মার্ক লিওনার্ড, ডাভোস, সুইজারল্যান্ড:
জ্বালানীশক্তি এবং প্রযুক্তিতে দ্রুতগতির পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব ‘বিশ্বায়ন বিমুখিনতা’ নয় বরং ‘পুনঃ-বিশ্বায়ন’ এর দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে এই ধারণাটির পক্ষে ক্রমবর্ধমান হারে সমর্থনও তৈরি হয়েছে। তবুও, গুরুত্ব বিবেচনায় বিশ্বায়নের পরবর্তী তরঙ্গ সর্বশেষ বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্যকে ছাড়িয়ে যাবে।
বিশ্বায়ন কি আবার মানুষের জীবনে ফিরে আসছে? ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় এটাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যেখানে ডব্লিউইএফ এর প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াব জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে বিভক্ততার এ যুগে সহযোগিতা করা সম্ভব কিনা। গত কয়েক দশক ধরে, বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে বিশ্বজনীন অবতার ‘দাভোস ম্যান’ খ্যাত সুপার ক্লাসের সুদৃঢ় অস্তিত্ব একটা বড় গল্প তৈরি করেছিলো। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট, ব্রেক্সিট, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন, বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ, কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের মতো সংকটগুলো বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। সবগুলি লক্ষণ বিবেচনায় ধারণা করা হয়েছিলো যে বিশ্বায়ন অনেক দূরে চলে গেছে এবং এটি বিপরীত দিকে ধাবিত হবে।

কিন্তু ডব্লিউইএফ এর এই বছরের বৈঠকে সবার মনোভাব কিছুটা বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছে। সংঘাত এবং অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের বিষয়ে অনেক উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও, মে মাসে যখন তারা শেষবার একত্রিত হয়েছিলো তখন বিশ্বের অভিজাতদের প্রত্যাশার চেয়ে বিশ্ব কিছুটা ভাল অবস্থানে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ইউক্রেনীয়রা বীরত্বের সাথে রুশ আক্রমণকারীদের প্রতিহত করছে, পশ্চিমারা একজোট হয়েছে, ইউরোপ এই শীতে আলো জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছে এবং কেউ কেউ মনে করে আমরা এখনও মন্দা এড়াতে পারি।

তদুপরি, এই গুরুত্বপূর্ণ স্বল্পমেয়াদী উন্নয়নগুলোর অন্তরালে বিশ্বায়নের এ নতুন রূপ আরও গভীর পরিবর্তনের সুচনা করবে এবং এটি আগের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। যেহেতু পণ্যের বিশ্বায়ন শীর্ষে পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে এবং মহামারী চলাকালীন ভার্চুয়াল যোগাযোগের বিপ্লবের কারণে পরিষেবাগুলিও আরও বিশ্বায়ীত হবে।
ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে আংশিকভাবে চালিত জ্বালানী খাতেও দ্রুতগতিতে পরিবর্তন এসেছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেইন এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ সোলজ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে নবায়নযোগ্য জ¦ালানী এবং হাইড্রোজেন শক্তির ব্যাপক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের মতো তাৎপর্যপূর্ণ হবে। একই সময়ে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি বিশাল নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। পাশাপাশি মাইক্রোচিপস নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে এবং রোবট উন্নয়নের কারণে বেকারত্ব নিয়ে নতুন করে ভয় তৈরি করছে।

ভার্চুয়াল যোগাযোগ, পুনঃবীকরণযোগ্য জ্বালানী এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও)- এ তিনটি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নয়ন বিশ্বের দেশগুলিকে পরস্পর নির্ভরতার নতুন নেটওয়ার্কে একত্রে আবদ্ধ করবে। সাম্প্রতিক ম্যাককিনস গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বিশ্বের কোন দেশ বা অঞ্চল এককভাবে আর স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে না।’
কিন্তু দাভোসে যে পুনঃবিশ্বায়নের ঝলক দেখা গেছে তা পূর্ববর্তীর পুনরাবৃত্তি নয় বরং মৌলিকভাবে ভিন্ন হবে। কারণ, পুরানো মডেলটি কর্পোরেট মুনাফার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়েছিলো। কিন্তু নতুন বিশ্বায়ন সকল ক্ষেত্রে দেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পরিচালিত হবে।

পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের যুদ্ধকে রাশিয়ার একতরফা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাদের উদার, নিয়মভিত্তিক আদেশের প্রতিরক্ষা হিসাবে চিত্রিত করেছে। তাই তারা রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চীনের সাথে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে ব্যস্ত। দাভোসে, কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ছিলেন অনেক নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একজন যিনি ‘বন্ধুত্ব মূলক সমর্থন’ এর প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন।

কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের বাইরের অনেকের কাছে রাশিয়া এবং চীনের মতোই ইউরোপ এবং আমেরিকা বিশ্বব্যবস্থাকে ব্যাহত করার জন্য দায়ী; তারা তাদের নিজেদের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য বিশ্বে বিরাট সংকট সৃষ্টি করে। দেশগুলো মনে করে, পশ্চিমারা যুদ্ধকে অর্থনৈতিক সংঘাতে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং (ইতিহাসের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী এবং সুদূরপ্রসারী নিষেধাজ্ঞা আরপের মাধ্যমে) বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনছে।

