এবিএম সালেহ উদ্দীন: মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) সাংবাদিকতার জনক, অকুতভয়ী সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম সাহিত্যিক, গবেষক এবং দার্শনিক ও সুপণ্ডিত। উপমহাদেশের বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা।
তিনি ছিলেন প্রবল মেধাবী আধুনিক মননশীল একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। মানবতাবোধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলমযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নদ্রষ্টা ও ভারতবর্ষের খ্যাতিমান সাংবাদিক। মওলানা আকরম খাঁ ১৮৬৮ সালের ৭ই জুন ভারতের চব্বিশ পরগনা (ব্রিটিশ প্রেসিডেন্সি) জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলহাজ্ব গাজী মাওলানা আব্দুল বারী খাঁ ছিলেন একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। মাতা বেগম রাবেয়া খাতুনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব কম থাকলেও তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ের সম্ভ্রান্ত ঘরের বুদ্ধিমতি নারী। পূর্ব পুরুষ ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ। কয়েক পুরুষ পূর্বে তার পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ।
কৈশোরকালেই তিনি তার পিতা ও মাতাকে হারান। এ রকম এক শোকাবহ অবস্থায় তিনি তার নানীর গৃহে নানীর আদরে প্রতিপালিত হন। অকালে প্রাণপ্রিয় মাতা-পিতাকে হারানোর সীমাহীন বেদনাবোধ এবং এতদসংক্রান্ত কষ্টের মধ্যেও তিনি ছিলেন খুব ধৈর্যশীল ও সংযমী। ছোটবেলা থেকেই বিস্ময়কর মেধা ও মননের পরিচয় দিতে দিতে তিনি বড় হতে থাকেন ।
ভাষা ও সংস্কৃতির উপর কঠোর অধ্যাবসায় সদামগ্ন আকরম খাঁ ১৮৯৬ সালে ইসলামী দর্শনে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। অল্প বয়সেই তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। ব্যক্তিজীবনে নীতিবান, আত্মসংগ্রামী, কঠোর পরিশ্রম করেও তিনি ছিলেন একজন আত্মপ্রত্যয়ী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দৃঢ়চেতা মানুষ। ভারতবর্ষের অবহেলিত মেধাবী তরুণদেরকে সাংবাদিক হিসেবে তৈরি করার মধ্য দিয়ে নবদিগন্তের সূচনা করেছিলেন মওলানা আকরম খাঁ। তিনি ছিলেন মেধাবী ধীরস্থির, ধৈর্যশীল, ধর্মপ্রাণ নিয়মনিষ্ঠ সুশৃঙ্খল ভাষাবিদ, সত্যানুসন্ধানী এবং সাংবাদিকতার কারিগড় ও মুক্তবিহারী। মানবতাবাদ ছিল জীবনের অন্যতম আদর্শ। দীর্ঘ ১০০ বছরের পুরো জীবনই ছিল অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ ও সাফল্যে ভরপুর।
ব্যক্তি জীবনে নানারকম প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি বিনোদন ও নিয়মিত খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী ক্রিড়াসংস্থা ‘মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের’ অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। কলকাতার ছাত্রজীবনে গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকতায় তার সাহসী ভূমিকা ছিল বিস্ময়কর। ১৯০৩ সালে তার সম্পাদনায় কলকাতা থেকে মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯০৮ সালে পত্রিকাটিকে সাপ্তাহিক করা হয়। ১৯১৩ সালে তার উদ্যোগে ‘আমজুমানে ওলামা’ গঠিত হয়। এই সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে ১৯১৫ সালে তিনি ‘আল এসলাম’ নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। নিজের সম্পাদনায় ১৯২০ সালে তিনি প্রকাশ করেন উর্দু দৈনিক ‘জামানা’। ১৯২১ সালে তিনি প্রকাশ করেন দৈনিক ‘সেবক’। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে ‘সেবক’ পত্রিকাটির উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। তাতে আকরম খাঁ দমে যাননি। তিনি তার সম্পাদিত ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকাটিকে দৈনিকে রূপান্তরিত করেন। এ ছাড়া ১৯২৭ সালে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকা হিসেবেও ‘মোহাম্মদী’কে প্রকাশ করতে থাকেন। তখনকার দিনে মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত পত্রিকাগুলো ছিল মুসলমান কবি-সাহিত্যিকের একটা আশ্রয়স্থল। ১৯৩৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন দৈনিক ‘আজাদ’। আজাদ প্রকাশিত হয়েছিল সাহিত্য সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার উন্নয়ন এবং অবহেলিত মুসলমান সমাজের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ‘দৈনিক আজাদ’ যেমন সোচ্চার ছিল, তেমনই পত্রিকাটি সমগ্র ভারতবর্ষের বাঙালি মুসলমানদের মুখপত্র হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
