক মন্দা ও কর্মস্থলে ‘সৌদিকরণ’ এবং অভিবাসীদের জন্য নতুন নিয়মের কারণে বর্তমানে সৌদি আরবে প্রবাসী শ্রমিকরা নানান জটিলতায় দিনাতিপাত করছেন। ভিসায় উল্লেখিত পেশা ব্যতীত অন্য পেশায় কাজ করার সুযোগ বর্তমানে নেই বললেই চলে। কাজের ক্ষেত্রে প্রবাসীদের জন্য সৌদি আরব আগের মতো আর উন্মুক্ত নয়। কর্মক্ষেত্রে এখন শ্রেণি নির্ধারণ করে দেয়ায় বিপাকে পড়েছে প্রবাসীরা। এই দেশের নাগরিকরা এখন যথেষ্ট শিক্ষিত এবং বিভিন্ন পেশায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তাই বিভিন্ন পেশায় তারা কাজ করছে এবং যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছে। বিশেষ করে নারীরা অনেক এগিয়ে গেছে এই ক’বছরের মধ্যেই। প্রায় সব পেশায় তারা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তাই স্বভাবতই প্রবাসী শ্রমিকদের প্রয়োজনীয়তা কমে আসছে দিন দিন এবং এই অবস্থা ধারাবাহিক চলতে থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা সৌদি সরকারের সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে যোগ্যতানুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া এবং নারীর ক্ষমতায়নে দারুণভাবে সফল হয়েছে বলা যায়। প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য এ দেশের শ্রমবাজার দিন দিন সংকুচিত হতে চলেছে। শত শত প্রবাসী শ্রমিক প্রতিনিয়ত বেকার হচ্ছে অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত শ্রমিক আসছে নতুন ভিসায়। শুধুমাত্র ২০২১ সালের ডিসেম্বরেই প্রায় ৮৭ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরব এসেছে। আসার আগে তারা চিন্তা করছে না এখানে এসে কী করবে? চুক্তিপত্রে যে কাজের কথা বা পারিশ্রমিকের কথা উল্লেখ রয়েছে তা কতটুকু বাস্তবসম্মত এবং সত্যিকার অর্থেই তা ঠিক আছে কিনা, তা বিবেচনা না করেই তারা চলে আসছে সৌদি আরব। ভাবটা এমন যেন, কোন প্রকারে সৌদি আরবে প্রবেশ করতে পারলেই সোনার হরিণের দেখা মিলবে। অথচ প্রবাসের মাটিতে আসলেই শুরু হয় জীবনের নতুন এক অধ্যায়। নতুন পরিবেশে নতুন করে বাঁচতে গিয়ে ধূলায় মিশে যায় হাজারো প্রবাসীর বুকভরা স্বপ্ন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চুক্তিপত্রের চুক্তি মানা হয় না। কারণ ভিসা ব্যবসায়ীরা প্রকৃত নিয়োগদাতার সাথে অলিখিত চুক্তি করে ভিসা কিনে দেশে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তা বিক্রি করে নানান লোভনীয় সুযোগ সুবিদার কথা বলে। যে সমস্ত বাংলাদেশিরা প্রকৃত অর্থে সৌদি আরবের কোন কোম্পানিতে বা প্রতিষ্ঠানে বা কারো বাসা-বাড়িতে কাজ করতে আসছে, তাদের ক্ষেত্রে হয়তো ভিসার চুক্তিরপত্র অনুসরণ করা হয় বা মানা হয়। কিন্তু যারা নির্দিষ্ট কোন কাজের চুক্তি না করে আসছে বা ফ্রি ভিসার নাম দিয়ে আসছে তাদের অবস্থা বর্তমানে খুবই করুণ। সৌদি আরবের নতুন আইনানুযায়ী নতুন অভিবাসীদের ৩ মাস অথবা ৬ মাসের রেসিডেন্ট পারমিট (ইকামা) দিচ্ছে। এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি কোন প্রবাসী কাজের সন্ধান করে অন্য কোন কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠানের নামে নিজের ভিসা ট্রান্সফার করতে না পারে তাহলে পরবর্তী রেসিডেন্ট পারমিট নবায়ন করার জন্য গুনতে হয় বড় অংকের ফি, যা দেশ থেকে আসা নতুন শ্রমিকদের পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়। ফলে অবৈধ হয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোন গত্যন্তর থাকে না। দেশ থেকে বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে এসে তিন বা ছয়মাসের মধ্যে হয়ে যায় অবৈধ অভিবাসী। শুরু হয় প্রবাসের মাটিতে অন্যরকম এক জীবন। একদিকে পরিবারের চিন্তা অন্যদিকে অবৈধ অভিবাসী হয়ে বাস করা, যে কোন মুহূর্তে প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে জেল-জরিমানার পরোয়ানা মাথায় নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। ঐ দিকে দেশে পরিবার পরিজন আশায় দিন গুণে, পরিবারের সদস্য সৌদি আরব গেছে কিছুদিনের মধ্যে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে আর অভাব অনটনের দিন শেষ হয়ে যাবে। অথচ একটিবারও ভাবে না তাদের প্রিয় মানুষটি প্রবাসের মাটিতে কেমন আছে, কেমন কাটছে তার নতুন জীবনসংগ্রাম।
ভিন দেশে, ভিন্ন পরিবেশে অজানা ভাষা সংস্কৃতির মধ্যে অভিবাসী হয়ে আসা মানুষটির টিকে থাকার সংগ্রাম কত কঠোর আর প্রতিকূলতায় ভরা তা পরিবার-পরিজন কখনো জানতে চায় না। তারা মনে করে যে, তাদের প্রিয় মানুষটি প্রবাসে গিয়েই তাদের জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা পাঠাবে। তাদের এই ভাবনা একেবারে অমূলকও নয়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। এখানে এসে যদি উপযুক্ত কর্মসংস্থান খুঁজেও পায় তারপরও কিছু হিসেব সবাইকে মাথায় রাখা আবশ্যক যা সৌদি আরবে আসার আগে কেউ ভাবেনা। যেমন, নির্দিষ্ট কাজ নিয়ে আসছে কিনা, কাজের চুক্তিপত্র, শ্রমঘন্টা, পারিশ্রমিক, ওয়ার্ক পারমিট খরচ, স্বাস্থ্যবীমা, বাসস্থান, চুক্তি শেষে দেশে যাওয়ার খরচ ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া খুবই জরুরি। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিপূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পর ধারণা নিতে হবে সৌদি আরবে একজন প্রবাসী বাংলাদেশির মাসিক নূন্যতম কত টাকা খরচ হয়। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূণ কেননা ভিসা ব্যবসায়ীরা মাসিক আয়ের কথা বললেও ব্যয়ের কথা কখনো বলে না। আর দেশে থাকা সাধারণ মানুষও বিষয়টি নিয়ে ভাবেনা, তারা যখন শুনে বা চুক্তিপত্রে দেখে তাদের মাসিক বেতন বাংলাদশি টাকায় ৩০/৪০ হাজার টাকা তখন মনে করে আকাশের চাঁদ হাতছানি দিচ্ছে। অথচ গুণাক্ষরেও চিন্তা করে না মাসিক এই বেতনের বিপরীতে কত টাকা খরচ হতে পারে সৌদি আরবে প্রবাসী একজন শ্রমিকের। সামান্য একটু আলোকপাত করলে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ধরুন, একজন সাধারণ শ্রমিক যার বেতন ১২ শত সৌদি রিয়াল বা প্রায় ২৮ হাজার টাকা এবং বাসস্থান নিয়োগকর্তার বা কোম্পানীর। তার খরচের হিসেবে দেখে নিই এবার। দৈনিক দু’বেলা খাবার খরচ মাসিক নূন্যতম ৪শ রিয়াল, সকালের নাস্তা বাবদ মাসিক খরচ নূন্যতম ১শ রিয়াল, মোবাইল খরচ নূন্যতম ১শ রিয়াল মোট ৬শ রিয়াল (এটি একেবারেই সর্বনি¤œ খরচ তাও যদি উপরে উল্লেখিত অন্যান্য সব খরচ নিয়োগকর্তা, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী বহন করে) বাকি থাকে ৬শ রিয়াল যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪ হাজার টাকার মতো। আর যদি কারো চা-সিগারেটের অভ্যেস বা ঔষধ খেতে হয় অথবা মাঝে মধ্যে কোথাও বেড়াতে যায়, কোন পরিধেয় বস্ত্র খরিদ করে তাহলে তো বুঝতেই পারছেন খরচের হিসেবটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এতো গেল যারা কোন কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠানে এনগেইজড হয়ে কাজ করছে তাদের কথা। আর যারা তথাকথিত ফ্রি ভিসায় কাজ করছে বা করার কথা ভেবে সৌদি আরবে আসছে বা আসার কথা ভাবছে তাদের কথা বলা বাহুল্য। তাদের ক্ষেত্রে মাসিক এই নূন্যতম খরচের সাথে যুক্ত হয় প্রতিমাসে ওয়ার্ক পারমিট ফি, ওয়ার্ক পারমিট (ইকামা) নবায়ন ফি, স্বাস্থ্যবীমা এবং অফিস খরচ। যা বর্তমানে বছরে নূন্যতম ১২ হাজার থেকে শুরু করে ১৬ হাজার রিয়াল বা ক্ষেত্র ভেদে আরো বেশি। এর পরে আছে দেশে যাওয়া-আসার টিকেট খরচ। এবার হিসেব করুন কত কামাবেন আর কত জমা করবেন বা পরিবার-পরিজনের জন্য কী পাঠাবেন। এক্ষেত্রে যারা হাউজ ড্রাইভার বা গৃহ পরিচারিকা রয়েছে তাদের হিসেব ভিন্ন।
এখন সৌদি আরবে যারা আসছেন বা আসতে চাচ্ছেন তারা চিন্তা করে দেখুন, গভীরভাবে ভাবুন তারপর সিদ্ধান্ত নিন। এখানে এখন কাজ আছে নির্মাণ শ্রমিক, পরিচ্ছন্ন কর্মী, হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, সেলুন, হাউজ ড্রাইভার, গৃহ পরিচারক/পরিচারিকা অথবা এই জাতীয় পেশার কাজ। যারা এসব পেশায় কাজ করতে পারবেন না বা করতে আগ্রহী না তারা এখন সৌদি আরবে না আসাই উত্তম। বিগত দু-এক বছরে যত বাংলাদেশি সৌদি আরব এসেছে দেখা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই বয়সে একেবারেই তরুণ এবং শারীরিকভাবে ভারী কাজ করার তেমন উপযুক্ত নয় বা সেই মানসিকতা নেই। তাই তাদেরকে যখন কোন ভারী কাজ দেয়া হয় তখন তারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আবার বেশিরভাগ নতুন প্রবাসী আসছে ভিসা ব্যবসায়ীদের হাত ধরে অথবা কোন আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত জনের মাধ্যমে এই আশা নিয়ে আসে যে, চুক্তিতে কাজের কথা যা-ই উল্লেখ থাকুক তারা সৌদি আরব এসে সুবিধা মতো কাজ খুঁজে নিয়ে ভিসা বা স্পন্সরশিপ পরিবর্তন করে নেবে। কিন্তু বর্তমানে বিষয়টি খুবই জটিল কারণ অভিবাসীদের জন্য নতুন নিয়ম এবং চাকরি সংকট। তাই যথা সময়ে কাজ জোগাড় করতে না পারা, নির্দিষ্ট সময়ে ওয়ার্ক পারমিট (ইকামা) নবায়ণ করতে না পারার কারণে শত শত বাংলাদেশি শ্রমিক অবৈধ হচ্ছে এবং প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে দেশে ফিরে যেতে হচ্ছে। সৌদি আরব সরকার বাংলাদেশের প্রতি অতিশয় সহানুভুতিশীল বিদায় প্রতিবছর প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমিক এই দেশে আসছে কিন্তু তাই বলে আমরা যদি এই দেশের বিধি-বিধানের প্রতি তোয়াক্কা না করে ধার-কর্জ নিয়ে সৌদি আরবে এসে বেকার বা অবৈধ হয়ে বসে থাকি তাহলে তো হবে না।
সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সৌদি আরবস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, জনশক্তি রপ্তানির সাথে জড়িত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সহ সকলের উচিত বিষয়গুলির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং যারা নতুন অভিবাসী হয়ে আসতে ইচ্ছুক তাদেরও উচিত হবে সবকিছু জেনে শুনে পা বাড়ানো। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে, ‘যেন-তেন ভাবে সৌদি আরব যেতে পারলেই হবে’ এই ধরণের চিন্তাধারা থেকে দূরে সরে এসে দক্ষ শ্রমিক হয়ে উপযুক্ত কাজ নিয়ে যদি সৌদি আরব আসা যায় তাহলে ব্যক্তি, পরিবার ও দেশ উপকৃত হবে এবং অবৈধ প্রবাসীর তকমা নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন শেষে রিক্ত হস্তে দেশে ফিরতে হবে না।