ইসরাত জেবিন:
দীর্ঘ ১৪ বছর পর গত জুলাইয়ে ব্রিটেনে কিয়ের স্টারমারের নেতৃত্বে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে লেবার পার্টি। দেশটির রাজনীতিতে হাউস অব কমন্সে প্রতিনিধিত্ব করছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চার জন। ঘটনাক্রমে চার জনই নারী এবং বর্তমান সরকারি দলের সদস্য। তাদের মধ্যে আফসানা বেগম দ্বিতীয়বারের মতো লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের পপলার অ্যান্ড লাইমহাউস আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন।
ব্রিটেনের এবারের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আফসানা বেগমের দল লেবার পার্টি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, লেবার পার্টি ৩৩৩টি আসনে জয় পেয়েছে। অন্যদিকে, কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ৭১টি আসন। আর লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টি পেয়েছে ৪৬টি আসনে জয়।
২০১৯ সালে আফসানা লেবার পার্টির মনোনয়নে প্রথম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টে তিনিই প্রথম হিজাব পরিহিত সংসদ সদস্য। ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সোচ্চার ভূমিকা পালন এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন তিনি।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
আফসানা বেগমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা টাওয়ার হ্যামলেটসেই। তার বাবা টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক কাউন্সিলর মনির উদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশে তাদের আদি বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলায়। রাজনীতি বিষয়ে কুইনমেরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে স্নাতক এবং ২০১২ সালে সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ও কমিউনিটি লিডারশিপ বিষয়ে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করেন তিনি।
আফসানা বেগম লেবার পার্টির লন্ডন রিজিয়ন শাখার সদস্য। দলটির টাওয়ার হ্যামলেটস শাখার সহসভাপতিরও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। আফসানা টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আবাসন বিভাগে কর্মরত আছেন।
প্রথমবার এমপি
পপলার এবং লাইমহাউস সংসদীয় আসনের সাংসদ জিম ফিটজপেট্রিক ২০১৯ সালের শুরুর দিকে রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রায় দুই দশক ধরে এ আসনে এমপি ছিলেন লেবার দলের জিম ফিটজপেট্রিক। অনেকটা চমক জাগিয়ে লেবার দলের মনোনয়ন কেড়ে নেন রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত তরুণ বাঙালি কন্যা আফসানা বেগম। নির্বাচনে তিনি ৩৮ হাজার ৬৬০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির শন ওক পান ৯ হাজার ৭৫৬ ভোট। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি পারিবারিক সহিংসতা নির্যাতন বিষয়ক ব্রিটিশ সংসদের সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ফের এমপি
চলতি বছরের জুলাইয়ে ব্রিটেনের জাতীয় নির্বাচনে লেবার পার্টির মনোনয়ন পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো পার্লামেন্ট সদস্য হয়েছেন আফসানা বেগম। লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের পপলার অ্যান্ড লাইমহাউস আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের তথ্যানুযায়ী, নির্বাচনে ১৮ হাজার ৫৩৫ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রার্থী গ্রিন পার্টির নাথালি বেইনফিট পেয়েছেন ৫ হাজার ৯৭৫ ভোট।
আফসানার এই আসন নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বেশি আলোচনা ছিল তার সাবেক স্বামীর কারণে। তবে আফসানার সাবেক স্বামী এহতেশামুল হক তার ধারে-কাছেও আসতে পারেননি। স্বতন্ত্র প্রার্থী এহতেশামুল ৪ হাজার ৫৫৪ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন।
বাংলাদেশ নিয়ে সোচ্চার আফসানা
ব্রিটেনে জন্মগ্রহণ করলেও আদি নিবাস বাংলাদেশ নিয়ে আফসানাকে প্রায় সময়ই সোচ্চার হতে দেখা গেছে। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী সরাকরের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ‘দুর্নীতির মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’। সম্প্রতি সাইফুজ্জামান চৌধুরীর দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্রিটিশ দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস এবং আল-জাজিরা।
যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ‘দুর্নীতির মাধ্যমে’ গড়া সম্পত্তি জব্দ ও তদন্তের বিষয়ে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা দেশটির দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার প্রধানের কাছে জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি আফসানা বেগম।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির মহাপরিচালক গ্রায়েম বিগারের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে এই সম্পত্তির ‘মালিক বাংলাদেশ’ হিসেবে উল্লেখ করে তা ফেরানোর কথাও বলেন তিনি।
পপলার অ্যান্ড লাইমহাউজ আসনের এমপি আফসানা বলেন, এসব সম্পত্তির মালিকানা বাংলাদেশের এবং আমি বিশ্বাস করি, এগুলো বাংলাদেশের জনগণের কাজে লাগানোর জন্য ফেরত পাঠাতে হবে। এখন এমন এক সময়- যখন তারা গণতন্ত্র এবং তাদের নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত হবে, এমন সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী অবৈধ উপায়ে গড়া সম্পদ ফেরাতে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাওয়ার কথা তুলে ধরে আফসানা লেখেন, ‘এসব দুর্নীতির তদন্তের অংশ হিসাবে জনাব চৌধুরী এবং অন্যদের যুক্তরাজ্যভিত্তিক সম্পত্তি তদন্ত ও জব্দের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটা আপনি খোলাসা করলে কৃতজ্ঞ থাকব।’
ব্রিটিশ এমপি আফসানা লিখেছেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে কর জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং সংস্থাটি দাবি করেছে যে, তিনি যুক্তরাজ্যে কোটি কোটি ডলার পাচার করেছেন।
তিনি লেখেন, ‘এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি ও ইউকে কোম্পানিজ হাউজ পর্যালোচনা করে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পেয়েছে, চৌধুরীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ১৫ কোটি পাউন্ডের অন্তত ২৮০টি সম্পত্তি অর্জন করেছে। আল-জাজিরার এক তদন্ত প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, আমার নির্বাচনি আসন পপলার অ্যান্ড লাইমহাউজে ৭৪টি সম্পত্তির মালিক জনাব চৌধুরী।’
গাজা যুদ্ধ নিয়েও সোচ্চার
ফিলিস্তিনের গাজায় প্রায় এক বছর ধরে নির্বিচারে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি দখলদার। ব্রিটিশ সরকারকে ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে মনে করা হয়। দেশটি ইসরাইলকে সামরিকসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তবে আফসানা বেগম গাজা উপত্যকায় ইসরাইল বর্বর হামলার ঘোর বিরোধী। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। জুলাইয়ে দ্বিতীয়বারের মত এমপি হয়ে আফসানা বেগম তার ফেসবুক পোস্টে জানান, ‘আমি পুনরায় নির্বাচিত হতে পেরে আনন্দিত। গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান হোক। কঠোরতর বিরোধিতা করা হোক বা অভিবাসী অধিকারের পক্ষে কথা বলা হোক। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে যাই হোক না কেন আমি পপলার এবং লাইমহাউসের পক্ষে দাঁড়াব।’