মুহম্মদ শামসুল হক, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র:
বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সময়ই মানুষকে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করে। সর্বংসহা এবং গোবেচারা প্রকৃতির সহজ-সরল মানুষগুলো সময়ের প্রয়োজনে মারমুখী হয়ে উঠে, খালি হাতে নরখেকো বাঘের সাথে পাঞ্জা লড়ে এবং নিরস্ত্র জনতা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। ১৯৭১ সালে নিজেদের মাতৃভূমিকে আধুনিক সমরাস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি জল্লাদদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য সর্বস্তরের বাঙালি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল এবং মানব সভ্যতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের সংযোজন করেছিল। আমেরিকা প্রবাসী বাঙালিদের জীবনে একাত্তরের গৌরবগাঁথা চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকলেও বাস্তবতার মানদন্ডে এখানে সেই শৌর্যবীর্য প্রদর্শন এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধ অকল্পনীয়। দৈহিক আকার-আকৃতি-শক্তি-সামর্থ সর্বোপরি জনসংখ্যার বিচারে আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালিদের অবস্থান সিন্ধুর মাঝে বিন্দুতুল্য। মেইনস্ট্রীম রাজনীতিতে জাঁদরেল দাবিদার অনেক বাংলাদেশি-আমেরিকান রাজনীতিবিদকে কমিউনিটির প্রয়োজনে খুঁজে পাওয়া যায় না- সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান তো দূরের কথা।
জনপ্রতিনিধিত্বের মানদন্ডে নিউইয়র্কের রাজনীতিতে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের ভাঁড়ে মা ভবানী দশা। আবার দৈহিক আকার-আকৃতি এবং শক্তি-সামর্থের বিচারেও প্রবাসী বাঙালিরা সিংহের থাবার কাছে মূষিক তুল্য। সারকথা, সর্বত্রই আমাদের অবস্থান একেবারে নাজুক। সদ্য প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে ২০২১ সালের মার্চ থেকে আগস্টের মধ্যে এশিয়ান-আমেরিকানরা কমপক্ষে আড়াই হাজার বার নানা ধরনের হেইট ক্রাইম বা হ্যারেসমেন্টের শিকার হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রাকৃতিক দুর্যোগ করোনা মহামারির কারণে এশিয়ান-আমেরিকানদের সিংহভাগ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর আমেরিকানের তুলনায় এশিয়ান আমেরিকান বেকারের সংখ্যা ঢের বেশি।

প্রকৃত প্রস্তাবে অজানাকে জানা কিংবা অচেনাকে চেনার জন্য সিংহভাগ বাংলাদেশি আমেরিকায় পাড়ি জমান নি। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন-জীবিকা লাভের আশায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশি আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন শিরে সংক্রান্তি নিয়েই আপনজনদের স্নেহ-মমতার স্বাভাবিক বন্ধন ছিন্ন করে অশ্রুসজল নয়নে। ভিন দেশের মাটিতে পা রাখার পর থেকেই দৈহিক হামলা, প্রাকৃতিক বৈরিতা, হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রা, কাঠফাটা রোদ ইত্যাদি নিষ্ঠুরতাকে শিরোধার্য করে আমরা উদয়াস্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে লেগে যাই। উদয়াস্ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি এবং ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অর্জিত মুদ্রার কিছু অংশ আমরা স্বদেশের স্নেহবুভুক্ষু স্বজনদের জন্য প্রেরণ করছি এবং বাংলাদেশের ঘূর্ণায়মান অর্থনীতির অচল চাকায় দু-চার বিন্দু তেল যুগিয়ে যাচ্ছি। অথচ দুর্ভাগ্যক্রমে প্রতিটি সরকারই আমেরিকান প্রবাসী হিসেবে আমাদের তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিক এমনকি অপাংক্তেয় বিবেচনা করে থাকে।
