ছিলেন শিক্ষকতা পেশায়। সেখান থেকে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। পরে ওই ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেই থেকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বেও সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। সম্প্রতি তার নামের পাশে নতুন পরিচয় যুক্ত হয়েছে। জুলাই-আগস্টে প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানে দায়িত্ব নিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকার বাথুয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার পিতা হাজী দুলা মিয়া সওদাগর ছিলেন একজন জহুরি এবং তার মাতা সুফিয়া খাতুন। তার শৈশব কাটে গ্রামে। ১৯৪৪ সালে তার পরিবার চট্টগ্রাম শহরে চলে আসে এবং তিনি তার গ্রামের স্কুল থেকে লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পূর্ব পাকিস্তানের ৩৯ হাজার ছাত্রের মধ্যে ১৬তম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন।
১৯৫৭ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিএ এবং এমএ পাশ করেন।
কর্মজীবন
স্নাতক শেষ করার পর প্রফেসর ইউনূস নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহানের অর্থনৈতিক গবেষণায় গবেষণা সহকারী হিসেবে অর্থনীতি ব্যুরোতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। একই সময়ে তিনি একটি লাভজনক প্যাকেজিং কারখানা স্থাপন করেন।
১৯৬৫ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পান। ১৯৭১ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মার্ফ্রিসবোরোতে মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক ছিলেন ইউনূস।
১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। এই সময়ের মধ্যেই ১৯৭৬ সালে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষুদ্রঋণের ধারণার মাধ্যমে সারাবিশ্বে একটি সাড়া ফেলে গ্রামীণ ব্যাংক।
জোবরা গ্রাম থেকে নোবেল জয়
চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামের সেই নবযুগ খামার থেকে প্রফেসর ইউনূসের হাত ধরে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠার থেকে শুরু হয় গ্রামীণ ব্যাংকের। যেখান থেকে ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এর কার্যক্রম। এখন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সেই সামাজিক ব্যবসা ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ‘রুরাল ইকোনমিক্স প্রোগ্রামের’ প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তখন জোবরা এবং সংলগ্ন গ্রামগুলোতে শুরু করেছিলেন একটি মাঠ গবেষণা, যেখানে তিনি যাচাই করতে চেয়েছিলেন সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষের মধ্যে ব্যাংক ঋণ সরবরাহের সম্ভাব্যতা। সেখানে শুরুতে তেভাগা পদ্ধতিতে কৃষকদের খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেন অধ্যাপক ইউনূস, যার নাম ছিল নবযুগ তেভাগা খামার। এই কৃষকদের খামার থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ভিত্তি রচিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে।
পরবর্তীতে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা নিয়ে বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিক জন্ম হয় গ্রামীণ ব্যাংকের। গ্রামীণ ব্যাংক মূলত ভূমিহীন ও দরিদ্র নারীদের পাঁচ জনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গঠনের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে এবং এ ঋণের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। গ্রামীণ ব্যাংকের এই কার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করলে ২০০৬ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন অধ্যাপক ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক।
অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান
গত কয়েক দশকে মুহাম্মদ ইউনূস দরিদ্র বাংলাদেশিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং ফোন পরিষেবা প্রদানসহ কয়েক ডজন সামাজিক কাজ করে আসছেন। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ শক্তিসহ ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ২৮ জুন তার জন্মদিনকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বৈশ্বিকভাবে ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এখন পর্যন্ত দারিদ্র্যদূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ বা সামাজিক ব্যবসার এই মডেল পৃথিবীর ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে।
বিশ্বের ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তার নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে তার চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তার জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণা হয়।
নোবেলজয়ী থেকে সরকারপ্রধান
গ্রামীণ ব্যাংককে সাথে নিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বেও সুনাম কুড়িয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। কিন্তু নিজ দেশেই গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ছিলেন কোণঠাসা। কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন নিজের প্রতিষ্ঠিত সেই গ্রামীণ ব্যাংকের।
নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় রাজনৈতিক দল গঠনের কার্যক্রম করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরাতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বেশ আলোচনায় ছিল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার পেছনে অধ্যাপক ইউনূসকে একজন মাস্টারমাইন্ড মনে করতেন শেখ হাসিনা।
এরপর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ব্যাংকের কর্তৃত্ব হারানোসহ বিভিন্ন মামলায় আদালতে বারবার হাজিরা দিতে হয়েছে অধ্যাপক ইউনূসকে।
চলতি বছরের ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়। এসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মুহাম্মদ ইউনূসকে বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে প্রস্তাব করে। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন এতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তাকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৮ আগস্ট ২০২৪ তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন।
অন্যান্য সম্মাননা ও অ্যাওয়ার্ড
ড. ইউনূসের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা
অর্থনীতির পরিসর ছাড়াও নানা ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের সম্মাননা পাওয়ার নজির রয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিযোগিতা অলিম্পিক গেমসের ২০২০ সালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সম্মানিত মেহমান ছিলেন প্রফেসর ইউনূস। ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকের মূল থিমও করা হয়েছে প্রফেসর ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে।
ড. ইউনূসে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার, ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং ২০১০ সালে কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পান।
এছাড়া ১৯৭৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ড. ইউনূস জাতীয় ও আন্তর্জাতিকসহ প্রায় ১৪৫টি পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে র্যামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার (১৯৮৪), কেন্দ্রীয় ব্যাংক অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৫), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮৭), আগা খান অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৯), বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৪), ফিফার শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৪), আন্তর্জাতিক সাইমন বলিভার পুরস্কার (১৯৯৬), হেল্প ফর সেলফ হেল্প পুরস্কার, নরওয়ে (১৯৯৭), শান্তি মানব পুরস্কার (ম্যান ফর পিস অ্যাওয়ার্ড), ইতালি পুরস্কার (১৯৯৭), বিশ্ব ফোরাম পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৭), সিডনি শান্তি পুরস্কার, অস্ট্রেলিয়া (১৯৯৮), ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার, ইন্ডিয়া (১৯৯৮) ইত্যাদি।