ইসরাত জেবিন:
সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর উড়াল দেন অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায়। সময়টা ছিল ২০১২ সাল। সেখানে ইউনিভার্সিটি অব ক্যানবেরায় ব্যাচেলরস ইন ইনফরমেশন টেকনোলজিতে ভর্তি হয়ে স্নাতক শেষ করেন। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশি এই তরুণীর অভিষেক হয় বলিউডের চলচ্চিত্রে। বলছিলাম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক অভিনেত্রী এবং মডেল সাদিয়া আন্দালিব নাবিলার কথা। যিনি নাবিলা নামে বেশি পরিচিত। প্রবাস মেলা’র এবারের সংখ্যায় প্রবাসী আইডলে তাকে নিয়ে আমাদের আয়োজন।

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল মতিনের মেয়ে নাবিলার জন্ম সৈয়দপুরে। নাচ, গান আর অভিনয়ের পোকাটা নাকি মাথায় আগে থেকেই ছিল এদেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা নাবিলার। কিন্তু কোন মাধ্যমে নিজেকে স্থির করবেন, সে সিদ্ধান্ত তখনো নেননি। এরই মধ্যে ভাইয়ের ইচ্ছা আর বাবা-মায়ের চাওয়ায় পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠেন সাংস্কৃতিক পরিবেশে। মা-বাবার পূর্ণ সমর্থনে নাচ ও গানে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন স্কুলেই। ২০১৪ সালে যোগ দেন ক্যানবেরার ‘ভিক্টোরিয়াস মডেল এজেন্সি’তে। মডেল হিসেবে যাত্রা শুরু তখনই। একই বছরের শেষের দিকে ক্যানবেরা স্কুল অব বলিউড ড্যান্সিংয়ে (সিএসবিডি) নাচের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। নাবিলার এরপরের গল্পগুলো শুধুই এগিয়ে যাওয়ার।

এ বিষয়ে এক সাক্ষাতকারে নাবিলা বলেছেন, ‘আমার স্বপ্নের শুরু হতে পারতো ঢাকায়। কিন্তু এইচএসসি পাসের পর ভাই ও বাবা-মায়ের চাওয়ায় আমাকে অস্ট্রেলিয়া চলে যেতে হয়। ঢাকায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। বলতে পারেন, ভাগ্য সহায় হয় অস্ট্রেলিয়া আসার পর। ভিক্টোরিয়াস মডেল এজেন্সিতে দেড় বছর কাজ করার পর হাউস মডেলস নামের আরেকটি নামী প্রতিষ্ঠান থেকে ডাক পাই। নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়। ততদিনে রূপালি পর্দায় কাজ করার স্বপ্নটা আরও ডানা মেলতে শুরু করে। পড়াশোনার ফাঁকে চলতে থাকে স্বপ্ন পূরণের মিশন।’

২০১৫ সালে নাবিলার ডাক পড়ে হাউস মডেলস থেকে। নামীদামি মডেলরা এই এজেন্সির অধীনে কাজ করেন। এদের নির্বাচন প্রক্রিয়াও বেশ কঠিন।
নাবিলা বলেন, ‘ওরাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমি সানন্দে সাড়া দিই। বলিউডের ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া সহজ হয়েছিল এক সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার কারণে।’

‘মিস ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ডওয়াইড ২০১৭’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম রানার-আপ হন বাংলাদেশের মেয়ে নাবিলা। এটি আয়োজন করে জি টিভি অস্ট্রেলিয়া। উপমহাদেশের প্রতিযোগীদের নিয়ে আয়োজিত এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের সম্মানে এক নৈশভোজের আয়োজন করা হয় ক্যানবেরায়। সেখানে বলিউডের নায়ক জন অ্যাব্রাহামের সঙ্গে একটি গানে পারফর্ম করেন নাবিলা।

এ প্রসঙ্গে নাবিলা বলেছেন, ‘২০১৭ সালে ‘মিস ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ নামের একটি সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। আমার মাধ্যমে ভারতীয় সুন্দরী প্রতিযোগিতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনও বাঙালিকে উপমহাদেশীয় দেশের প্রতিযোগী হিসেবে নির্বাচন করা হয়। সেখানে প্রথম রানারআপ হই আমি। তখন মঞ্চে উর্মিলা মাতন্ডকারও ছিলেন। সেই সূত্রেই বলিউডের সিনেমার নির্মাতারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’