তখন থেকে ‘আজাদ’ কলকাতায় হয়ে উঠে সাংবাদিক সৃষ্টির একটি অন্যতম ইনস্টিটিউট। পরে মোহম্মদ নাসির উদ্দীন সম্পাদিত ‘সাওগাত’ প্রকাশিত হলে, মুসলমান কবি-সাহিত্যিকের আধুনিকতা এবং প্রগতিশীলতার পথ আরও সুগম ও সম্প্রসারিত হয়। এ ছাড়া মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত পত্রিকাগুলো ভারতবর্ষের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের শক্তি জোগায়।
বলা বাহুল্য, অখণ্ড ভারতে ‘আজাদ’ পত্রিকাটিকে আবার কেউ কেউ বাংলা মুসলিম লীগের মুখপত্র বলে আখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কেননা, আকরম খাঁ ছিলেন মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা এবং তিনি ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু আজাদকে রাজনৈতিক দলের মুখপত্র করবেন (!) এই অপপ্রচারে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন।
আবার গান্ধীজি এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টির সঙ্গে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রশ্নে এবং অবহেলিত মানুষের স্বার্থে যেকোনো পার্টির আহ্বানে যোগদান করত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। মুসলিম লীগ ছিল ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল। এই দলে আলেম সমাজের খুব একটা সমাদর ছিল না বলে জনশ্রুতি থাকার পরও বৃহত্তর স্বার্থে মুসলিম লীগের রাজনীতি করেছেন। আলেমদের মন-মানসিকতার সঙ্গে ইংরেজি-বাংলা শিক্ষিত আধুনিকতা-মনস্ক মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্য ছিল।
মুসলিম লীগ বড়লোকের রাজনীতির জায়গা। ফলে পাকিস্তানের পশ্চিমাঘেঁষা ডাকসাইটে নেতাদের সাথে তার আদর্শগত দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এছাড়া মুসলিম লীগ নেতাদের মাঝে ভারত-বাংলাদেশের উলামা শ্রেণির আদর্শগত বিরাট পার্থক্যের কোনো সুরাহা হয়নি বলে মওলানা আকরম খাঁ আস্তে আস্তে মুসলিম লীগের সংশ্রব থেকে দূরে সরে আসেন। মুসলিম লীগের ক্যাপিটালিস্ট ঘরানার নেতাদের তিনি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন।
মুসলিম লীগ এসব করেছিল কংগ্রেসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী মানসিকতা নিয়ে। সেটি তাদের স্লোগান হলেও নিজেদের চালচলন ও দৈনন্দিন আচার-আচরণে ছিল সাধারণ মানুষের নিকট থেকে অনেক দূরে। তাছাড়া ভারতীয় রাজনীতির প্রধান মৌলিক পার্থক্য, যা হিন্দু ও মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্ব মতবাদ ছিল অনেকের কাছে অস্পষ্ট। মূলত তার ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসকের অবসান ঘটে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন পাকিস্তান ও স্বাধীন ভারত।
মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তার মাতৃভাষা বাংলা। বাংলার প্রতি ছিল তার দরদ ও অকুণ্ঠ ভালোবাসা। ইংরেজি, আরবিসহ আরো ছয়টি ভাষায় উপর তার ছিল প্রচুর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য। তার ভেতরে যেমন ছিল প্রবল ধর্মবোধ, তেমনই আধুনিক মননশীলতার দিকে তিনি ছিলেন যথেষ্ট অগ্রসরমান সৃজনশীল মানুষ।