দাভোসের সুখকর দিনগুলিতে ফিরে তাকালে দেখা যায়, আগে ডলার-ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থাকে একটি বিশ্বজনীন ভালো উপায় হিসাবে দেখা হয়েছিল যা বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে সমৃদ্ধি ছড়িয়ে দেবে। কিন্তু এখন এটিকে ক্রমবর্ধমানভাবে একটি ছলনা হিসাবে দেখা হচ্ছে যার সাহায্যে আমেরিকা তার আদর্শিক এবং কৌশলগত পছন্দগুলি প্রয়োগ করতে পারে। একারণে অনেকেই মনে করে, রাশিয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এবং ইরান ও উত্তর কোরিয়াতে পারমাণবিক বিস্তারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে গৃহীত পশ্চিমা নীতিগুলোর একই প্যাটার্ন অনুসরণ করে পরিচালিত হয়েছে।
যেমন ২০১৪ সালে ফরাসী ব্যাংক বিএনপি পারিবাস এমন একটি অভিজ্ঞতা পেয়েছিল যখন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের কারণে ব্যাংকটিকে ৮ বিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়েছিল। এই ধরনের নীতিগুলো বিশ্বব্যাপী একটি ফাঁদ পাতা দৈত্যে পরিণত হয়েছে যার কার্যকারিতা বৈশ্বিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ রাজনীতিকীকরণের উপর নির্ভর করে; যেগুলো পূর্বে নিরপেক্ষ হিসাবে বিবেচিত হতো।

এখন ওই দৈত্যকে বোতল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, অন্যরাও নিয়ম এবং আদর্শের নামে বৈশ্বিক কাঠামোর রাজনীতিকীকরণ করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন আমদানির উপর একটি নতুন কার্বন শুল্ক আরোপের চিন্তা করছে এবং এটি ইতিমধ্যেই তার নাগরিকদের তথ্য উপাত্ত নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে তা ইইউ’র সীমানার বাইরে সংরক্ষণ করা না যায়।
এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। তারা চীনের কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাত্রা দ্বিগুণ করেছে। ফলাফল কেবল জ্ঞানের স্ফুলিঙ্গ দেখানো নয়। সব দেশই এখন পরস্পর নির্ভরশীলতার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে তাদের সুরক্ষার মাত্রা বৃদ্ধি করছে।
আরেকটি প্রবণতা দেখা দেবে যা বিশ্বায়নের পরবর্তী যুগকে আগেরটি থেকে আলাদা করবে এবং তা আরও বেশি ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হতে পারে। ব্রিটেন এবং আমেরিকা বিশ্বায়নের প্রথম দুটি তরঙ্গের কেন্দ্রে অবস্থান করেছিলো। কিন্তু এই নতুন বিশ্বায়নটি হবে বহুমুখী এবং বহু-মতাদর্শিক। চীন শুধু আমেরিকার সাথে অর্থনৈতিক ব্যবধানই কমায়নি, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কাছে সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হিসেবেও আমেরিকাকে ছাড়িয়ে গেছে। এটি এখন অর্থনৈতিক শক্তির ভারসাম্যের একটি বড় পরিবর্তন মনে করা হয়।
এই নতুন বিশ্বায়নের গতিশীলতা এমন ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্ব শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদ দ্বারা নয় বরং নীতির প্রশ্নে মৌলিকভাবে বিশ্ব ভিন্ন ধারণা দ্বারা বিভক্ত হবে। দাভোসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বক্তব্য শুনে অংশগ্রহণকারীরা এর একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত পেয়েছেন। জেলেনস্কি তার বক্তৃতায় রাশিয়ার অপ্রীতিকর যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বকে সমাবেশ করার আহ্বান জানান। তার বক্তৃতার সময় অর্ধেক শ্রোতা উৎসাহের সাথে উল্লাস করলেও বাকি অর্ধেক নিশ্চুপ ছিলেন। অনেকে ইউক্রেনীয়দের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করছেন। কিন্তু অনেকেই ভয় প্রকাশ করেছেন এই ভেবে যে, এই সংঘাতের ফলে দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ শুরু হবে যা বিশ্বকে গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারে বিভক্ত করবে।
অনেকেরই ধারণা, অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা এটাই চান। ব্যক্তিগত আলোচনায়, আফ্রিকান, মধ্যপ্রাচ্য এবং লাতিন আমেরিকান নেতারা অভিযোগ করেন যে, প্রথম শীতল যুদ্ধের সময় তাদের দেশগুলি ইতিমধ্যেই সার্বভৌমত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আবারও পক্ষ বাছাই করলে তাদের জন্য লাভের কিছু থাকবে না।
এমনকি আমেরিকার অনেক মিত্ররাও নির্বাচন করার বিপক্ষে। আমি একজন জাপানি টাইকুনের সাথে কথা বলেছি, যিনি চীনের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে খুব চিন্তিত কিন্তু তিনি বিভক্ততার তীব্র বিরোধী। আবার সম্মেলনে ওলাফ সোলজ তার নিজের বক্তৃতায় ঘোষণা করেছিলেন যে ২০৪৫ সালের বিশ্ব দ্বিমেরু নয় বরং বহুমেরুতে রূপ নেবে।
পরিশেষে, আমাদের বিভক্ততার এই সময়ে ক্লাউস শোয়াবের সহযোগিতার আশা করা সঠিক বলে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে কিভাবে পরবর্তী বিশ্বায়ন পূর্বের বিশ্বায়ন থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন হবে।
মার্ক লিওনার্ড:
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের পরিচালক, ‘দ্য এজ অফ আনপিস: হাউ কানেক্টিভিটি কজেস কনফ্লিক্ট’ বইয়ের লেখক।
স্বত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: শহীদ রাজু।