পরে ২০১৮ সালে ‘পেরেশান পারিন্দা’ ছবি দিয়ে বলিউডে অভিষেক হয় নাবিলার। এরপর কাজ করছেন ঢালিউডের পুলিশ অ্যাকশন থ্রিলারধর্মী সিনেমা ‘মিশন এক্সট্রিম’এ।
পেরেশান পারিন্দা: এটি একটি হিন্দি চলচ্চিত্র, যা ২০১৮ সালের ২৩ মার্চ মুক্তি পেয়েছে। দেবেশ প্রতাপ সিং পরিচালিত এই হিন্দি সিনেমাটি মূলত ত্রিভুজ প্রেমের সিনেমা। গ্যাংস্টাররাও জড়িত কাহিনিতে। সিনেমাটিতে নাবিলার বিপরীতে অভিনয় করেছেন অস্ট্রেলিয়ার মিরাজ শাহ। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী অভিনেত্রী নাবিলার বলিউড চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়।
‘পেরেশান পারিন্দা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য নাবিলাকে এক মাসের বেশি সময় দিতে হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ দিন একটি কর্মশালায় অংশ নেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমি যেহেতু বাংলাদেশের মেয়ে, তাই আমাকে ভালোভাবে হিন্দি শিখতে হয়েছে। ১৫ দিন যাঁর সঙ্গেই কথা বলতাম, হিন্দিতে বলতে হতো। এরপর শুটিং করেছি। ভারতীয় অনেকে শুটিংয়ের সময় আমার হিন্দি বলা নিয়ে ভেংচি কাটত। কিন্তু আমি তাতে দমে যাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখনও পুরোপুরি স্বপ্নের মতো মনে হয়। ছোটবেলায় যা স্বপ্ন দেখতাম, এখন তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যবর্তী একটা অধ্যায়ে আছি আপাতত।’
মিশন এক্সট্রিম: ‘মিশন এক্সট্রিম’ দিয়ে বাংলাদেশি সিনেমায় অভিষেক হয় নাবিলার। সিনেমাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেন ফয়সাল আহমেদ এবং সানী সানোয়ার। ২০২১ সালের শেষের দিকে মুক্তি পাওয়া ‘মিশন এক্সট্রিম’ সিনেমায় আরিফিন শুভ ও তাসকিন রহমানের পাশাপাশি দর্শক মহলে বেশ আলোচিত হন নারী পুলিশ চরিত্রে অভিনয় করা ইরা- যেই চরিত্রে অভিনয়ে ছিলেন নাবিলা। এদিকে ‘মিশন এক্সট্রিম’ সিনেমায় ইরা চরিত্র পছন্দ করায় দর্শকদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন নাবিলা।
তিনি বলেন, ‘বলিউড সিনেমা দিয়ে আমার চলচ্চিত্রে কাজ শুরু হলেও ‘মিশন এক্সট্রিম’ আমার প্রথম বাংলা সিনেমা। প্রথম সিনেমাতেই এমন সাড়া পাওয়াটা তো বড় ব্যাপার। ভালো ভালো মন্তব্য পেয়েছি। অনেক রিভিউ দেখছি। দর্শকদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’
এছাড়াও নাবিলা ২০১৮ সালে ভিকি জাহেদ পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মন’, আদনান আল রাজীব পরিচালিত টেলিভিশন বিজ্ঞাপন ‘গ্রামীণফোন টিভিসি’ এবং মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত মিউজিক ভিডিও ‘বিজ্ঞাপন’-এ অভিনয় করে দর্শকদের অভিনন্দন পেয়েছেন।

পরিবারে সমর্থন: সৈয়দপুরের মেয়ে নাবিলা অনেক দিন ধরেই আছেন অস্ট্রেলিয়াতে। সেখানে তিনি মডেলিং ও অভিনয়ে যুক্ত। তার নানাবাড়ি ও দাদাবাড়ি শরীয়তপুরে। বড় ভাই অস্ট্রেলিয়াতে আর বাবা-মা বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ায় আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। বাবা-মায়ের পাশাপাশি তাঁর আত্মীয়দের কাছ থেকেও সমর্থন পেয়েছেন নাবিলা। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমি অনেক ভাগ্যবান, কারণ থাকা সত্ত্বেও অনেকে পরিবারের সমর্থন পায় না। অথচ আমার যেকোনো সমস্যায় পরিবার ছিল পাশে।’
শেষ কথা: বর্তমানে বিদেশ বিভূঁইয়ে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছেন অনেকেই। তাদের কেউ রাজনীতি, বিজ্ঞান, শিক্ষা, ব্যবসা কিংবা অর্থনীতিতে। যাদের কারণে বিদেশের বুকে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশ। নাবিলা তাদের মধ্যে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম যিনি সিনেমায় অভিনয় করে নন্দিত নায়িকা হয়েছেন।