সিকদার গিয়াসউদ্দিন:
উপক্রমনিকা:
সিরাজুল আলম খান এখন অনন্তলোকে। তিনি বাংলাদেশের জন্মের ও জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য প্রকাশ্য কিংবদন্তী। ছিলেন নিভৃতচারী। নীরবে কাজ করেছেন আর তা বাস্তবায়ন করতেই জীবন যৌবন সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন। নীরবে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য সশরীরে হারিয়ে গেলেন। তবে এই কিংবদন্তীর সমগ্র জীবন যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন তাঁর কীর্তি অমর অব্যয় ও অক্ষয় থেকে যাবে। ইতিমধ্যেই তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সকালের আলোর আভার মত তা উদ্ভাসিত হতে দেখা যায়। আলোয় আলোয় তা চতুর্দিকে প্রস্ফুটিত হচ্ছে।
অখন্ড ভারতবর্ষে নেতাজী সুভাষ বোসকে নিয়ে নানা ধরণের মিথ ও কাহিনী আগে ও এখনও প্রচলিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে- বিশেষ করে জাসদ প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে সিরাজুল আলম খান (দাদা) কে নিয়েও কাল্পনিক, রহস্যপুরুষ নানা নামে অভিহিত করে বিভিন্ন মিথ ও কাহিনী, আলোচনা সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। অবশ্য নেতাজী সুভাষ বোসের সংগ্রামী জীবনধারার আলোকে সিরাজুল আলম খানের বিপ্লবী কর্মকান্ডের খতিয়ান বা একটা মিল সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় ও বুঝতে পারা যায়। তবুও পেন্ডোরা’র বাক্স খোলার জন্য সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে মিথ, আলোচনা সমালোচনা অব্যাহত থাকবে বলে বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞমহল অভিমত প্রকাশ করেছেন। যদিও তিনি এসবের অনেক উর্ধ্বে এখন আকাশের তারায় তারায় বিচরণ করছেন।
মৃত্যু–সোশ্যাল মিডিয়া, অন্যান্য গণমাধ্যম:
অসুস্থ অবস্থায় শেষবারের মত শমরিতা হাসপাতালে অবস্থানকালীন সময় থেকে ভক্ত, শিষ্য, শুভাকাঙ্খী এমনকি অন্যান্য মত ও পথের লোকজনদের সিরাজুল আলম খানের আশু রোগমুক্তি সহ বিভিন্ন লেখা ১৯৭১ সাল পরবর্তী প্রজন্মের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। মৃত্যুর দিন থেকে তা দস্তুরমতো সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় তুফানের মত সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। পত্র-পত্রিকাগুলোর সীমাবদ্ধতার কথা শোনা গেলেও বড় বড় হেডলাইন না হলেও মৃত্যুর পরপরই তার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত, নানাভাবে সংবাদ প্রচার, বিভিন্ন মত ও পথের লিখিত কলামগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বুঝতে পারার মতো। তবুও যতটুকু বাজারে ফুলঝুরি ছড়িয়ে বাজারজাত বা প্রচার করা হয়েছে তাও কম কি! ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও পটভূমি তৈরীর জন্য তা যথেষ্ট বটে- যেভাবে ৬ দফার মাঝে এক দফা বা স্বাধীনতার ভ্রুণ আবিস্কার করেছিলেন সিরাজুল আলম খান।
মৃত্যু ও ১৯৭১ পরবর্তী প্রজন্ম:
১৯৭১ সাল থেকে বর্তমান কয়েকটি প্রজন্ম Sirajul Alam Khan (SAK) এর মৃত্যু পরবর্তীতে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য মাধ্যমে প্রচারিত ভাইরাল সংবাদের ভিত্তিতে অনেককে অবাক করে তুলেছে। সংশয় অথবা হতভম্ব হওয়ার মত অনেককে বিস্ময়াবিভূত করে দিয়েছে। কারণ কয়েকযুগের ব্যবধানে দ্বিমাত্রিক কনফিউজড ইতিহাসে এইসব প্রজন্ম বিভ্রান্ত বলে আগে ও পরে বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞমহলের অভিমত অনেকেরই জানার কথা। এখন এই ত্রিমাত্রিক ইতিহাস অনেকটা অবাক করার মতো। নতুন প্রজন্মের জন্য বিস্ময় সংশয় হতভম্ব হওয়ার মতো বটে। আর এখানেই নিহিত রয়েছে আগামী’র সন্তানদের মাধ্যমে ইতিহাসের সত্যিকার ঘটনা, চরিত্রগুলোর বিন্যাস নির্ধারণী প্রক্রিয়া।
