বিশ্বব্যাপী আলোচিত ব্রাজিলিয়ান কবি ও লেখক ‘পাওলো কোয়েলহো’ বলেছেন, ‘অতীতকে বিদায় জানাতে সাহস লাগে। সেই সাহস দেখাতে পারলে জীবন তোমাকে নতুন কিছু উপহার দেবে’। উক্তিটি বাংলাদেশের আলোচিত বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরীর জীবনের সাথে অনেকটা মিলে যায়। ছোটবেলায় তার লালিত স্বপ্ন ছিল রাজনীতিবিদ হবেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা হবেন কখনো ভাবেননি। কিন্তু ভাবনার বাঁক বদলের বদৌলতে বা ললাটবলে তিনি এখন বাংলা চলচ্চিত্রের আইকন নির্মাতা হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত। ব্যাপকভাবে বই পড়ুয়া এই মানুষটি চলচ্চিত্র লেখক, চলচ্চিত্র সমালোচনা এসবও সৃজনশীল কাজেও সিদ্ধহস্ত। বিশ্ব চলচ্চিত্রের খোঁজ-খবরওয়ালা, চলচ্চিত্রের জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ হিসেবে এরই মধ্যে তিনি তার স্বাক্ষর রেখেছেন। নির্মাণ করেছেন একের পর এক শিল্পসম্মত, মননশীল, ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্র, নাটক ও বিজ্ঞাপন চিত্র। তার সাথে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার জীবনের নানা কথা। সেসবের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হল প্রবাস মেলা’র পাঠকদের জন্য।

জন্ম ও বেড়ে উঠা: অমিতাভ রেজার পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জে, তবে তার জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নানাবাড়িতে। তিনি বড় হয়েছেন ঢাকার হাতিরপুলস্থ ভূতের গলিতে। তার বাবার নাম হারুন রেজা চৌধুরী, মায়ের নাম হামিদা রেজা চৌধুরী। অমিতাভ সানফ্লাওয়ার স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর ঢাকার বিএএফ শাহিন স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ভারতের পুনে ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৯৯ সালে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেন। রিমোট্যয়াড আথ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তার পড়াশোনায় যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটলেও চাচা কমরেড আইয়ুব রেজা চৌধুরীর সান্নিধ্যে থেকে বাম রাজনীতি ও সাহিত্যের প্রতি তার আগ্রহ বাড়তে থাকে।

বিজ্ঞাপন চিত্র ও নাটক নির্মাণ: অমিতাভ রেজা চৌধুরী যখন স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন তখন চেয়েছিলেন বড় হয়ে একজন রাজনীতিবিদ হবেন। কলেজ জীবনে যাওয়ার পর তার চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটলেও রাজনৈতিক চিন্তা থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেননি। ২০০১ সালে হাওয়াঘর নাটকের মাধ্যমে তার নাট্য নির্মাণ শুরু হয়। মাছরাঙা প্রোডাকশন থেকে একুশে টেলিভিশনের জন্য হাওয়াঘর নির্মাণ করেন যা দর্শক সমাদৃত হয়। এরপর একুশে টেলিভিশনের জন্য নির্মাণ করেন ‘বন্ধন’ নামের ধারাবাহিক নাটক যেটা সেই সময়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ফলে তিনি বিজ্ঞাপন নির্মাণের সুযোগ পান। তিনি প্রায় হাজার খানেক টেলিভিশন বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছেন। রেজা তার বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ কাজের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন-এর নাম ‘হাফ স্টপ ডাউন’। তিনি প্রায় আটটি টেলিভিশন নাটক নির্মাণ করেন। ‘হাওয়াঘর’ এবং ‘একটি ফোন করা যাবে প্লিজ’ নাটকের জন্য তিনি মেরিল প্রথম আলো শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য এবং পরিচালনা পুরস্কার লাভ করে। আর এখন তো তিনি পুরোপুরি নাটক-সিনেমার তারকা পরিচালক। তবে তার সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, নাট্যজগতে আসার প্রথম দিকে নির্মিত শর্টফিল্ম ‘বন্ধু আর বন্দুকের গল্প’, টিভি ফিকশন ‘শেষ আড্ডা’ তার প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম।