পক্ষান্তরে আটলান্টিকের এপারে অর্থ-বিত্তে কেউ কেউ স্বাবলম্বী হলেও হেইট ক্রাইম ও হ্যারেসমেন্টের ভয়-ভীতি সর্বদা এশিয়ান আমেরিকানদের নরখেকো বাঘের মত তাড়া করে। সাংবিধানিক বাধ্য-বাধকতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় তৎপরতার সুবাদে আমেরিকায় সর্বসাধারণের জীবনপ্রবাহ কিছুটা নিরাপদ হলেও পুরোপুরি দুশ্চিন্তামুক্ত নয়। কারণ মার্চ থেকে আগস্টের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার এশিয়ান আমেরিকান বিভিন্ন ধরনের বিদ্বেষপ্রসূত হামলার শিকার হয়েছেন। আবার প্রতিপক্ষীয় আগ্নেয়াস্ত্রধারীদের যুদ্ধংদেহী মনোবৃত্তির ফলে সাম্প্রতিক সময়ে গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে শান্তিপ্রিয় আমেরিকানদের জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় নামার অশুভ সঙ্কেত দিনে দিনে স্পষ্টতর হচ্ছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিশ্ব অভিবাসীর শ্রম-ঘামে গড়ে উঠেছে আমেরিকার সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। অথচ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সুসভ্য দেশ আমেরিকায় নিয়তিলাঞ্ছিত এবং ভাগ্যবিড়ম্বিত আফ্রিকান আমেরিকানদের শ্বেতাঙ্গ শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের দোসররা ৮৩ বছর দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছিল। ষোড়শ রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্বে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের পর ১৮৫২ সালে রাষ্ট্রপতি লিঙ্কন দাসমুক্তি সনদে স্বাক্ষর দান এবং ১৮৫৫ সালের ১৯ জুন তা কার্যকর হওয়ার পর দাসদের শৃঙ্খলমুক্তি ঘটলেও অদ্যাবধি আমেরিকা বর্ণবৈষম্যবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়নি। তাই ২০২১ সালের মে মাসে মিনেসোটায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নিষ্ঠুর নির্যাতনে নিরস্ত্র কৃষ্ণকায় উইলিয়াম ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর কৃষ্ণকায়দের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি নতুন করে লাভা উদগীরণ শুরু করে। ব্ল্যাক লাইভস মেটারসহ বিভিন্ন ব্যানারে সমগ্র আমেরিকায় ১১ সহস্রাধিক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় এবং বিক্ষোভ চলাকালে সহিংসতা, লুন্ঠন, ব্যাপক ভাঙচুর, হানাহানি-মারামারিসহ নানা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্ম হয়। সে বছর ব্ল্যাক ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে উদযাপিত হয়েছে ভিন্নমাত্রায়। সমগ্র আমেরিকায় এবার ব্ল্যাকস ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়েছে। কনফেডারেল সিম্বল অপসারণের দাবি জোরদার হওয়ায় বিভিন্ন স্টেট থেকে কলাম্বাস এবং কনফেডারেট জেনারেল লীসহ সর্বমোট ৪০টি কনফেডারেট সিম্বল অপসারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে পুলিশি বর্বরতার অভিযোগে নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন স্টেটে পুলিশের আইনে ব্যাপক সংস্কার আনয়ন করায় পুলিশবাহিনী বেগার ঠেলাভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করছে। ফলে ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন স্টেটে আগের বছরের তুলনায় গোলাগুলি, হত্যা, ধর্ষণ, সশস্ত্র রাহাজানিসহ সকল ধরনের অপরাধ গড়ে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এক শ্রেণীর আফ্রিকান-আমেরিকান নিজস্ব সশস্ত্র ক্যাডার গড়ে তুলছে বলেও প্রচার মাধ্যমের দাবি। এফবিআই পরিচালক ক্রিস রে পরিস্থিতির ব্যাখ্যাদানকালে বলেন, ফার লেফট এবং ফার রাইটদের র্যাাসিয়াল (বর্ণগত) বিক্ষোভ দেশময় তুঙ্গে