মুহম্মদ শামসুল হক, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র:
সঙ্গলিপ্সু আদিম অরণ্যচারি ও গুহাবাসী মানুষ লোভ-লালসা বশে সৃষ্টির ঊষালগ্নে বন-বাদাড় উজাড় করে বসতি গড়ার কাজ শুরু করে। এ পর্যায়ে বিভিন্ন বন্য প্রাণীর উপদ্রব থেকে নিজেদের ফলসাদি এবং আত্মরক্ষার তাগিদে তারা পাথর দিয়ে নানা ধরনের অস্ত্র তৈরি শুরু করে। পরবর্তীতে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাজবদ্ধ মানুষ মানব সভ্যতাকে ধাপে ধাপে সমৃদ্ধির স্বর্ণ শিখরে নিয়ে যায় এবং অস্ত্র-শস্ত্রের উদ্ভাবনেও যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়ন করে। পর্যায়ক্রমে বিজ্ঞানীদের নিত্য নতুন উদ্ভাবন প্রযুক্তির উৎকর্ষ-পারমাণবিক শক্তির আবিষ্কার মানুষের শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বকামী মনোজগতে দানবের পদচারণা ঘটায়। পরিণতিতে বিশ্বজুড়ে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার নেশায় ও দুর্দমনীয় লোভ-লালসা বশে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র, মারণাস্ত্র ও নিত্য-নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজ-সভ্যতা ও গোটা বিশ্বকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহে এবং পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে একই দিনে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে ৮০ লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানি মূলত বিশ্ব আগ্রাসী শক্তির লোভ-লালসারই করুণ পরিণতি। পারমাণবিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ভোগবাদী বিশ্বমোড়লদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে বর্তমানে প্রতিনিয়ত গোটা বিশ্বে রাজ্য-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ও ক্ষমতার হাত বদল ঘটছে এবং অগণিত তরতাজা প্রাণ চোখের নিমেষে ঝরে যাচ্ছে।
ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত অনুসারে অস্ত্রবলে বলীয়ান মধ্য এশিয়ার সুঠাম দেহধারী আর্য নামক একদল লোভী জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষের খর্বকায় এবং শান্তিপ্রিয় আদি বাসিন্দাদের দেশ দখল করে স্থানীয়দের ভূমিদাসে পরিণত করে। অনার্যদের রক্ত ও ঘামে ভেজা আবাদী ফসলে আর্যরা ভোগবিলাসপূর্ণ জীবনযাপন করত বলে ইতিহাস থেকে প্রমাণ মিলে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সমাজে বিভিন্ন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা এবং ভূস্বামী প্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই প্রজাসাধারণের রক্ত ও ঘামঝরা অর্থ-বিত্তে রাজা-বাদশাহ-সম্রাট ও ভূস্বামীদের রাজভান্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে এবং তাদের পাপের বোঝাও বাড়তে থাকে। বিশ্বের লোভী শোষকগোষ্ঠী আকাশ আড়াল করা হর্মে বসবাস, ভোগ, বিলাসিতা এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণতায় আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সুজলা, সুফলা, অরণ্যকুন্তলা গ্রামপ্রধান বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের শোষিত জনগোষ্ঠী দিনে দিনে জমি-জিরাত, ঘরভিটি খুইয়ে পথের কাঙাল হয়ে দাঁড়ায়।

এরই মর্মন্তুদ ভাষাচিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে কবিগুরু বলেছেন: ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি; রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’
এদিকে গোটা বিশ্বে লোভী ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার পর প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বাসিন্দাদের জীবনাচরণে গগনচুম্বি ব্যবধান সূচিত হয়। পরস্ব লুন্ঠনকারী ব্রিটিশ শাসক, আমলা, কামলা, রাজপরিবারের সদস্যদের জীবন থেকে মনুষ্যত্বের মূলোচ্ছেদ ঘটে এবং পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবে তাদের চারিত্রিক অধঃপতন সূচিত হয়। সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্টরা পানশালা, বেশ্যালয়, নৃত্যালয়ে স্ত্রীদের বাইরে বারবনিতা, নর্তকী নিয়ে নিশি যাপন শুরু করে। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে শোষক, আমলা, কামলাদের উঠতি বয়সী যুবক, যুবতীরাও গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড নিয়ে রাত যাপন ছাড়াও সমকামিতা, গাঁজা, আফিম, ভাংসহ নানা ধরনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। সর্বভোগের পরও দুর্দমনীয় লোভ বশে এক পর্যায়ে হতাশার করাল গ্রাসে আচ্ছাদিত হয়ে ভরাপ্রাচুর্যের সংসারের উঠতি বয়সী যুবক-যুবতীরা আত্মহত্যার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। ষোড়শ, সপ্তদশ, অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে সংঘটিত আত্মহত্যার সিংহভাগ যুক্তরাজ্যে ঘটেছিল বলে ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। রাজপরিবারের সদস্যদের নিয়েও মুখরোচক কিচ্ছা-কাহিনীর ইয়ত্তা ছিলনা। মূলত পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবে পাশ্চাত্যের সমকামিতা, সমকামী বিয়ে, বিয়ে বহির্ভূত যৌনসম্ভোগ বা নৈতিকতা বিবর্জিত অন্যান্য আচরণকে ব্যভিচার হিসেবে আখ্যায়িত করার কিংবা এর বিরোধিতা করার সৎ সাহস কারও ছিলনা। ফলশ্রুতিতে এ সকল অনাচারই সামাজিক ও ধর্মীয় আচার এবং নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মকা-ই সামাজিক ও জীবনাচরণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়।