চলচ্চিত্রে যেভাবে আসলেন: অমিতাভ রেজা চলচ্চিত্র নির্মাণে আসবেন এমন কথা বহুদিন ধরে শোনা গেলেও তা বাস্তবে রূপ পেতে অনেক সময় নেয়। তবে তিনি দমে যাননি। ভালো গল্প পেলে একটা সিনেমা বানাবেন এমন ধারণা যখন পোষণ করছেন তখনই পেয়ে গেলেন আয়নাবাজির মতো অপূর্ব একটি কাহিনী। ব্যাস, তারপর কাজে নেমে যাওয়া, বানিয়ে ফেললেন বাংলাদেশের সিনেমা হলমুখী মানুষের জন্য ব্যাপক আশা জাগানিয়া সিনেমা আয়নাবাজি। ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অপরাধধর্মী থ্রিলার এই চলচ্চিত্রটি দেশে রেকর্ডসংখ্যক ব্যবসা করে। ২০১৮ সালে আয়নাবাজির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী। তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘রিকশা গার্ল’। সেটিও ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।

বিশ্ব মঞ্চে রিক্সা গার্ল সিনেমা: ‘আয়নাবাজি’ খ্যাত পরিচালক অমিতাভ রেজার বহু প্রতীক্ষিত ছবি ‘রিকশা গার্ল’। ‘রিকশা গার্ল’- এর প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়েছে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে। ২০২১ সালের পুরো মে মাসজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভানিয়া, ম্যারিল্যান্ড, ফ্লোরিডা, মিশিগান, ওয়াশিংটন ও ক্যালিফোর্নিয়া সহ ১৮ অঙ্গরাজ্যের ৫২ শহরে প্রদর্শিত হয় ‘রিকশা গার্ল’ চলচ্চিত্রটি। এছাড়া এই চলচ্চিত্রটি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড-এর সিনেমা হলগুলোতে পর্যায়ক্রমে মুক্তি পায়। এ প্রসঙ্গে অমিতাভ রেজা বলেন, ‘দেশের বাইরের দর্শকদের কাছে ছবিটি পৌঁছে দিতে এবং বাংলাদেশের সিনেমাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে ‘রিকশা গার্ল’ নিয়ে আমরা বড় বড় সব চলচ্চিত্র উৎসব ও শহরে হাজির হয়েছি। ম্যানহাটনের মতো বৈচিত্র্যময় শহরে এই ছবির প্রিমিয়ার করতে পেরে আমার ভিন্ন রকম অনুভূতি হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের লেখক মিতালি পারকিনসের কিশোরসাহিত্য ‘রিকশা গার্ল’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রটি। এর কাহিনী এক কিশোরীর জীবনযুদ্ধ ঘিরে রচিত হয়েছে, যে ঘটনাক্রমে রিকশা চালানোকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী সেখানের বাসিন্দারা চলচ্চিত্রটি বেশ উপভোগ করেছেন। ছবিটি ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেসকট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, জার্মানির ‘শ্লিঙ্গেল ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার জিতেছে ও সিনেমা সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।

চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রসঙ্গে: মূলধারা ও বিকল্প ধারা-এই দুই ধারার ছবিকে অনুদান প্রসঙ্গে অমিতাভ রেজা বলেন, ‘এটা সরকারের স্ট্র্যাটেজি। কয়েক বছর ধরে তারা এই নীতিতে চলছে। অনুদানের সিনেমার একটা নিয়মই ছিল, নিরীক্ষাধর্মী ছবিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। কিন্তু নিরীক্ষাধর্মী ছবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছিল না বলে গত কয়েক বছরে সরকার মূলধারার সিনেমাকেও অনুদান দিচ্ছে।’ ‘সহজ কথা হচ্ছে, ভালো ছবি, ভিন্নধর্মী গল্প বলতে হবে। সারা পৃথিবীজুড়ে নতুন করে গল্প বলার ঢং তৈরি হয়েছে, শুধু বাংলাদেশে না। পিপল আর ইউজড টু সি নন-স্টুডিও ফিল্ম। অমিতাভ রেজা এও জানিয়ে রাখলেন, স্বাধীন নির্মাতার গল্প পছন্দ হলেও আমি প্রযোজনা করতে চাই। ‘হাফ স্টপ ডাউন’ হতে পারে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পথচলার এক নতুন মাধ্যম’।

‘১৯৬৯’ সিনেমা সম্পর্কে: ২০২২ সালে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে ১৯ জনকে ১২ কোটি ১৫ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ পেয়েছেন নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী ‘১৯৬৯’ চলচ্চিত্রের জন্য। এ প্রসঙ্গে অমিতাভ রেজা চৌধুরী বলেন, ‘আমার ছবির গল্পটা একটা নির্দিষ্ট সময়কে কেন্দ্র করে। আগরতলা মামলার ওপর ভিত্তি করে এই সিনেমায় অনুদানের যে অর্থ বরাদ্দ পেয়েছি, তাতে ছবিটি হবে না। আরও অনেক অর্থ লাগবে। আশা করছি, বাকি ফান্ডও আমি পেয়ে যাব।’ অমিতাভ জানান, এক বছর ‘১৯৬৯’ ছবির গল্প নিয়ে গবেষণা চলছে। এধরণের সিনেমা নির্মাণের জন্য বড় পরিসরে ভাবতে হয়। যে ফ্রেমে ধরা দেবেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা নিয়ে তো বিশেষ ভাবনা থাকা স্বাভাবিক। তবে সেটি এখনও আলোচনা সাপেক্ষ বলে জানালেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী । তিনি বলেন, ‘আমার ছবিটি পিরিওডিক। ১৯৬৯ সালের উত্তাল রাজনীতির ঘটনা উঠে আসবে। মূলত আগরতলা মামলা নিয়েই ছবির গল্প এগোবে। যেহেতু এটি ইতিহাস নির্ভর, তাই এখানে নতুন করে কাহিনী লেখার সুযোগ নেই। এখনও আমরা স্ক্রিপ্টিং নিয়েই ব্যস্ত।’ বঙ্গবন্ধু চরিত্র থাকবে কিনা- এ প্রসঙ্গে এই নির্মাতা বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবো। যেহেতু আগরতলা মামলা তাই বঙ্গবন্ধু চরিত্রটি অনস্বীকার্য।’

মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম সম্পর্কে ভাবনা: নিজের দেশপ্রেম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অমিতাভ রেজা খোলাখুলিভাবে বলেন, ‘আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আমার কোন অস্তিত্ব নেই। এদেশের কেউই মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করতে পারবেনা। আমি যখন সিনেমা বানাই বা শিল্প সৃষ্টি করি তখন আমি বিবেক বা আদর্শ বিসর্জন দিয়ে কখনোই সেটা করিনা। আমি একজন সাধারন মানুষ, একজন সাধারণ নির্মাতা, আমি তো বুদ্ধিজীবীও নই। আমার শেষ কথা মুক্তিযুদ্ধ, দেশ আর দেশপ্রেমের চেতনা ছাড়া আমার কোন অস্তিত্ব নাই।’

পুনশ্চ: চলচ্চিত্র, নাটক এবং বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণে অমিতাভ রেজা চৌধুরী নিজেকে বেশ সমৃদ্ধ করেছেন। সকলের প্রত্যাশা মননশীল নির্মাতা হিসেবে তিনি নিজেকে আরও সম্প্রসারিত করবেন। যেমনটি শেকসপিয়র বলেছেন, ‘Masters, spread yourselves.’
(আলাপচারিতায় লেখা তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন– শহীদ রাজু)