স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের সাধারণ জনগণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই সিরাজুল আলম খানকে চিনেই না। নাম জানাতো দূরের কথা। সিরাজুল আলম খানকে কথায় কথায় সিরাজুল ইসলাম বলতে দেখা গেছে। আশ্চর্যের বিষয় বর্তমান প্রজন্মের একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেককেও অবাক হতে দেখা যায়। মৃত্যু পরবর্তী খবরের ঝড় তুফানের কল্যাণে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের চরিত্র এখন সত্য ও সুন্দরের পথে ধাবিত হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। আশাবাদ, সময়ের সুবাদে একসময় ইতিহাসে সত্যম শিবম সুন্দরমের স্থায়ী আসন তৈরী হয়ে যাবে। আবহমানকাল ধরে তার ব্যত্যয় ঘটেনি। SAK’য়ের মৃত্যু পরবর্তীতে যে প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত তাতে বর্তমান তরুণ ও যুবসমাজের মননে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের চরিত্র সম্পর্কে আগ্নেয়গিরির অকস্মাৎ অগ্নুৎপাতের মতই হৃদয়ে ধারণ ও এক ধরনের উত্তাপ তৈরী হওয়াটা স্বাভাবিক। যা জাতির সত্যিকার ইতিহাসের জন্য কল্যাণময় ও মঙ্গলবার্তা বহন করার মত। সত্য ও সুন্দরকে সমুদ্র মন্থন করে অমৃত আহরণের দায়িত্ব ও কর্তব্য যুগে যুগে আগামীর সন্তানদের মাধ্যমে সাধিত হয়ে আসছে- আসবে। সোজা সরল ভাষায় আগামীর সন্তানদের নিকট সিরাজুল আলম খানের নামকে ধামাচাপা দেয়ার অতীত ও বর্তমানের সকল অপচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। যা দিবালোকের মত স্পষ্ট অনুমান ও অনুভব করা যায়।
ভলতেয়ার, সিরাজুল আলম খান, ভিন্নমত ও পথ:
ফরাসী বিপ্লবের রাজনৈতিক দার্শনিক নেতা ছিলেন ভলতেয়ার। বিশিষ্ট প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর রহমান খান সহ অনেক বিজ্ঞজনদের ভাষায় SAK ছিলেন প্রখর মেধাসম্পন্ন নৈতিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞানের এক অভাবনীয় এনসাইক্লোপেডিয়ার মত সংস্করণ। অনেকেই তাকে রাজনৈতিক তাত্ত্বিক দার্শনিক নেতা হিসাবে অভিহিত করেন। প্রচুর ভিন্নমতও আছে। ভলতেয়ারের মত সিরাজুল আলম খান ভিন্নমত ও পথের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এজন্য জাসদ প্রতিষ্ঠাকাল সময় থেকে উনাকে অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। ভলতেয়ার অন্যের মত প্রকাশের জন্য নিজের জীবন বিসর্জনের কথা বলতেন। SAK’য়ের ঘনিষ্টজনেরা মনে করেন যে, তিনি অন্যের মত প্রকাশের অধিকার সম্পর্কে ছিলেন অসম্ভব রকমের উচ্চকিত। তিনি আলোচনা সমালোচনা বিতর্ক খুবই পছন্দ করতেন। এমনকি তিনি তাঁর নিন্দুকদেরও শুভাকাঙ্খী মনে করতেন। আওয়ামীলীগ বা কারো মুখে এখন বাকশাল শব্দটি শুনা যায়না। সুযোগ পেলেই আওয়ামী ঘরানার লোকদের বলতে শুনা যায় যে- জাসদ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরী করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রক্ত না শুকাতেই কারা ক্ষমতার মসনদে আরোহন করেছিল তা সর্বজনবিদিত। কথায় কথায় SAK’কে নিয়ে তস্কর ও মোসাহেব জাতীয় লোকজন তাচ্ছিল্য ও তির্যক কথাবার্তা শুনাতে পারলেই অনেকের শান্তি। তবে আওয়ামীলীগ বা এ ঘরানার মধ্যেও দাদার প্রচুর ভক্ত অনুরাগী আছে-যারা SAK’য়ের জন্য হৃদয়ে ভীষণ ভক্তি গোপনে লালন করেন। নিন্দুকদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে দাদা দেশে বিদেশের ভক্ত অনুরাগীদের প্রায়ই বলতেন- ‘কিছু লোক সমাজে থাকে যাদের চোখে শুধু নেতিবাচক দিকটা ফুটে ওঠে। তাদের তোমরা দোষ বা বকা দিও না। কারণ ভাল কোন কিছুর পেছনে ঐ নেতিবাচক জিনিসটা লেপটে থাকে।’ ভিন্নমতের নেতা নেত্রীদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে কথা বলতে সকলকে উজ্জীবিত করতেন। নিজের চিন্তাভাবনার পরিবর্তে ভিন্ন মত ও পথের লেখা তিনি পড়তে ভীষণ রকম পছন্দ করতেন। সম্ভবতঃ এই কারণেই তিনি ভিন্নমতের প্রতি অত্যন্ত সহনশীল ও অসম্ভব রকমের গুরুত্ব দিতেন। অবশ্য এসব কারণে কৌশলগত গণতান্ত্রিক পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্ট্র্যাটেজী বিনির্মাণে তা উনার পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক ছিল বলে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
পরিবারতন্ত্র ও গণতন্ত্রঃ SAK’য়ের অভিমত:
দেশে প্রবাসে বসবাসরত SAK’য়ের ভক্ত ও অনুরাগীদের মাধ্যমে যতটুকু জানা যায় তিনি পারিবারিক উত্তরাধিকারের রাজনীতি মোটেই পছন্দ করতেন না। এধরনের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক আচরণ, গণতন্ত্রের বিকাশ, শিষ্টাচার কথামালার ফানুষ মাত্র। এখানে নামে মাত্র আদর্শের কথা বলা হয়ে থাকে। সকল দলীয় ক্ষমতা প্রকারান্তরে একজনের হাতেই কুক্ষিগত থাকে। উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে অর্থ ও ক্ষমতাই আসল। উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে যোগ বিয়োগের ফলাফলে টাকা না থাকলে ত্যাগী কর্মী ও নেতারা অন্দরমহলে ঢুকতে বাধ্য হয়। কারণ ততদিনে চাটুকার, তস্কর, মোসাহেব, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ ও কায়েমী স্বার্থসংশ্লিষ্ট লোকজনের মিলনমেলায় পরিণত হয়ে বিত্তহীন ত্যাগী নেতা কর্মীদের জায়গা দখল করে নেয়। একমাত্র দলীয় প্রধানের আনুকুল্য ছাড়া তৃণমূলের কেউ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদেও পদায়ন হওয়ার নজির নেই। কর্তৃত্ববাদী উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে লুটপাটের সুযোগ থাকে। জবাবদিহিতাবিহীন এসব দলে সুযোগ সন্ধানীরা দলকে কব্জা করে। বিত্ত, অর্থ ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক এধরনের রাজনীতিতে তরুণ ও যুবসমাজ বিপদগামী হওয়ার অসংখ্য দুয়ার উন্মুক্ত থাকে। তাতে নৈতিকতা বিবর্জিত লাগামহীন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা দলের জন্যও দুঃসাধ্য হয়ে উঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে এর নজির ভুরি ভুরি। এধরনের আদর্শবিহীন রাজনীতিতে ভিন্নমত ও পথকে বন্ধ করে দেয়ার খেলা চলতে থাকে। মানুষের মনে ভিন্ন মত ও পথের প্রতি একধরনের ঘৃণা তৈরীর প্রচেষ্টা থাকে। জাতিকে বিভক্ত করে বিত্ত ও ক্ষমতার স্বাদ দীর্ঘস্থায়ী করার সম্ভাবনা থাকবেই। এধরনের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিতে দলীয় প্রধানের চতুর্দিক মৌমাছিরা নিয়ন্ত্রণ করে। উপদলীয় কোন্দল থাকে। মুখোশধারীরা লুকিয়ে থাকে। এসব দলে বাইরের শত্রুর দরকার হয় না। বিত্ত ও ক্ষমতার সুবাদে ঘরের শত্রুই বিভীষণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়- উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে পরিবারের সদস্য বা সম্পর্কিত লোকজনও দলের প্রতি জনগণের দূরত্ব তৈরীর জন্যও দায়ী হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না বলে SAK মনে