ইসরাত জেবিন:
When your goal is to make a meaningful impact in the world, you usually think less about yourself and your status, but focus more on the elements that will truly make a difference.
(যে পৃথিবীকে বদলে দিতে চায়, সে নিজেকে নিয়ে ভাবে না। সে তার কাজ নিয়ে ভাবে যার মাধ্যমে সে পৃথিবীকে ভালো কিছু দিতে পারবে)- ওমর ইশরাক।
ইনটেল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ওমর ইশরাকের এই কথাটিই ইঙ্গিত দেয় তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের। ২০২২ সালে ইনটেল এর চেয়ারম্যান অ্যান্ডি ব্রায়ান্ট তার পদত্যাগের ঘোষণা দিলে তার স্থলাভিষিক্ত হন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ওমর ইশরাক। ২০১৭ সালের মার্চে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগে তিনি দীর্ঘদিন ইনটেলের নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে তার দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেন। করোনার এই বৈশ্বিক মহামারিতেও পৃথিবীজুড়ে যখন ভেন্টিলেটর সংকট চলছে তখন তিনি এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে ভেন্টিলেটর তৈরিতে সহায়তা করতে। উন্মুক্ত করে দিয়েছেন ভেন্টিলেটর ডিজাইন। উচ্চ প্রযুক্তির মেডিক্যাল ডিভাইসের পেটেন্ট, সফটওয়্যার, সোর্সকোর্ডসহ দিয়েছেন সব ধরনের সাহায্য। এ বিষয়ে তিনি যে ফাইল শেয়ার করেছেন তাতে বলা আছে এই ডিজাইন এর মাধ্যমে যেকোনো প্রতিষ্ঠান, স্টার্ট আপ এমন কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুব সহজেই তৈরি করতে পারবে ভেন্টিলেটর যা দিয়ে শিশু এবং বৃদ্ধদের অক্সিজেন দেয়া যাবে সহজেই।

ওমর ইশরাকের জন্ম ১৯৫৫ সালে, বাংলাদেশে। লেখাপড়ায় হাতেখড়িও এদেশে। বাংলাদেশের এক সচ্ছল পরিবারে বেড়ে উঠা ওমর পরবর্তীতে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ব্যাচেলর অফ সাইন্স ডিগ্রি এবং পি এইচ ডি করেন লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে।
ওমর ইশরাকের কর্মজীবন শুরু করেন ফিলিপ আলট্রাসাউ- এ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। এরপর তিনি সিলিকন ভ্যালিতে উরধংড়হরপং এ যোগ দেন। দীর্ঘ সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করার মাধ্যমে টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এবং প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট এর উপর যে দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেন, General Electric (GE) এর সাথে কাজ করার সময় সেই অভিজ্ঞতাকেই তিনি কাজে লাগান।

‘পেশাগত জীবনের প্রথম থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল ভালো কিছু করা যা আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়াও অনেক কিছু শিখিয়েছে, কারণ ভালো কিছু করতে চাইলে শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং এ আটকে থাকলে চলবে না। বুঝতে হবে ক্রেতা কি চায়, কোন জিনিসের কি ব্যবহার এবং জানতে হবে কিভাবে ব্যবসার পরিধি বাড়ানো যায়।’ ওমর ইশরাক তাঁর কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে এই বিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরে চলেছেন তাঁর সফলতাই এর প্রমাণ। General Electric এর তৎকালীন সিইও Jack Welch এবং কার্যনির্বাহী কর্মকর্তাগণ যখন ওমর ইশরাক কে নিয়োগ দেয় তখন তার মেধা দেখে বাজি ধরে বলেছিল সে এই ব্যবসায় সম্পূর্ণ নতুন হলেও এই ব্যবসাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। তার উপর আস্থা রেখে সেসময় General Electric এর আলট্রাসাউন্ড ব্যবসাকে বিশ্বের এক নম্বর লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাকে। তাদের সেই ভবিষ্যতবাণী সত্যি করে এবং ভরসার মুল্য রেখে ১৬ বছরে GE Healthcare Systems এর আলট্রাসাউন্ড ব্যবসাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। ‘আমি সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নিয়ে ভাবিনি। আমি নিজেই নিজেকে বুঝিয়েছি আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব’- নিজের প্রতি তার এই বিশ্বাস এর প্রমাণস্বরূপ GE Healthcare Systems আলট্রাসাউন্ড ব্যবসা প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে এখন এক সফল ব্যবসার নাম। তার হাত ধরেই General Electric বাজারে আনে পোর্টেবল আলট্রাসাউন্ড প্রোডাক্ট যা বিশ্ববাজারে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৯৯৬ সালে প্রায় শুণ্যের কাছাকাছি থাকা এই ব্যবসা ২০০০ সালে এসে একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয় ওমর ইশরাকের কঠোর পরিশ্রম এবং বুদ্ধিমত্তার জোরে। ১৬ বছরে তার প্রচেষ্টায় GE Healthcare Systems এর মূল্য দাঁড়ায় ১২ বিলিয়ন ডলার। এই সময়টা তিনি দু’হাত ভরে শুধু সেই কোম্পানিকে দিয়েই যাননি, শিখেছেন অনেক কিছু। তিনি শিখেছেন টেকনোলোজিকে কিভাবে মানুষের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা যায়, চিকিৎসকদের সাথে কিভাবে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় এবং তাদের দেয়া তথ্যগুলো কিভাবে সাধারণ মানুষের কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি করা যায়।

