মো: রাসেল আহম্মেদ, লিসবন, পর্তুগাল
স্বাধীনতার পরপরেই বাংলাদেশের মানুষ জীবিকা নির্বাহের তাগিদে প্রবাসে আসতে শুরু করেছিল, বিশেষ করে ১৯৭৬ এর পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। কারণ সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের পক্ষে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান করা সম্ভব ছিল না। ৮০’র দশকের শেষ ভাগে এসে এর পালে গতি পেল অর্থাৎ বিপুল পরিমাণে মানুষ বিদেশ যেতে আরম্ভ করলো। বিগত চল্লিশ বছরে যা এখন প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষের ঘরে পৌছেছে এবং প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমরা প্রবাসীরা এখন বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠাই এবং তা দেশের মোট আয়ের প্রায় ১০ ভাগেরও বেশী! রেডিমেড গার্মেন্টসের পরে অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান সবচেয়ে বেশী অর্থাৎ দ্বিতীয় স্থান যা দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে রাখতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। প্রবাসীদের কারণে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাপে আছে এবং যার পরিমাপ প্রায় ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
গ্রামীণ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশী। দেশ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রদানকারী এসব প্রবাসীরা বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে। কারণ প্রবাসীদের সিংহভাগই নিজেদের উদ্যাগে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। যদিও সরকারি বেসরকারি কিছু প্রচেষ্টা ছিল কিন্তু তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। তাই সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে নিজ উদ্যাগে পাড়ি দিয়েছেন বিশ্বের নানান প্রান্তে। আর পরিবার পরিজনের মায়া ত্যাগ করে মাথার ঘাম পায়ে পেলে তৈরি করে যাচ্ছে নিজের ও দেশের বর্ণিল সোনালী ভবিষ্যৎ। কিন্তু এসব মানুষের অনেকের খুব তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্মুখীন হতে হয় বিদেশ পাড়ি দেওয়ার সময়। দেশী বিদেশী দালাল ও প্রতারকের কারণে অনেকে তাদের সহায় সম্বল হারিয়ে পথে বসে। তারপরেও তারা ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে এবং সংগ্রাম চালিয়ে যায় সোনালী আগামীর আশায়। আর এভাবে দাঁড়িয়ে যায় একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। কিন্তু যেসকল মানুষ এত কষ্ট করে দেশকে সামনে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তাদের প্রতি সরকার এখনো তেমন যতœবান বলে মনে হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র তেমন কোন বিশেষায়িত ব্যবস্থা নেয়নি প্রবাসীদের কল্যাণে যার মাধ্যমে তাদের পরিবারের সুরক্ষা করা যায়।
রাষ্ট্র সকল মানুষের কাজের নিশ্চয়তা দিতে পারলে কোন মানুষ প্রবাস নামক কারাগার বরণ করতো না। অনেকক্ষেত্রে আমরা দেখি প্রবাসে কারো মৃত্যু হলে তার লাশ পর্যন্ত দেশে ফেরত পাঠাতে অনেক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যা। দশজনের কাছ থেকে চাঁদা তুলে লাশের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়। একজন প্রবাসী হিসেবে যা অত্যন্ত লজ্জাকর, বেদনাদায়ক ও অনাকাংখীত। কারণ এ মানুষগুলো এত সংগ্রাম করলো নিজের ও দেশের জন্য অথচ রাষ্ট্র তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থাটুকু করতে পারলো না নিজ খরচে? অথবা যেসকল মানুষ বিদেশ আসতে প্রতারণার শিকার হচ্ছে তাদের সহযোগিতার জন্য অত্যন্ত একটি ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার পর্যন্ত খুলা গেল না?
টিভি রিপোর্টে দেখলাম ফিলিপাইন আমাদের অর্ধেক জনবল বিদেশ পাঠিয়ে আমাদের দুইগুনের বেশী প্রবাসী আয় ঘরে তুলছে। কারণ তারা গুরুত্ব দেয় দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর উপর আর আমরা এখনো আছি আগের মতই কানামাছি ভৌঁ ভৌঁ যারে পার তারে ছোঁ। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সরকারি উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে কিন্তু তা এখনো প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম তাই আরো বেশী সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে প্রবাসীরা দেশের উন্নয়নে আরো বেশী ভূমিকা রাখতে পারবে। এবং তা দক্ষ শ্রমিক গঠনে ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রবাসীদের ঘর বাড়ি নির্মাণে সরকারি ও বেসরকারি সহজ শর্তে তেমন কোন ব্যাংক সহযোগিতা এখনো পাওয়া যায় না। যারা দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে অথচ তাদের পরিবারের কল্যাণে সহজ শর্তে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই বললেই চলে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে প্রবাসীদের নিয়ে নানান অরুচিকর ও অসম্মানজনক কথা বার্তা বলতে শুনেছি। শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বোপরি প্রবাসীদের দেশে বিদেশে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবিক ও যোগপুযোগী উদ্যোগ নিতে পারলে দেশের অগ্রগতিতে আমরা প্রবাসীরা আরো ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবো। আশাকরি যথাযথ কর্তৃপক্ষ প্রবাসীদের কল্যাণে বিষয়সমূহ গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখবেন এমন প্রত্যাশা সকল প্রবাসীর।