করতেন। সোজা সরল বাংলায় চা দোকানের আড্ডায়ও এসব জানতে পারা যায় বলে তিনি মনে করেন। তিনি সকলকে জনগণের জন্য উত্তরাধিকারের রাজনীতির বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে আদর্শিক ও কর্মসূচি ভিত্তিক টেকসই রাজনীতিতে উৎসাহিত করেছেন। যথাসম্ভব বই, পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিন পড়তেও অনুপ্রাণিত করেছেন। রাজনীতিতে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও মেধার চর্চা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন।
সিরাজুল আলম খান– প্রচারণা ও প্রকাশনা:
SAK’কে নিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে মৃত্যু পরবর্তী সময়েও ইতিবাচক নেতিবাচক প্রচারণা কম হয়নি। রীতিমতো বিস্ময়কর। পত্র-পত্রিকা, বিভিন্ন গণমাধ্যমে সর্বোপরি সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যেভাবে আলোচনা-সমালোচনা, ইতিবাচক-নেতিবাচক লেখালেখির প্রতিযোগিতা হয়েছে- অন্য কাউকে নিয়ে হয়েছে কিনা বলা মুশকিল। মৃত্যু পরবর্তী সময়েও পেন্ডোরার বাক্স খোলার প্রতিযোগিতা থেমে নেই।
উল্লেখ্য, তিনি নিজে নির্দেশনা দিয়ে ছোট ছোট পুস্তিকাকারে ভক্ত অনুরাগীদের দিয়ে বিভিন্ন রাজনীতি সংশিষ্ট পুস্তিকা প্রকাশ করিয়েছেন।’ একুশ শতকে বাংলাদেশ’ নামক ভিডিও চিত্র সম্বলিত ডকুমেন্টারী, ‘বাঙালীর তৃতীয় জাগরণ’ নামের বই সহ জাতীয় কল্যাণে ১৪’ দফা প্রস্তাবাবলীকে অনেকেই স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ নামক পবিত্র রাষ্ট্রের সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ প্রেসক্রিপশন মনে করেন।
SAK’য়ের জীবদ্দশায় লন্ডনের ডা. গিয়াসউদ্দিন আহমদ ‘একুশ শতকের মহাজাগরণ, সিরাজুল আলম খান, দর্শন ও চিন্তাধারা’ নামে প্রথম গ্রন্থটি রচনা করেন। সেই সূচনা। ভক্ত ও অনুরাগীদের সম্পাদনায় সিরাজুল আলম খান, স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম ও আগামীর বাংলাদেশ’। পরবর্তীতে শামশুদ্দিন পেয়ারা লিখিত ‘আমি সিরাজুল আলম খান’ একটি রাজনৈতিক জীবনাল্লেখ্য অতঃপর মহিউদ্দিন আহমেদ রচিত ‘প্রতিনায়ক’। বইটির তথ্য সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে অনেকেরই আপত্তির কথা শুনা যায়। আগামীর দিনগুলোতেও SAK’কে নিয়ে অসংখ্য বই রচিত হবে। সিনেমা তৈরী, উপন্যাসও লিখিত হতে পারে। তবে আগামী জমানার সন্তান ও ঐতিহাসিকদের হাতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্বয়ে সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে গবেষণা হবে বলে বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞমহলের অভিমত। আগামীর প্রজন্ম সমুদ্র মন্থন করে অমৃত আহরণ করবে বলে অনেকেই জোর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আমাদের দেশে জীবিতাবস্থায় না হলেও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মহীয়ান করে তোলার নজির ভুরি ভুরি। ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সে সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ। তবে সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করে সময়।
সিরাজুল আলম খানের বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা ও অন্যান্য:
জানা যায় যে, সিরাজুল আলম খান প্রচুর পড়াশুনা করতেন। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বেও তা অব্যাহত ছিল। বিশ্বের যখনই যে দেশে বা শহরে গেছেন সে সব দেশ বা শহরের লাইব্রেরী পরিদর্শন করতেন। দেশে বিদেশের শুভাকাঙ্খী, অনুরাগী, শিষ্য ও ভক্তদের আগ্রহের বদৌলতে তিনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন।
