মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত, রিয়াদ, সৌদিআরব:
আজকের তরুণরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সকল অন্যায়- অবিচার, বাঁধা-বিপত্তি ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠার উজ্জীবিত শক্তি হলো এই তরুণ প্রজন্ম। তরুণরাই পুরাতনকে ভেঙ্গে নতুনের স্বপ্ন দেখায়। বিশেষ করে তারুণ্যে ভরপুর এই বাংলাদেশ গঠনে তরুণ-যুবকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য ও প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ যখন ‘বাংলাদেশ’ হয়নি তখন থেকে আজ অবধি দেশের জন্য সকল আন্দোলন-সংগ্রামে তরুণ জনগোষ্ঠী মূখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।
৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৬-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলন এবং সর্বোপরি ২০২৪-এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে তরুণ-যুবকদের আত্মত্যাগ আর সাহসী ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রেরণার হাতিয়ার হয়ে থাকবে আজীবন।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ তরুণ। এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে কেননা যে কোন দেশ বা জাতির সাফল্য ও মহান অর্জন তার তরুণ প্রজন্মকে এড়িয়ে সম্ভব নয়। অদম্য তরুণরাই তাদের দূরন্তপনা, অসীম সাহস এবং নব-সৃষ্টির উদ্দীপনা নিয়ে যে কোন কঠিন বাঁধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করতে পারে তাই তরুণদেও শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি এবং সর্বোপরি সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দেশের যে কোন সমস্যায় ভূমিকা রাখার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশ জনবহুল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। প্রতিবছর বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশের মানুষ এবং সহায়-সম্পদ। তাছাড়াও বাংলাদেশ ভূ-প্রকৃতিগতভাবে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশে যদি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় তাহলে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হবে যা কল্পনা করাও দূরহ। দেশের অবকাঠামোগত অবস্থা, অপরিকল্পিত স্থাপনা এবং আয়তনের চাইতে জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, অপ্রশস্ত রাস্তা-ঘাট, প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মী ও আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতির অভাবে অধিকমাত্রার ভূমিকম্পে দেশের ধ্বংসযজ্ঞ কল্পনাকেও হার মানাতে পারে। শুধু তাই নয়, প্রতিবছর বিভিন্ন কল-কারখানায় অগ্নি-দুর্ঘটনার কারণেও প্রচুর প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় আমাদের।
এমতাবস্থায় আমাদের যদি একটি প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী থাকে তাহলে সেটি দেশের যে কোন দুর্যোগে নিয়মিত বাহিনী/ উদ্ধারকর্মীর সাথে কাজ করতে পারবে। তাই দেশের ব্যাপক তরুণ-যুব জনগোষ্ঠীকে সামরিক বা এর আদলে একটি সামগ্রিক প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা খুবই জরুরি। যদি আমরা বহির্বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, ব্রাজিল, ইসরাইল, ইরান, তুরস্ক, সিরিয়া, মিশর, কিউবা, সুইজারল্যান্ড, ইরিত্রিয়া ও সুইডেনসহ অনেক দেশেই তরুণদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। দেশ ভেদে নিয়ম-কানুনের ভিন্নতা থাকলেও ঐসব দেশের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রায় অভিন্ন। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতের নানানমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা বিবেচনায় নিয়ে দেশের সামরিক ভারসাম্য, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নাগরিকদের শৃঙ্খলা ও একটি সুস্বাস্থ্যকর জাতি গঠনের মানসে আমাদেরকেও ধীরে ধীরে তরুণ-যুব জনগোষ্ঠীকে সামরিক প্রশিক্ষণ অথবা সামরিক প্রশিক্ষণের আদলে একটি সামগ্রিক প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি মনে করছি। তাতে করে দেশের তরুণ-যুবকরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশ প্রতিরক্ষা, আত্মগঠন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা ও দেশপ্রেমের দীক্ষা পাবে। সাথে সাথে দেশের দুঃসময়ে দেশমাতৃকা রক্ষায় এবং সুস্থ ও বুদ্ধিদ্বীপ্ত তরুণ সমাজ গড়ে তুলতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে বর্তমান প্রযুক্তির উৎকর্ষতার প্লাবনে ’ডিজিটাল নেটিভ’ বা শিশুকাল থেকে ডিজিটাল ডিভাইসের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির কারণে তরুণ-যুবকরা যেভাবে অলস ও কর্মবিমূখ হয়ে পড়ছে তা থেকেও তাদের মন-মানসিকতাকে সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি হবে।
