কোলকাতা, ভারত প্রতিনিধি: সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রেম, সেই প্রেমের টানাপোড়েনে আত্মহত্যা, ফেসবুকের বন্ধুর ডাকে দেখা করতে গিয়ে প্রতারিত, দলিতের উপর অকথ্য নিপীড়নের ছবি ফেসবুকে আপলোড– এসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া যখন বুঁদ হয়ে আছে, তখন কয়েকজন কবিতা পাগল বন্ধু মিলে তৈরী করে ফেলেছে একটি ফেসবুক গ্রুপ ” কবিতাই প্রাণ”। এ যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় একটুকরো ঘাসজমি, এক চিলতে দখিনা বাতাস।
এহেন ‘কবিতাই প্রাণ’ আয়োজিত ‘রবির আলোয় ‘ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কলকাতার জীবনানন্দ সভাঘরে দর্শক পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে। অনুষ্ঠানটিতে বিশিষ্ট কবি আর আবৃত্তি শিল্পীরা যথাযোগ্য সম্মানে স্মরণ করলেন রবি কবিকে। সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কবি অরুণ চক্রবর্তী, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী ও অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়। ছিলেন বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী জয়িতা ভট্টাচার্য এবং প্রখ্যাত আবৃত্তিকার ও কণ্ঠশিল্পী প্রযুক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়।
এছাড়া এদিন ‘কবিতাই প্রাণ’-এর সদস্য-সদস্যা আবৃত্তি শিল্পীরাও কবিতা আবৃত্তি ও পাঠ করলেন। তাদের অনেকের আবৃত্তিই যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে। নতুন প্রজন্মও যে আবৃত্তিকে বা কবিতাকে ভালোবেসে অনেক রঙিন হাতছানি উপেক্ষা করে এবং রীতিমত কঠোর অনুশীলন করে এই জগতে তার আসন সুনিশ্চিত করতে তৎপর তা বুঝিয়ে দিলেন ‘কবিতাই প্রাণ’ এর কনিষ্ঠ সদস্যা অভীপ্সা মুখার্জী। কবিতার প্রতি দুর্নিবার ভালবাসায় পঁচাত্তর বছরের বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে ছুটে এসেছিলেন তৃপ্তি ঘোষ। তার কবিতা পাঠ ও কবিতার প্রতি তার ভালোবাসা সমস্ত শিল্পীদের সেদিন যে অণুপ্রাণিত করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেদিন দর্শকাসনে উপস্থিত ছিলেন আবৃত্তি জগতের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রচারের আলো থেকে শতহস্ত দূরে থাকা এই ব্যক্তিত্বের আবৃত্তি জগতে অবদান অনস্বীকার্য। তাকে হঠাৎ করে পেয়ে যাওয়ায় কবিতাই প্রাণের পক্ষ থেকে তাকে সম্মাননা জানানো হল।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কবি জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় স্বরচিত কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। বিশিষ্ট কবি ও বাচিকশিল্পী সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী সেদিন স্বরচিত কবিতা নয় তার স্বভাবসিদ্ধ চর্চিত গলায় জয় গোস্বামীর গদ্য পাঠ করে শোনালেন। তরুণ কবি অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় স্বরচিত কবিতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাথে সেদিন তার মাকেও শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন।
এক্ষেত্রে সংযোজন আবৃত্তিশিল্পী জয়িতা ভট্টাচার্য, যিনি অনিন্দ্যর কবিতা তার সুকন্ঠে ধারণ করলেন। যথেষ্ট উপভোগ্য ছিল জয়িতার উপস্থাপনা। দীর্ঘদিন মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী প্রযুক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থাপনাটি দর্শকদের কাছে খুবই শ্রুতিমধুর ছিল। বিশেষত শীর্ষেন্দুর গদ্যাংশ তার নাটকীয় বাচনভঙ্গিতে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছেছিল। শহরে থেকেও যিনি বুকের মধ্যে গ্রামকে লালন করেন, এ প্রজন্মের সেই বিশিষ্ট কবি অরুণ চক্রবর্তী শব্দের কবিতা হয়ে ওঠা আর কবিতার আবৃত্তি হয়ে ওঠার জার্নিটা যখন সহজ ভাষায় তুলে ধরলেন তখন মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। উপরিপাওনা কবিকন্ঠে কবির স্বরচিত কবিতার আবৃত্তি। প্রেক্ষাগৃহে একদল কবিতা পাগল মানুষ তখন বাকরুদ্ধ। এমন একটি মনোজ্ঞ সন্ধ্যা উপহার দেবার জন্য মঞ্জু মুখার্জী (‘কবিতাই প্রাণ’-এর প্রাণদাত্রী) ও সুজাতা ঘোষ রায়কে অভিনন্দন।
সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন গার্গী সেনগুপ্ত। এমন আরো অনেক প্রতিষ্ঠান যখন ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য উঠতি শিল্পীদের মঞ্চে তুলতে দিকে দিকে এমন অনুষ্ঠানের আয়োজনে মত্ত হয়েছে তখন ‘কবিতাই প্রাণ’ দেখিয়ে দিল যে, সে পথে না হেঁটেও শুধু কবিতাকে ভালবেসে এমন একটি সুন্দর অনুষ্ঠান করা যায়। সুদীর্ঘ হোক তাদের পথ চলা।