আবার ঢাকার ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ কর্তৃক পরিচালিত বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের বিরোধিতায় তাকে দেখা যায় সক্রিয়। তিনি বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা কাজী আবদুল ওয়াদুদ এবং আবুল হুসেনের চিন্তাধারার কঠোর সমালোচনা করেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকালে সংহতির প্রয়োজনে তিনি পাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। মওলানা আকরম খাঁর এই বিষয়টি আধুনিক প্রগতিশীল লেখক সমাজের কাছে প্রশ্নের উদ্রেক করে এবং কেউ কেউ নিন্দা প্রকাশ করেন।
ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে ‘আকরম খাঁ এবং তার সম্পাদিত’ ‘আজাদ’এর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। শুধু তাই নয়, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনীর বর্বরোচিত গুলিবর্ষণ এবং কয়েকজন ভাষাসৈনিকের শাহাদাতের প্রতিবাদে ‘দৈনিক আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন তৎকালীন পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য থেকে পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষ্যে সে সময়কার আজাদ পত্রিকার অবদান ইতিহাসের একটি অনস্বীকার্য অংশ। এছাড়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার পক্ষেও তিনি সবসময় ছিলেন সোচ্চার। আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
স্বাধীনতার প্রশ্নে মুসলিম লীগকে গড়ে তোলার কাজে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মওলানা আকরম খাঁর বিরাট ভূমিকা থাকার পরও মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে কতিপয় মৌলিক বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। পরে তিনি সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।
বরেণ্য গীতিকবি এ সুলেখক কে জি মোস্তফা মওলানা আকরম খাঁকে ‘মুসলিম সাংবাদিকতার জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রাজনীতি, ইসলাম ও ধর্মতত্ত্ব, বাংলাভাষা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, স্বাধীন নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার উন্নয়ন, সাহিত্য-সংস্কৃতি, দৈনিক আজাদ ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা, কমিউনিজমের বিরোধিতাসহ ইত্যাদি বিষয়ে মওলানা আকরম খাঁর রচনাগুলো মূল্যবান। যুক্তিনির্ভর তথ্যসম্ভারে পরিপূর্ণ তার রচনা সমগ্র ইতিহাসের প্রকৃষ্ট দলীল এবং স্থায়ীত্ব লাভের উপযোগী।
তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রথমসারির নেতা। প্রতিবাদী চেতনার কারণে ব্রিটিশদের দ্বারা’ দৈনিক আজাদ এবং আকরম খাঁ নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। তিনি এক বছর জেল খেঁটেছেন এবং তার সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর প্রকাশের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময় বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের একটি দীর্ঘ লেখার ক্রিয়দংশ নিম্নরূপ-
‘বাংলা একাডেমির চারিতাভিধানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আকরম খাঁ একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় সক্রিয় কর্মী, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। মওলানা আকরম খাঁ কংগ্রেসে সক্রিয় ছিলেন এবং নেতৃস্থানীয় কর্মী ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে জোরালো সম্পাদকীয় লেখার জন্য তিনি এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ায় পর তিনি অদম্য স্পৃহা নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিবাদে লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে থাকেন। ১৯২৯ সালে নেহেরু রিপোর্টের প্রতিবাদে কংগ্রেস ত্যাগ করেন। নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতিরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। এর প্রথম সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৩৫ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৬ সাল থেকে তিনি মুসলিম লীগে সর্বশক্তি নিয়োগ করে কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আন্দোলনে তার ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা।’
বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী ড. এনামুল হক মওলানা আকরম খাঁ সম্পর্কে একটি লেখায় ‘এক শতাব্দীর জীবন্ত প্রতীক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সংবাদপত্রের ইতিহাসে দৈনিক আজাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ। তিনি ছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপক্ষে। অথচ দ্বিজাতিতত্ত্বের সস্তা স্লোগান লাগিয়ে ব্রিটিশদের নিকট থেকে খণ্ডিত স্বাধীনতায় খুব একটা ফল না হলেও হিন্দু মুসলমানের বৈরিতা শতগুণে বেড়ে যায়। তখন দৈনিক আজাদের মুক্তমনা লেখকদের অপরিসীম ভূমিকা ছিলো। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ধর্মীয় গোড়া হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উগ্রতা প্রথমদিকে কমে গেলেও কিছুদিনের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শতগুণে বেড়ে যায় এবং তার বিষক্রিয়ায় এখনও সমগ্র ভারতে আগুন পালায় পালায় আগুন জ্বলে। তুচ্ছ কারণেও সেখানকার মুসলমানদের প্রতি অবিচার ও অন্যায় আচরণে প্রায়ই সাধারণ মানুষের মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা নিত্য-নৈমত্তিক ব্যাপার। দৈনিক আজাদ সেইসব অন্যায় আচরণের নিন্দা করতো। যেকোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করতো না।
পরাধীন যুগ থেকেই ধীরে ধীরে ভারত কট্টর হিন্দু মৌলবাদের দিকে এগিয়েছে। এইসব চিন্তা করেই মওলানা আকরম খাঁ রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং মুসলিম লীগের সাথে আন্দোলনে অংশ নেন। অবশ্য তার পরে আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে তিনি নিজেদের সম্পদ ভারতে রেখেই কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। সেই সঙ্গে ‘দৈনিক আজাদ’ ঢাকায় স্থানান্তরিত ও পুরোদমে প্রকাশিত হতে শুরু করে। বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিক দৈনিক আজাদে চাকরি করার সুবাদে বিখ্যাত হন।
ব্রিটিশ আমলের হিন্দু রাজনীতিকদের হিন্দুত্বের ছবকে উগ্রপন্থিদের উস্কানিদাতা একশ্রেণির হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হতো, তারই ধারাবাহিকতায় সেটা আজ স্থায়ীরূপ ধারণ করেছে। এইসব কট্টর হিন্দুত্ববাদের বিষদৃষ্টি ও মুসলমানদের প্রতি অবহেলা এবং তাঁদের ভূমিকা ভারতের মুসলমানদের মধ্যে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনা জাগিয়ে তুলেছে। মুসলমানদের নাগরিক অধিকার ও জীবন রক্ষার্থে স্বাতন্ত্র্যচেতনা চেতনার প্রয়োজন দেখা দেয়। মওলানা আকরম খাঁ এবং আজাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ও লেখকগণ সেইসব বৈপরীত্য ও কট্টরপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন। তবে ইহাও সত্যি যে, বর্তমানে ভারতের কংগ্রেস রাজনীতিকদের বেশকিছু উদারনৈতিক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিত্ব এবং ভারতের জনপ্রিয় নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি মুসলমানদের প্রতি অন্যায় ও নিপীড়নমূলক আচরণের প্রতিবাদ করেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেন। এ ছাড়া কলকাতার প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই মুসলমানদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন এবং মুসলমানদের পক্ষে লেখালেখিসহ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।
মওলানা আকরম খাঁ রাজনৈতিক জীবন ছিল বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময়। খেলাফত আন্দোলনের সময় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মওলানা আকরম খাঁর রাজনৈতিক জীবনের যাত্রা শুরু হয়। তিনি ছিলেন ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ইতিহাসের নিরিখে দেখা যায় যে, ভারতবর্ষের মুসলিম রাজা-বাদশাহদের বিদায়ের পর এবং সর্বশেষ বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার করুণভাবে পতনের পর ভারতবর্ষের বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবনে সংকট ও বিপদ আরও বেশি ভয়াবহরূপে