২০১১ সালে তিনি Medtronic এ যোগ দেন চেয়ারম্যান এবং সিইও হিসেবে। Medtronic এ মূলত কাজ করেছেন Therapy innovation, Economic value এবং Globalisation নিয়ে। তার মূল লক্ষ্য ছিল রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে তাদের বিশ্বাস অর্জন, চিকিৎসা সেবার পরিধি বাড়ানো এবং তা সহজলভ্য করা। তার উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার আরও সহজ করা যেন অল্প অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যে কেউ এগুলো ব্যবহার করতে পারে এবং সল্প খরচে মানুষ এই সেবাগুলো নিতে পারে।
বিশ্বের এক নম্বর মেডিক্যাল কোম্পানি Medtronic, এর বাননো পেসমেকার, ইনসুলিন পাম্প, সার্জারির জিনিসপত্র এবং এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার এবং সার্ভিস থেকে এক বছরে আয় করে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৫০টি দেশে, ৮৬ হাজার কর্মী, ৯৬ হাজার বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ার এর তত্ত্বাবধানে চলে Medtronic এর বিশাল কর্মযজ্ঞ। আর এসব কিছু চলে যার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেই মানুষটি ইস্পাত কঠিন দৃঢ় হবে বলেই সবাই ধারণা করে।

কিন্তু বাস্তবে সেই ওমর ইশরাক অত্যন্ত ভদ্র এবং বিনয়ী। ছোটবেলায় পরিবার থেকে বিনয়, ভদ্রতা এবং নিরহঙ্কারী থাকার যে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন তাই পাথেয় করে চলছেন এখনো। এমনকি অমায়িক এই মানুষটি কখনই অন্য কোন কর্মকর্তা কিংবা কর্মীকে বুঝাতে চান না পদমর্যাদায় তিনি তাদের উপরে। Medtronic এর সিইও হওয়ার পরও এ নিয়ে কোন গর্ব ছিল না তার। খুব সহজ ভাবেই তিনি বলেছিলেন ‘সিইও হওয়ার কোন উচ্চাকাঙ্খা আমার ছিল না, কোনভাবে হয়ে গেছি।’
তার প্রচেষ্টাতেই ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী সারজিক্যাল প্রোডাক্ট প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারি Covidien অধিগ্রহণ করে Medtronic। আয়ারল্যান্ডে অবস্থিত Covidien এর সম্পত্তির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার। মেডিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে এটি সবচেয়ে বড় অধিগ্রহণ হিসেবে দেখা হয়।

সফল এই মানুষটি যখন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়বেন বলে মনস্থির করেন তখন কোন বড় পরিকল্পনা তার ছিল না। প্রযুক্তি তার ভালো লাগত এবং তিনি এ সম্পর্কে আরও জানতে চেয়েছিলেন, তাই এই বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত তিনি নেন। মেডিক্যাল টেকনোলোজি নিয়ে তার এত আগ্রহ ছিল যে একবার তিনি সমস্ত যুক্তরাষ্ট্র চষে বেড়িয়েছিলেন যেন যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আলট্রাসাউন্ড ইউনিট আছে সেগুলোতে যেতে পারেন এবং সেখানকার প্রফেসরদের সাথে কথা বলে তিনি তার থিসিস তৈরি করতে পারেন।

নিজের মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে পৃথিবী জয় করা এই সাদামাটা মানুষটি এখন ইনটেল এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এশিয়া সোসাইটির বোর্ড অফ ট্রাস্টির একজন সদস্য।
ব্যক্তিজীবনে তিনি বিবাহিত। প্রচারবিমুখ বলেই হয়ত তার পারিবারিক তথ্য তেমন ভাবে কখনোই প্রকাশিত হয়নি।