উঠেছে। তিনি আরও জানান, কেন্টাকীর লুইসভিলে নট এফ কিঙ এ্যারাউন্ড কোয়ালিশন নামক একটি কৃষ্ণকায় গ্রুপের শত শত সদস্য অস্ত্র সজ্জিত হয়েছে। আর সাংবিধানিক অধিকার বলে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা আগ থেকেই আত্মরক্ষার খাতিরে আগ্নেয়াস্ত্র সংরক্ষণ করে আসছেন। মিশিগানের ডেমক্র্যাটিক দলীয় গভর্নর স্রেটচেন হুইটমারকে অপহরণের দায়ে ৬ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক ফেডারেল এবং ৭ জন শ্বেতাঙ্গের বিরুদ্ধে স্টেট অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। অন্যদিকে উচিটার মেয়রকে অপহরণের ভীতি দেখানোয় গ্রেপ্তার করা হয়েছে একজনকে। সাদামাটা ভাষায় বলা যায়, দেশজুড়ে অস্ত্রের মহড়া চালানোর জন্য উভয় পক্ষই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আবার শতাব্দীর ভয়াবহ প্রাকৃতিক করোনা মহামারিতে ইতোমধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৬১ কোটি, মৃতের সংখ্যা ৬৫ লাখ অতিক্রম করতে চলেছে। আর আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৯ কোটির বেশি লাখ এবং মৃতের সংখ্যা ১০ লাখ ৭২ হাজার ছাড়িয়েছে। মূলত আমরা ঘর ছেড়েছিলাম নিজের জীবন আত্মাহুতি দিয়ে স্বজনদের মুখে দুমুখী গ্রাস তুলে দেয়ার আশায়। বাঙালি-আমেরিকান হিসেবে আমাদের সকলের আশা-আকাঙ্খা ও স্বপ্ন কম-বেশি পূরণ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে কায়িক শ্রমে নিয়োজিত ছাপোষা বাংলাদেশি আমেরিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দুশ্চিন্তার সাগরে ভাসছেন। আর ক্ষুধার জ্বালায় জর্জরিত স্বজনদের মুখে দু’মুঠো গ্রাস তুলে দেয়ার আশায় আমাদের অনেককেই জীবন ঝুঁকি নিয়ে ঘরের বাইর হতে হবে। তখন হয়ত বা হতদরিদ্র বাংলাদেশি আমেরিকানদের অনেককে হতভাগ্য তফাজ্জলের ভাগ্য বরণ করতে হবে। কারণ অস্ত্রধারীদের মোকাবিলা করার সামর্থ আমাদের নেই। আবার দৈত্যাকার হামলাকারীদের মার হজমের সক্ষমতাও আমাদের নেই। তাই গোলাগুলিতে কিংবা অনাকাঙ্খিত মারের চোটে প্রাণ হারানোর আশঙ্কায় অনেকের এখন কম্পদিয়ে জ্বর আসার দশা।
ভুললে চলবেনা যে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমিস্টরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে হলেও সুপ্রিমেসী এবং শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা চালাবেন। আর অধিকার বঞ্চিত আফ্রিকান-আমেরিকানরা চরম ক্ষোভের অগ্নিসিন্ধুকে বুকে চাপা দিয়ে প্রতিশোধ পরায়ণতার চরিতার্থে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করবেন না। আর আগ্নেয়াস্ত্রধারী দুপক্ষই মারমুখী হয়ে উঠলে দেশজুড়ে সংঘাত অপরিহার্য হয়ে উঠবে এবং বাংলাদেশি আমেরিকানসহ শান্তিপ্রিয় আমেরিকানদের দুশ্চিন্তা এবং দুর্ভোগ মাত্রা ছেড়ে যাবে। যাহোক, নিয়তির লিখন না হয় খন্ডন। এতদসত্ত্বেও আমাদের এখন থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সম্ভাব্য ব্যয় সঙ্কোচের মাধ্যমে নিজেদের ন্যূনতম আয় থেকে রাই কুড়িয়ে বেল তৈরির মত কিছু অর্থ সঞ্চয় করতে হবে চরম নৈরাজ্যকর মুহূর্তে অকারণে ঘর থেকে বের হতে না হয়। আরও মনে রাখতে হবে, যার প্রতিকার করা যায় না, তা নীরবেই সহ্য করতে হবে।
যাইহোক জন্ম এবং মৃত্যুর সিদ্ধান্ত আকাশেই হয়ে থাকে এবং মহান আল্লাহর একক সিদ্ধান্তেই তা সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই যাবতীয় পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহই আমাদের একমাত্র রক্ষক ও সহায়ক। প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা তাঁর অপরিসীম রহমত কামনা করছি। আমিন।
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।