শাহজাহান চঞ্চল, রিয়াদ, সৌদিআরব
বাংলাদেশি আমরা যারা প্রবাসে আছি, তাঁদের দেহের উপস্থিতি প্রবাসে বটে, কিন্তু মন প্রতিনিয়ত উড়ে যায় ধানসিঁড়ি নদীর তীরে। খুঁজে পেতে চায় চেনা সুর, প্রিয়মুখ, আপন উঠান। প্রবাসে এসে কি আমরা ভুলে যাই আমাদের আপন পরিমন্ডল ? আপন সংস্কৃতি? মোটেই নয়। বরং নতুন করে আমরা প্রেমে পড়ি স্বদেশের। বুকের বৈয়মে ভরে রাখতে চাই স্বদেশের প্রজাপতি রূপ।
স্বভাববশতই প্রবাসে একজন বাংলাদেশি অপর একজন বাংলাদেশির সান্নিধ্যে আনন্দ অনুভব করে। এই একই বাংলাদেশি আরো বেশী খুশি হয় যখন সে খুঁজে পায় নিজ এলাকার কোন ব্যক্তিকে। ক্রমান্বয়ে সে খুঁজে পেতে আগ্রহী হয় আপন থানা, জেলা কিংবা বিভাগের মানুষ। এরপর তাঁর মধ্যে কাজ করে বাংলাদেশের পরিমন্ডল। বিষয়টি এমন যেন বিন্দু থেকে সিন্ধুর দিকে যাত্রা। অথবা সিন্ধুতে অবগাহন করে বিন্দুর অনুসন্ধান।
বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। দুজন প্রবাসীর কথোপকথন থেকে ভাই আপনি কি বাংলাদেশি? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে প্রশ্ন কর্তা হয়তো ফের প্রশ্ন করতে পারে- বাংলাদেশের কোন জেলায় ? প্রশ্ন কর্তা আর উত্তরদাতা যদি কাকতালীয়ভাবে একই জেলার হয়ে যায়, এরপর হয়তো ইউনিয়ন, গ্রামের প্রশ্নও চলে আসবে। এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক প্রক্রিয়ার এই স্বাভাবিক ধারাকে স্বঃতসিদ্ধ প্রমাণ করতেই যেন প্রবাসে বাংলাদেশিরা গড়ে তোলে আঞ্চলিক সমিতি। এই আঞ্চলিক সমিতিগুলো মূলত গড়ে ওঠে কল্যাণধর্মী চিন্তা চেতনা থেকে।
আঞ্চলিক সমিতি গঠনের ঋণাত্বক দিকটির কথাও অনেকে যুক্তিসংগতভাবে উপস্থাপনের অবকাশ রাখেন। তাঁদের মতে এই আঞ্চলিক সমিতিগুলো সংকীর্ণ চেতনার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। যা সার্বিক অর্থে বাংলাদেশিদের মধ্যে আঞ্চলিক রেখা টেনে দেয়, ব্যাহত হয় বৃহৎ পরিসরের বাংলাদেশি চেতনা। তাঁদের ধারণায় প্রবাসে কোন আঞ্চলিক সমিতি নয়, গড়ে তোলা উচিত একটি বাংলাদেশ সমিতি। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের বাংলাদেশিদের অনেক পথ, অনেক মত। সব পথ এবং মতকে একটি মোহনায় এনে রাতারাতি একটি বাংলাদেশ সমিতি গঠন করা কষ্টকর। এর জন্য পূর্ব প্রস্তুতি দরকার। সেই প্রস্তুতির প্ল্যাটফর্ম হতে পারে আঞ্চলিক সমিতিগুলো। প্রাথমিক পর্যায়ে কল্যাণের চেতনায় সিক্ত আঞ্চলিক সমিতিগুলো নিজস্ব বলয়ে গড়ে তুলবে এমন এক আন্তরিক পরিবেশ যা বন্ধুত্ব এবং কল্যাণে হব নিবেদিত। আমরা যদি সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে জেনে নেই, সমিতি কি? এর বিস্তৃতিই বা কতটুকু ? তাহলে আমাদের আলোচনার বিষয়টি আরো সহজ হবে।
সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় সমাজের মানুষ সংঘবদ্ধভাবে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য যখন কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, তাকে সমিতি নামে আখ্যা দেয়া যেতে পারে। সমিতির কার্যাবলী কোন নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে আবার একাধিক এলাকায়ও বিস্তৃত হতে পারে। এমনকি বিশ্বব্যাপীও হতে পারে। নানা ধরণের জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্যে সমিতি গঠিত হয়।
বিভিন্ন প্রকার সমিতি প্রাচীনকাল হতেই সমাজ কল্যাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। কাজেই সমাজ কল্যাণের ক্ষেত্রে এবং সামাজিক যৌথ ক্রিয়াকলাপে সমিতির গুরুত্ব অপরিসীম। উল্লেখিত বক্তব্যের আলোকে দেখা যায় একটি সমিতির কার্যক্রম বৃহত্তর পরিসরের পাশাপাশি আঞ্চলিক পরিসরেও সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। অর্থাৎ সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আঞ্চলিক সমিতিগুলো কোন ঋণাত্বক ধারণা বহন করে না। বরং এমন ধারণা প্রতিভাশিত হয় যে, আঞ্চলিক সমিতিগুলো প্রয়োজনে পাঁপড়ি মেলতে পারে বৃহৎ পরিসরে।
আঞ্চলিক সমিতিগুলো প্রবাসে স্বাভাবিকভাবেই সচেষ্ট হয় নিজস্ব বলয়ে নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে। তারা আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতার ব্যাপ্তি বাড়ে। চর্চা হয় আপন সংস্কৃতির। যৌথ ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে করতে চায় সমাজ কল্যাণ। চিনে নিতে চায় নিজেদেরকে, নিজেদের মতো করে। যেতে যায় শিঁকড় সন্ধানে। আর নিজেদের শিঁকড় চেনা সম্ভব হলে অপরকে চেনা যায় সহজেই। মরমি সাধক লালন- এর কথায়, আপনারে চিনতে পারলে যায় অচেনারে চেনা।
বিভিন্ন আঞ্চলিক সমিতি নিজেদের পরিমন্ডল ছাড়িয়ে এক সময় অন্যসব আঞ্চলিক সমিতির সাথে গড়ে তোলতে পারে যৌথ ক্রিয়াকর্ম। পদ্মা মেঘনার জলের মতো পাশাপাশি চলতে চলতে সব আঞ্চলিক সমিতিগুলোর প্রতিনিধিত্বে গড়ে উঠতে পারে একটি বাংলাদেশ সমিতি। যার কাঠামো হবে মজবুত এবং দীর্ঘমেয়াদী। অন্তর থেকেই বলা যায় কল্যাণ চেতনার অনুপ্রয়াস প্রবাসে বাংলাদেশিদের আঞ্চলিক সমিতিগুলো আন্তরিক হলে মুছে দিতে পারবে নিজেদের সকল বিভক্তির রেখা।