আবার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার দখলদারিত্ব থেকে ১৮৭২ সালে মুক্তি লাভের পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রও কালক্রমে বিশ্ব তিলোত্তমা বা অমরাবতীর মর্যাদা অর্জন করে। বিশ^ব্যাপী প্রভুত্ব করার খায়েশে ২য় বিশ^যুদ্ধের সময় জাপানে মানববিধ্বংসী বোমাহামলা করে তার শ্রেষ্ঠত্বের জানান দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পরাক্রমশালী রাষ্ট্র হলেও আজ তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অশুভ আর পাপের সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। এক পর্যায়ে বেসামাল লোভ-লালসার সাথে সামাজিক এবং ধর্মীয় যাবতীয় অনাচারও যুক্তরাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে। সমকামিতা, সমকামী বিয়ে, বিয়ে বহির্ভূত যৌনসম্ভোগ বা নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যভিচার ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতার সুবাদে সহিংসতা এবং আত্মহত্যার মাত্রা রাতারাতি তুঙ্গে উঠে। সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিস্টিকস এবং গান আর্কাইভের পরিসংখ্যান অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক বছরে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ১০.৪ শতাংশ থেকে লাফিয়ে ৩৫.২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিস্টিকস অনুসারে ২০২০ সালে পেন্ডামিকের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি ৪৫ হাজার ৯৭৯ জন আমেরিকান হতাশার করালগ্রাস থেকে চিরনিষ্কৃতির জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল।

সংস্থাটি আরও জানায় যে, প্রেমে বিচ্ছেদ, জীবনসঙ্গী-সঙ্গিনীর সাথে ছাড়াছাড়ি, বেকারত্ব, নেশার খরচ যোগাতে না পারা এবং অন্যান্য হতাশাজনিত কারণে ১২ লক্ষাধিক আমেরিকান আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। আর ২০২১ সালে পেন্ডামিকের নৃশংসতা ছাড়াও প্রত্যহ গড়ে ৩১৬ জন নিরপরাধ আমেরিকান অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর রিসার্চ ফ্রম নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির লানগোনের সিটি হেলথ ড্যাশবোর্ড এবং এভরিটাউন ফর গান সেইফটি শীর্ষক গান কন্ট্রোল অ্যাডভোকেসী অর্গানাইজেশনের উপপরিচালক মেগান ওটুলের বর্ণনানুসারে গত ১ দশকে আমেরিকার বড় বড় নগরীগুলোতে আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যা পূর্বের তুলনায় কমপক্ষে ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষকগণ বলছেন, সিটি এবং স্টেটগুলোর আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট নীতিমালার সাথে আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যার প্রবণতার গভীর যোগসূত্র রয়েছে। তাই গবেষকবৃন্দের পরামর্শ, যুুক্তরাষ্ট্রের নগর এবং স্টেটগুলোতে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা কমানোর মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যা সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রথমত স্থানীয় পর্যায়ে কঠোর আগ্নেয়াস্ত্র আইন প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র ক্রেতাদের অতীত ইতিহাস যাচাই-বাছাই করতে হবে। নগরীর বিচ্ছিন্ন এলাকার স্থানগুলোতে সর্বসাধারণের চলাচলের উপযোগী রাস্তাঘাট তৈরি করে নির্জনতার অভিশাপ থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে হবে। সর্বসাধারণের জীবনে ধর্মীয় এবং পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে হবে। তাই সামগ্রিক বিবেচনায় পাপের প্রায়শ্চিত্ত অবধারিত বললে সম্ভবত অত্যুক্তি হবেনা।
লেখক: সহযোগি সম্পাদক, সাপ্তাহিক ঠিকানা, নিউইয়র্ক।