দেখা দেয়। এই বিরাট সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস হিসাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদের ক্রমাগত বিস্তার ঘটতে থাকে। সুযোগমতো দাঙ্গা ঘটিয়ে মৌলবাদী উগ্র হিন্দুরা মুসলামনদের বিরুদ্ধে চালায় তাদের হাতিয়ার। যার শিকার হয়, ভারতের সাধারণ সিংহভাগ নিরীহ মুসলমান। অন্য দিকে মুসলমানদের মধ্যেও নানা মতের দল-উপদলের সৃষ্টি হয়। তাদের উসকানিতে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এবং পূর্ববাংলার কোন কোন অঞ্চলে দাঙ্গায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি ভস্মীভূত করা হয় এবং নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। যদিও সমগ্র ভারতের মৌলবাদী হিন্দুদের তুলনায় মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীদের লুট-তরাজ সংখ্যায় খুবই নগণ্য। তবু মানবতাহীন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেকোনো অপকর্ম ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
তবুও উগ্র ধর্মান্ধতায় মুসলমানদেরকে তাদের মৌলিক দায়িত্ববোধ ও মূল স্রিট থেকে সরিয়ে মৌলবাদী ধ্যান-ধারণায় ভিত্তিতে মুসলমানদের মধ্যে গজিয়ে ওঠা কিছু কিছু ক্ষুদ্র দলের উন্মাদনাকে মওলানা আকরম খাঁ কখনো সমর্থন দেননি।
১৯১৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯২০ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি নিখিল ভারত খেলাফত আন্দোলন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে খেলাফত আন্দোলনের অন্যতম নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী এবং মওলানা মজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। আকরাম খাঁর দায়িত্ব ছিল তুর্কি খেলাফত থেকে ফান্ড সংগ্রহ করা। ১৯২০-১৯২৩ সময়ের মধ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থানে জনসভা বা সম্মেলনের আয়োজন করে খেলাফত আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলন গতিশীল করার চেষ্টা করেন। হিন্দু মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ক্ষেত্রে ১৯২২ সালে আকরম খাঁ চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টির পক্ষ নেন এবং ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট সন্ধির সময়ও তিনি একই পক্ষে ছিলেন। ১৯২৬-১৯২৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং অন্যান্য সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলির কারণে আকরম খাঁ ভারতীয় রাজনীতির উপর তাঁর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং তিনি স্বায়ত্তশাসন পার্টি এবং কংগ্রেস থেকে সরে দাঁড়ান। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে তিনি গ্রামীণ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেই রাজনীতির তুমি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মওলানা আকরম খাঁ ১৯৩৬ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত হন। প্রাদেশিক সভাপতির পদসহ মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হলে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।
শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আকরাম খাঁ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে গঠিত পাকিস্তান কাউন্সিল অব ইসলামিক আইডোলজির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। মওলানা আকরম খাঁর রচনাবলী অনেক সমৃদ্ধ এবং তিনি প্রচুর লিখেছেন। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের লেখা থেকে জানা যায়, ‘মওলানা আকরম খাঁর অনেক রচনা অগ্রন্থিত রয়েছে। সেগুলো বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হলে অবশ্যই ইতিহাসের অংশ হবে।’
