রাজিব ইব্রাহীম
আপনি জানেন কি, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কে? আচ্ছা, বলুনতো সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন? কিংবা যদি প্রশ্ন করা হয়, বলুনতো আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার কে? ভাবছেন এত প্রশ্নের উত্তর একসাথে দিবেন কিভাবে? একবার ভাবুনতো সবগুলো প্রশ্নের উত্তর যদি হয় কেবল একজন ব্যক্তির নাম, তাহলে নিশ্চয়ই প্রশ্নকর্তার উপর বিরক্ত হওয়ার ব্যাপারে কিছুটা শিথিলতা আনা যেতে পারে। তাহলে জেনে রাখুন, তিনি এমন একজন রাষ্ট্রীয় নেতা যিনি তরুণদেরকে সুযোগ দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে রাজনীতি থেকে অবসরে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ ১৫ বছর পর অবসর ভেঙ্গে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে পুনরায় রাজনীতিতে এসেছেন। ৯২ বছর বয়সে হয়েছেন মালয়েশিয়ার সপ্তম প্রধানমন্ত্রী। তিনি আধুনিক বিশ্বের অন্যতম সফল ব্যক্তিত্ব তুন ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদ। ফ্যাক্ট এবাউট প্রতিবারই চেষ্টা করে আপনাকে এমন একজন রাষ্ট্রপ্রধানের জীবনের গল্প বলতে, যার থেকে আপনিও উপলব্ধি করতে পারেন আপনার জীবনকে, নিতে পারেন জীবন বাদলে দেয়া কোন সিদ্ধান্তও।
সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া এক অসাধারণ প্রতিভা: ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই বৃটিশ মালয়ার কেদাহ রাজ্যের এ্যালর সেটরের এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মাহাথির বিন মোহাম্মদ। আধুনিক মালয়েশিয়ার এই স্থপতির জন্ম তারিখ নিয়ে শুরু থেকেই কিছুটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। জন্ম সনদ অনুযায়ী তাঁর জন্ম তারিখ হচ্ছে ২০ ডিসেম্বর, কিন্তু তাঁর জীবনী লেখক ব্যারি ওয়েইন অবশ্য জন্ম সনদে দেয়া তারিখটিকে খেয়ালি বশত ভুল করা হয়েছে বলে দাবি করেন। তিনি ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার নয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি ছিলেন তাঁর বাবা। পেশায় শিক্ষক হলেও পরবর্তীতে সরকারি নীরিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনের বাকী অংশটুকু কাটালেও কাটিয়ে উঠতে পারেননি সংসারের অভাব-অনটন।
শৈশব ও শিক্ষা: মাহাথিরের শৈশব কতটা ভঙ্গুর ছিল তা কেবল সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলেই বোঝা যায়। যেই মাহাথির শৈশবে পা রেখেছেন সেই থেকে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধনামক জার্মানী ও জাপানিদের আগ্রাসন। উল্লেখ্য, পূর্বে থেকেই মালয়েশিয়া বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বৃটিশ সরকার কর্তৃক শাসিত হয়ে আসছিল। মাহাথিরের প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও প্রচুর মেধার কাছে এই পরিস্থিতিগুলো সাময়িক বাধা সৃষ্টি করলেও থেমে থাকেনি মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শৈশব ও শিক্ষা জীবন। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সাময়িকভাবে থেমে যায় তাঁর পড়ালেখা। জাপানিরা বৃটিশ শাসিত মালয়কে দখল করে বৃটিশদের দ্বারা পরিচালিত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। ফলে মাহাথিরের অধ্যয়নকৃত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটিও বন্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ্য, এ সময় মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অবশ্য হাওয়ায় গা ভাসিয়ে সময় কাটাননি। পরিবারের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠতে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করে বেড়িয়েছেন চা, কফি, কলা ও বিভিন্ন রকমের নাস্তা!
চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রি অত:পর একই বিষয়ে পেশা: সিঙ্গাপুরের কিং এ্যাডওয়ার্ড সেভেনথ কলেজ অব মেডিসিন থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন মাহাথির। দেশে ফিরে এসে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু সরকারি বিভিন্ন বিধি নিষেধের ফলে তিনি নিজের মত করে তাঁর রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে পারছিলেন না। ফলে বেশি দিন করা হয়নি সরকারি চাকরিটি। ইস্তফা দিয়ে নিজ শহর এ্যালর সেটরে এসে নিজের উদ্যোগে একটি ক্লিনিক খুলেন। মনে করা হয়, তাঁর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে চালুকৃত এই ক্লিনিকটিই তাকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যেতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে ছিল।
রাজনীতিতে পদার্পণ: মাহাথির প্রথমে কেদাহ মালয় যুব ইউনিয়ন এবং পরে কেদাহ মালয় ইউনিয়ন নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যা পরবর্তীতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ইউএমএনও হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু এর অনেক আগেই মাহাথিরের রাজনীতিতে আগমন ঘটেছিল। যখন বয়স মাত্র বিশ, ঠিক তখন থেকেই তিনি সহপাঠীদের একত্র করে সা¤্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকার কর্তৃক মালয়ান ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জাপানিরা চলে যাবার পূর্বে তৎকালীন মালয়েশিয়াকে তারা থাই সরকারের শাসনাধীনে হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে বৃটিশরা আবার ফিরে আসে এবং মালয়ান ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। মাহাথির ও তাঁর বন্ধুরা তখন রাতের অন্ধকারে সারা শহরে স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক বাণী সম্বলিত পোস্টার লাগাতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সীমিত মালয় ইউনিয়ন প্রস্তাবের সমাপ্তি ও প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা ফিরে পাওয়া।
একটানা বাইশ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন: ১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও কাজ করেছেন দুই বছর এবং উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘ পাঁচ বছর। এই সময়ে তিনি নিজেকে দেশটির সবচেয়ে দীর্ঘতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করণের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই তিনি দেশের উন্নয়নের সবগুলো মাপকাঠিকে ঢেলে সাজান। এ সময় দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য তাঁর সমস্ত পরিকল্পনাকে কাজে লাগান। যেটা তিনি পরবর্তীতে মালয়ানদের দেয়া এক ভাষণে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, আমি উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকা অবস্থায় এমন অনেক কিছুই করতে চাইতাম যেটা করতে পারতাম না, কিন্তু দেশের স্বার্থে যা করা দরকার আমি এখন তাই করবো। তবে, মালয়ানরা অবশ্য তাঁর কথায় না, বিশ্বাস করে তাঁর কাজে। আর এ জন্যই হয়তোবা ’৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত একটানা বাইশ বছর দেশকে শাসন করতে গিয়েও ক্লান্তি বোধ করতে হয়নি বিরানব্বই বয়সী বর্তমান এই প্রবীণ রাজনীতিবীদকে।
স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর: ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর দিনটি ছিল মালয়েশিয়ার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। কারণ ঐ দিনই বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল তরুণদেরকে সুযোগ করে দেয়া এবং নিজের ও পরিবারের জন্য কিছু সময় বের করা। উল্লেখ্য, এর আগেই ওআইসি’র সফল সমাপ্তির মাধ্যমে তিনি তাঁর দীর্ঘ বাইশ বছরের শাসনকার্যের ইতি টানবেন বলে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনরায় দায়িত্ব গ্রহণ: চারদিকে দুর্নীতি, অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খলা ও অশান্তিতে যখন মালয়েশিয়ার জনগণ চরম ভোগান্তিতে ঠিক তখনই আবার আলোর ঝলকানির মত আবির্ভূত হলেন মাহাথির। ১৫ বছরের দীর্ঘ অবসর ভেঙ্গে পুনরায় আসলেন রাজনীতিতে। এসেই জয় করলেন বয়সকে। প্রমাণ করলেন, রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনগণের কল্যাণার্থে বয়স কখনো বাধা হতে পারে না। ৯২ বছর বয়সে, চলতি বছরের ৯ মে দেশের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ এই রাষ্ট্রনেতা।