মো: মাহ্ফুজুর রহমান
অনিশ্চিত এই জীবন। কিন্তু এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও একটা বিষয় তো নিশ্চিত। আর তা হলো মৃত্যু। পবিত্র কোরআনে আছে ‘প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’। জীবন ও মৃত্যু এ দুটোর মধ্যে কোনটা কঠিন? নানা জনের নানা মত। তবে জীবনে নানা রকম প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু, জীবনে সুখ ও আনন্দও তো আছে, এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই তো জীবন এত সুন্দর। মৃত্যু নয়।
আমাদের সামান্য কাটাকম্পাসে আমরা যাদের জীবন মাপতে পারি না, তাদের জীবন অসামান্য, তাদের মৃত্যুও অসামান্য। মৃত্যুর অভিজ্ঞতা মৃত্যু ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না। আর মানুষের সমস্যা হলো, মৃত্যুর পর কেউ মরণের গল্প বলার জন্য ফিরে আসে না। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক হিচকক শেষ মুহূর্ত সম্পর্কে বলেন- ‘শেষটা কেউই জানে না, মৃত্যুর পর কী অপেক্ষা করে আছে, তা জানতে সবাইকে মরতে হয়’।
মৃত্যু নিয়ে ২০১৫ সালে মার্কিন মুল্লুকে একটা জরিপ হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ মৃত্যুশয্যায় তাদের প্রিয়জনদের যেসব কথাবার্তা বলে যায়, তার মধ্যে বিরাট অংশই উপদেশমূলক। এসব উপদেশের মধ্যে তিনটি বিষয় গুরুত্ব পায়- পরিবার, শিক্ষা ও অর্থকড়ি।
মরার সময় অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলাপ পরামর্শ কেমন হীন কাজ মনে হলেও দুনিয়ার বড় মানুষদের বলা বিখ্যাত শেষ কথাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই আর্থিক ভাবনাজনিত। যেমন- বব মার্লের শেষ কথা ছিল- ‘অর্থ জীবনকে কিনতে পারে না’। আবার সক্রেটিস তার এক শিষ্যকে বলে গিয়েছিলেন, ‘সে যেন তার মোরগের ঋণ শোধ করে দেয়’।
মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা নিয়ে বুদ্ধ তার মৃত্যুশয্যায় শিষ্যদের উপদেশ দিয়ে গেছেন। মৃত্যুশয্যায় বুদ্ধ তার শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘জন্ম ও মৃত্যুর কারণ এক ও অভিন্ন। যার জন্ম আছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। একমাত্র মৃত্যুই চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। সুতরাং তোমরা সত্যের সাধনা করো। সত্যের পথে এগিয়ে চলো। ‘কিন্তু ক্রশবিদ্ধ যীশু নিজের অন্তিম সময়ে স্মরণ করেছিলেন ঈশ্বরকে। তার আর্তনাদ ছিল- ঈশ্বর, হে ঈশ্বর, কেন আমাকে ত্যাগ করেছো?
হেমলক পানের পর সক্রেটিস বুঝতে পারছিলেন, তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সক্রেটিসের শেষ কথাটি ইতিহাসখ্যাত, সবারই জানা। সাধারণ কথা কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে গিয়েছেন দায়িত্ববোধ আর আলোকবর্তিকা। শিষ্য ক্রিটোকে উদ্দেশ্য করে সক্রেটিস বলেছিলেন,- ‘ক্রিটো আমি এসফ্লেপিয়ারের কাছ থেকে একটা মোরগ এনেছিলাম, দয়া করে আমার এ ঋণ শোধ করতে ভুলে যেয়ো না’। সক্রেটিস ও তার মোরগের ঋণ নিয়ে সচেতন ছিলেন। মৃত্যুর আগে এ দার্শনিক জগতের লেনদেনকে ভুলে যাননি। এ ক্ষুদ্র ঋণ শোধের উদ্যোগই তাকে ব্যক্তি হিসেবে মহান করে রাখতে, শিক্ষক হিসেবে মর্যাদা দিতে যথেষ্ট।
লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি উদ্বিগ্ন ছিলেন তার কাজ নিয়ে। মৃত্যুর আগে এ উদ্বেগ চেপে রাখতে পারেননি। তার শেষ কথা ছিল, – ‘আমি ঈশ্বর ও মানুষকে ক্ষুদ্ধ করেছি, কারণ আমার কাজ যতটা ভালো হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি’।
মার্ক টোয়েন বলেছিলেন- ‘মৃত্যুই একমাত্র অমর, যে আমাদের সবার প্রতি একই আচরণ করে। কলুষিত কিংবা সাধু, ধনী কিংবা গরিব, প্রিয় বা অপ্রিয় সবাইকে মৃত্যু ছুঁয়ে যাবে’।
জার্মান সংগীতজ্ঞ বিটোফেন বলেছিলেন- ‘হাতাতালি দাও বন্ধুরা, এই প্রহসন এবার শেষ’।
মানুষের শেষ কথা নিয়ে কথা শেষ করা যায় কার্ল মার্কসের কথাটি দিয়ে। মৃত্যুর সময় পরিচারিকা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তার শেষ কথাটি কী? মার্কস বলেছিলেন, ‘শেষ কথা থাকে বোকাদের। সারা জীবনে যারা যথেষ্ট বলেননি’। মার্কস মানুষের জন্য কোন শেষ কথা রেখে যেতে চাননি। এ বিষয়টির প্রতীকী মূল্যও হয়তো আজকের দুনিয়ায় আছে, মার্কসবাদই হয়তো শেষ কথা নয়।
পরিশেষে এ কথা বলা যেতে পারে- মৃত্যু আমাদেরকে এক অন্তহীন জগতের দিকে নিয়ে যায়। এক হিমশীতল অনুভূতিহীন অথবা অনুভূতিশীল জগৎ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ, মানিকগঞ্জ।