যে কোন প্রশিক্ষণ মানুষকে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, সাহস যোগায় এবং পরিস্থিতি মোকাবেলার দৃঢ় মানসিক শক্তির যোগান দেয়। সামরিক প্রশিক্ষণ বা সামরিক প্রশিক্ষণের আদলে অন্য যে কোন প্রশিক্ষণের আওতায় যদি আমাদের তরুণ সমাজকে নিয়ে আসা যায় তাহলে দেশের বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদকাসক্তির হাত থেকে রক্ষা করা সহজ হয়ে উঠবে, সম্মিলিতভাবে কোন কাজ করার মানসিকতা সৃষ্টি হবে, বাস্তবজীবনে দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে, যে কোন বিষয়ে বুদ্ধিদ্বীপ্ত ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তে গ্রহণে তারা সহায়ক হবে। পরের কল্যাণে বা যে কারো দুঃখ-দুর্দশায়, বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা সৃষ্টি হবে এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা-ধারার বিকাশ গড়বে। বিশেষ করে দেশের ব্যাপক তরুণ-যুবকরা যেভাবে নানান অপকর্মের সাথে জড়িত তা থেকে সরিয়ে আনার জন্য এরকম একটি প্রশিক্ষণ সত্যিই দারুণ ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে। আর দেশের মানুষ যে হারে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি বিশেষ করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে তা থেকে ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে শারীরিক প্রশিক্ষণ, জীবনযাপন পদ্ধতি এবং খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে এবং সেটি সম্ভব হবে যদি দেশের এই ব্যাপক তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা যায়। আমরা যদি আমাদের তরুণদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সবল, সুস্থ ও উন্নত চিন্তার প্রকৃত দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেব গড়ে তুলতে পারি তাহলে যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায়ও আমরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে পারি। দেশের সামরিক, আধা-সামরিক এবং অন্যান্য প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মীর সাথে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত আমাদের তরুণরা যদি একসাথে কাজ করে তাহলে ভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিদুর্ঘটনা বা অতিমারি-মহামারিসহ যে কোন দূর্যোগ-দুর্দাশায় জান-মালের ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের মতো জনবহুল এবং উন্নয়নশীল দেশে তরুণ-যুবকদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বা সামরিক প্রশিক্ষণের আদলে একটি ‘সামগ্রিক প্রশিক্ষণ’ বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব? প্রতিবছর লাখ- লাখ তরুণদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে গেলে যে পরিমাণ অর্থ, প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রশিক্ষক দরকার তা আমাদের এই মুহূর্তে নেই। তবে এখন থেকে যদি পরিকল্পনা নিয়ে আগানো যায় তাহলে অসম্ভব কোন ব্যাপার নয়। সরকার যদি চায় তাহলে যে কোন বিষয় বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বিষয়টি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও বিগত সরকারগুলো এবং তাদের দোসররা যে পরিমাণ অর্থ লোপাট করেছে তার চাইতে বেশি হবে না। দরকার একটি সুন্দর পরিকল্পনা আর দৃঢ় সিদ্ধান্ত। সরকার যদি চায় সরাসরি ’প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়’ বা ’যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়’র মাধ্যমে এমন উদ্যোগ নিতে পারে অথবা সামরিক বাহিনীর বর্তমান/অবসরপ্রাপ্ত অফিসার এবং বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে পারে। আমাদের সীমিত সম্পদ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কয়েকটি প্রস্তাবনা উল্লেখ করছি।
- প্রশিক্ষণের জন্য একটি উপযুক্ত বয়সসীমা নির্ধারণ করা। হতে পারে সেটি ১৮ বছর বা কম-বেশি। এক্ষেত্রে সকলের জন্য প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক না করে প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র যারা আগ্রহী এবং প্রযোজনীয় যোগ্যতায় উত্তীর্ণ সেসব তরুণদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা।
- প্রশিক্ষণের মেয়াদ কাল ৬-৯ মাস এবং প্রশিক্ষণ শেষে ৩ মাস সামরিক/আধা সামরিক বাহিনীতে সেবা প্রদানের ব্যবস্থা রাখা।
- প্রশিক্ষণকালীন সকল খরচ সরকার বহন করবে এবং প্রশিক্ষণ শেষে সামরিক/আধা সামরিক বাহিনীতে সেবা দেয়ার সময় সম্মানি প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- এই প্রশিক্ষণ শেষে প্রাপ্ত সনদ জীবনের উচ্চতর শিক্ষা-গবেষণা, চাকরি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনায় রাখতে হবে তাহলে দেশের সকল তরুণ-যুবকরা আগ্রহী হবে প্রশিক্ষণ নিতে।
- বিভিন্ন ধরনের কর্মমুখী শিক্ষা (স্বপ্ল মেয়াদী) এই প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত করা যায় যাতে করে যারা উচ্চতর পড়াশোনা করতে পারবে না তারা কর্মমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যে কোন চাকরি বা নিজস্ব ক্ষুদ্র কোন ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হতে পারে এবং প্রবাসে যেতে ইচ্ছুকরা বিদেশে গিয়ে সহজে কাজ পায় ও দক্ষ শ্রমিক হিসেবে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে পারে।
মোট কথা, আমাদের তরুণ-যুবকদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযুক্ত মানবসম্পদে পরিণত করা, দেশেপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ করা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের উপর হুমকি আসলে সামরিক বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশরক্ষায় যেন আত্মনিয়োগ করতে পারে সেই শারীরিক যোগ্যতা ও মানসিকতা সৃষ্টি করা খুবই প্রয়োজন। তরুণদের যদি যৌবনের প্রথম ধাপে এই রকম একটি প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যায় তাহলে প্রতিটি নাগরিক দেশের জন্য সম্পদে পরিণত হবে এবং প্রকৃত অর্থেই প্রিয় মাতৃভূমি সোনার বাংলা হয়ে উঠবে এবং পৃথিবীর বুকে সভ্যজাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।