শাহজাহান চঞ্চল, রিয়াদ, সৌদি আরব:
গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেল। এলোকেশী রোদ বাঁশ ঝাড়ের ডগা ছুঁয়ে পুকুরের পানিতে ঝিলমিল ছন্দ তুলে স্নান করছে। রোদে পোড়া শরীর নিয়ে বাতাস হয়ে আছে স্তব্ধ। সারাটা দুপুর সে পেয়েছে অসহনীয় কষ্ট। কেবলমাত্র একটু আগে সে রোদের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছে। ওষ্ঠাগত তার প্রাণ এখন। প্রাণীর নিঃশ্বাসের রসদ জোগানোর শক্তিটুকু ছাড়া একটুও বাড়তি শক্তি নেই তার শরীরে। সে তার প্রবাহমানতায় দোলাতে পারছে না গাছের পাতা, পুকুরের জল, পদ্মের পাঁপড়ি।
নীরবতা যেন স্বর্ণ ঈগল। বিকেলটাকে চেপে ধরে রেখেছে তার নখরের নিচে। চারিদিকে কেমন একটা দুঃখি দুঃখি ভাব। এই ভাবটা আরো গাঢ় হলো বেনে-বৌ নামের হলদে পাখিটার ডাকে। গাছের আড়ালে বসে আপন স্বভাবে পাখিটা ডাকছে- খোকা ডাকে, খোকা ডাকে, খোকা ডাকে। বেনে-বৌ পাখিটার এই দুঃখজাগানিয়া ডাকে সচকিত হলো প্রকৃতি। নীরবতার স্বর্ণ ঈগলটা পালালো দূরে।
শমসের সাহেব তাঁর বাংলো ঘরের জানালায় চোখ ঢেলে দেখছিলেন ঝিম ধরে থাকা প্রকৃতি। বাংলো ঘরের অদূরে বাঁধা পুকুরের কোণে ফুটে থাকা লাল শাপলায় আটকে ছিলো তাঁর দৃষ্টি। সেখানে খেলা করছিল দু’টি লাল ফড়িং। নিস্তব্ধতা ভেদ করে ফড়িং দুটোর পাখার ফড়ফড় আওয়াজ শমসের সাহেবের কানের কাছে এসে হামাগুড়ি দিচ্ছিল। তিনি মুগ্ধ ছিলেন ফড়িং দুটোর নানা কসরৎ দেখতে। কিন্তু বেনে-বৌ’র ডাকে শমসের সাহেবের তন্ময়তার তার ছিঁড়ে গেল। তিনি জানালা ছেড়ে বারান্দায় এলেন। সেখানে রাখা ইজি চেয়ারের একটি টেনে বসলেন। বারান্দায় ঝুলানো অর্কিডের টবগুলোর নিচ দিয়ে চোখ দুটকো প্রসারিত করলেন, হলদে পাখিটা যেখানে বসে ডাকছে সেই দিকটায়। তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে বন্ধ করলেন চোখ। শুনতে থাকলেন বেনে-বৌ’র করুণ বিলাপ- খোকা ডাকে, খোকা ডাকে। এক সময় ভাবনার অতলান্তে ডুবে গেলেন তিনি। যেন সন্ধান করতে চাইলেন, বেনে-বৌ’র ‘খোকা ডাকে’ বলার রহস্য।
তবে কি বেনে-বৌ আরজনমে ছিল মানুষ রূপে? তার খোকা কি হারিয়েছিল দূর কোথাও, চোখের আড়ালে? পাখি হয়ে এ- জনমে সে কী খুঁজে ফিরছে তার খোকাকে পৃথিবীময়? হয়তোবা, হয়তোবা নয়। কিন্তু শমসের সাহেব হারিয়ে যেতে থাকলেন ‘খোকা ডাকে’ শব্দের গহিনে। তাঁর স্ত্রী মাহমুদা এসে বসলেন তাঁর পাশে। কিন্তু টের পেলেন না তিনি তাঁর আগমনে। বেনে-বৌ ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে এক সময় উড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে তিনি পাশে বসা স্ত্রীকে দেখলেন। লক্ষ্য করলেন তার স্ত্রীর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে মুক্তোর মতো ক’ফোঁটা জল। তিনি গভীর মমতার হাতে মুছে দিলেন সে জল। পাশাপাশি অনুভব করলেন নিজের চোখও ভিজে আছে তার। পাঞ্জাবির শেষ প্রান্ত দিয়ে মুছে নিলেন চোখ।
আহা! তাদের খোকা আজ কতদূরে। সেই সাত সমুদ্রের ওপারে, গোলার্ধের শেষ প্রান্তে। ঘর সংসার পেতেছে সেখানেই। আহা খোকা কি কখনো ফিরে আসবে না, মায়ের বুকে, বাবার কাছে, শ্যামল মাটির সোঁদা গন্ধ বুকে নিতে? রাতে যে ছেলের ঘুম আসতো মায়ের মুখে রূপকথা শুনতে শুনতে। সাত সকালে ঘুম ভাঙতো বাবার হাতের স্নেহ স্পর্শে। ভোরের বাতাস গায়ে মেখে সবুজ প্রান্তর দিয়ে যে ছেলে হেঁটে যেতো অলীক পণ্ডিতের পাঠশালার দিকে। ভালবাসত আকাশের নীল। হলুদ সর্ষে ক্ষেত। কাশবনে খুঁজে ফিরতো বাগডাশের বাসা। লক্ষীপেঁচা-আর ডাহুকের ডাকে যে আন্দোলিত হতো, বড় হয়ে গেছে বলেই কি তাকে ভুলে যেতে হবে এসব? শ্যামল এ দেশে তার জন্য কি ছিল না কিছুই? অর্থ, প্রতিপত্তি, মোহ মানুষকে কি ভুলিয়ে দেয় তার অতীত বন্ধন? শিকড় কেটে কেমন করে পালায় মানুষ?
জানো মাহমুদা, একদিন আমাদের খোকা ফিরে আসবেই। শমসের সাহেব জোর দিয়েই স্ত্রীকে কথা কয়টি বলেন। হয়তো বা, নির্লিপ্তভাবে উত্তর করেন তার স্ত্রী। হয়তো কেন বলছো মাহমুদা- এ কথা হবে চরম সত্যি। যাযাবর পাখি যেখানেই যাক না কেন, এক সময় ঠিকই ফিরে আপন নীড়ে, বন্ধনের টানে। আর জীবনানন্দের দেশে যে জন্মেছে তাকে আসতেই হবে ফিরে- বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালবেসে।
কি জানি জীবনানন্দীয় কথাগুলো সব আমার বোঝার মতো নয়। আমার খোকা ফিরে এলেই হলো ব্যস। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আঁচলের পাড়ে চোখ মুছে নিলেন শমসের সাহেবের স্ত্রী। কিন্তু শমসের সাহেবের সেদিকে দৃষ্টি নেই। আবেগে আপ্লুত তিনি। তাঁকে যেন কথা বলার নিশিতে পেয়েছে। তিনি বলেই যাচ্ছেন-তোমার কি মনে আছে মাহমুদা, খোকা যখন হলো দুপুরইতো ছিলো তাই না? আকাশ ভরা মেঘ ছিলো সেদিন। থেমে থেমে হচ্ছিলো বৃষ্টি। টুপুর টাপুর বৃষ্টি পড়ার ছন্দ ছিলো গাছের পাতায়। কিন্তু কী আশ্চর্য! খোকা ভূমিষ্ঠ হবার পর আকাশের পূব পাশে বিরাট একটা রংধনু উঠল। সবাই বললো ভাগ্যবান খোকা। জীবন হবে ওর রংধনুর মতোই সাতরঙ্গা।