মাওলানা আকরম খাঁর রচিত ‘মোস্তফা চরিত’ একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। তাঁর অনুবাদিত ‘বাংলা তফসিরুল কুরআন’ পবিত্র কুরআনের বাংলা অনুবাদ হিসেবে উন্নতমানের এবং উৎকৃষ্ট। এ ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে- ‘সমস্যা ও সমাধান’ গ্রন্থে বাংলার মুসলিম জীবন ও সমাজের সমস্যাবলির যে সমাধান তিনি দিয়েছেন, তাতে আল্লাহ এবং রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস অবলম্বন করে, বাস্তবধর্মী প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। ‘গুণমান বাংলার সামাজিক ইতিহাস’ অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থ। ‘মুক্তি ও ইসলাম’ গ্রন্থে ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন ও ইসলামের মর্মবাণী ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অনেক লেখা অগ্রন্থিত আছে। মওলানা আকরম খাঁর রচনাবলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা দরকার।
শিক্ষিত সুশীল লেখকদের মতামত হচ্ছে মওলানা আকরম খাঁর বিপুলসংখ্যক লেখাগুলো সংগ্রহ করে ‘বাংলা একাডেমি’র উচিত রচনাবলী আকারে প্রকাশ করা। ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠা থাকতে হলে মওলানা আকরম খাঁকে আমাদের রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের ইতিহাস থেকে বাদ দেয়া উচিত হবে না। বাংলা সাহিত্যের আদর্শ নির্মাতা হিসেবে তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন।
বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে দৈনিক আজাদ এবং কিংবদন্তি সাংবাদিক মওলানা আকরম খাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে জ্ঞানদানের জন্য তাঁর রচনা পাঠ্যবইয়ের তালিকাভুক্ত হওয়া উচিত। এতে আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য যেমন সংরক্ষণ হবে, তেমনই শিল্প-সাহিত্যে তাঁর বহুমাত্রিক অবদান আমাদের ইতিহাস সমৃদ্ধ হবে।
বাংলা ভাষার সর্বপ্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদ যেমন সাংবাদিকতা সৃষ্টিতে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে। তার তুলনা বিরল। তিক্ত হলেও সত্যি যে, মওলানা আকরম খাঁর অবিস্মরণীয় জীবনবোধ সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম এবং আমাদের বর্তমান সমাজের দাপুটে সাংবাদিকদের অনেকেই বিস্মৃত হয়ে আছেন।
পরিতাপের বিষয়, আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের এখন আর মনে রাখতে চাই না। বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতা যতটা বিত্তবান হয়েছে, স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার আদর্শ থেকে অনেক নিচে সংকীর্ণতার গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছে। মানবতার কল্যাণে সুসমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য এ সভ্যতার পথ বিনির্মাণে যাঁদের অবদান রয়েছে, তাঁদের মনে রাখলে কোনো ক্ষতি নেই, অনেক লাভ। এতে আমাদের দেশ, মাটি ও মানুষ উপকৃত হবে।
আনন্দের বিষয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে দৈনিক আজাদ পত্রিকার বহু পুরনো সংখ্যা সংরক্ষিত আছে। তবে বাংলা একাডেমি, পাবলিক লাইব্রেরি, ইসলামী ফাউন্ডেশন লাইব্রেরি এবং আর্কাইভে দৈনিক আজাদ এবং মওলানা আকরম খাঁর গ্রন্থাবলী রাখার ব্যবস্থা হলে সাধারণ পাঠকমহল অনেক বেশি উপকৃত হবেন। আমাদের বিপুলসংখ্যক গবেষক ও লেখকগণ তাঁদের তথ্যসমৃদ্ধ লেখার উপকরণের খোরাক পাবেন।
অবিনশ্বর জীবনবোধের অধিকারী হিসেবে সাংবাদিকতার জনক, কিংবদন্তি সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও দার্শনিক মওলানা আকরম খাঁ বেঁচেছিলেন পুরো একশত বছর। শতায়ু প্রাপ্ত এই মহান মানুষটির সুদীর্ঘ ১০০ বছরের পুরো জীবনই ছিল অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ ও সাফল্যে ভরপুর, কর্মমুখর, বর্ণাঢ্য এবং বৈচিত্র্যময়। তিনি চির অনির্বাণ। ১৯৬৮ সালের ১৮ আগস্ট, ঢাকায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
মওলানা আকরম খাঁর অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরনোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করেন। আমরা যেন তাঁকে মনে রাখি এবং তাঁর অবদানের কথা ভুলে না যাই।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।