২০১০ সালের পরে উনার শারীরিক জটিলতা ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে। একান্তই শুভাকাঙ্খী, ভক্ত ও শিষ্যদের আগ্রহ ও কল্যাণে তিনি লন্ডন, জার্মানী, ফ্রান্স, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, নিউইয়র্ক, টেক্সাস, সানফ্রান্সিকো, লস এঞ্জেলেসে বড় বড় ডাক্তারদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তাছাড়াও বড়মাপের ব্যয়বহুল সফল চিকিৎসা ও সার্জারী লন্ডন, সাইপ্রাস ও নিউইয়র্কে ভক্ত ও শিষ্যগণের আন্তরিক উদ্যোগের বিষয়টি পরিচিত মহল মাত্রই জানার কথা। এমনকি শেষবারের মত ডাক্তারের নিষেধ স্বত্ত্বেও নিউইয়র্ক থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্সে বাংলাদেশে যাওয়ার পথে হঠাৎ স্বাস্থ্যের অবনতি দেখা দিলে এমিরেটস কর্তৃপক্ষ তাঁকে দুবাইস্থ রয়েল হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রিলিজ দেয়ার সময় অর্থ দাবী করে বসে। একথা শুনা মাত্র অজানা অচেনা এক ভদ্রলোক সব অর্থ পরিশোধ করেন এবং উনার রিলিজের সকল প্রক্রিয়া সম্পাদন করেন। পরে জানা যায় যে, উনি চট্টগ্রামের দুবাইস্থ মাইজভান্ডারী’র প্রতিনিধি। পরবর্তীতে উক্ত প্রতিনিধি না চাইলেও মাইজভান্ডার নামের সাথে সংশ্লিষ্ট বিধায় তিনি তা পরিশোধ করেন।
প্রবাসে ও দেশের ভক্ত অনুরাগীগণ ছাড়াও সকলেই জানে যে, দেশমাতৃকার তরে নিজের জীবন যৌবন সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন। সিরাজুল আলম খান উনার বড় বোন মেহফিল আরা খানম (লকেট) ও ছোট বোন লুসি (ডাকনাম) কে অত্যন্ত ভালবাসতেন। বড়বোন যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন মায়ের মত করে ভাইকে আগলে রেখেছিলেন। ছোট বোন লুসি ওয়াশিংটন ডিসি’র কাছাকাছি কোন একটি অঙ্গরাজ্যে অবস্থানের কথা জানা যায়। বড় বোন মারা যাওয়ার পর তিনি মানসিকভাবে কষ্ট পেলেও উনার অভিমান ও কষ্টের বিষয়টি বুঝতে পারা বড় দায় বলে অনেকে মনে করেন। বড় বোনের মৃত্যুর পর তিনি ভাড়া বাসায় অত্যন্ত সাদামাটা চিরাচরিত সাধারণভাবে থাকার বিষয়টি অনেকের লেখায় প্রতিভাত।
দেশে বিদেশে সিরাজুল আলম খানের অসংখ্য ভক্ত, শিষ্য, অনুরাগী, শুভাকাঙ্খী সকলেই গভীরভাবে শোকাহত। ইউরোপ আমেরিকায় সিরাজুল আলম খানের বাবার বাড়ি বেগমগঞ্জ ও নানার বাড়ি কোম্পানীগঞ্জের প্রচুর লোকজন আছে। তারাও অতি শোকাহত। তবে শমরিতা হাসপাতালের পরিবর্তে ল্যাবএইড, ইউনাইটেড কিংবা এভারকেয়ারে কেন নেয়া হয়নি- প্রবাসে অনেককে বলতে দেখা গেছে। জীবন আর মৃত্যু আমাদের সকলের জন্যই অবধারিত। এই চরম সত্যটি আবহমানকালের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তর এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার তিনি। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে তাকে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর ও ডানহাত হিসাবে সবাই জানে। বঙ্গবন্ধু তৈরীতে বঙ্গবন্ধু’র নেতৃত্বকে সামনে রেখে সকল কর্মকান্ড পরিচালনার বিষয়টি সর্বজনবিদিত।
আগামী জমানার সন্তানদের নিকট এই কিংবদন্তি নতুন করে মহীয়ান হয়ে উঠবেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের ছাত্রদের গবেষণার বিষয় হবেন সেটি নিশ্চিত করে বলা যায়। মরেও এই কিংবদন্তি যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন অমর অব্যয় ও অক্ষয় হয়ে থাকবেন।
লেখক: লাস ভেগাস, নেভাদা, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।