মো: আশরাফুল আলম মাসুদ:
বেলজিয়াম উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের একটি দেশ। এটি ইউরোপের ক্ষুদ্রতম ও সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ব্রাসেলস শহরটি বেলজিয়ামের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো এবং বিশ্ব শুল্ক সংস্থার সদর দপ্তর ব্রাসেলসে অবস্থিত। এছাড়া ইউরোপীয় পার্লমেন্টের নতুন ভবনও এখানে অবস্থিত। বেলজিয়াম ভৌগোলিকভাবে ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় দেশটিকে ইউরোপের রাজধানী বলা হয়। ইউরোপীয় সংস্কৃতি এবং জীবনাচারণের দারুণ সংমিশ্রণ রয়েছে দেশটিতে। পরিবার কিংবা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আপনিও সময় করে দেশটির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে যেতে পারেন। প্রবাস মেলার ধারাবাহিক ভ্রমণে করণীয় বর্জনীয় এর এবারের পর্বে বেলজিয়াম নিয়ে নানা তথ্য তুলে ধরা হলো।
বেলজিয়ামের জনগণ:
বেলজিয়াম ইউরোপের সর্বাধিক নগরায়িত দেশ। এখানকার ৯৭ শতাংশ লোক শহরে বাস করে। কঠোর পরিশ্রম এবং সংস্কৃতিক মূল্যবোধ বেলজিয়ানদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালী পারিবারিক ব্যবস্থা বেলজিয়াম সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিছু কিছু একক পরিবার পৃথক বাড়িতে বসবাস করলেও প্রায়শই তারা যেখানে বড় হয়েছিল সেই শহরে বা তার কাছাকাছি বসতি স্থাপন করে।
বেলজিয়ামের ভাষা:
বেলজিয়ামের সরকারি ভাষা ডাচ, ফরাসি এবং জার্মান। তবে দূতাবাসের শহর ব্রাসেলসে ইংরেজি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। দেশটির স্কুলে সাধারণত ফরাসি এবং ডাচ ভাষায় পড়ানো হয়। বেলজিয়ামের অধিকাংশ লোকজন ফরাসি ভাষায় কথা বলেন। এছাড়া জার্মান বা ডাচ ভাষাও দেশটিতে ব্যবহার হয়। বেলজিয়ামের সবাই কম বেশি ইংরেজি জানে, ফলে দেশটিতে ভ্রমণে গেলে ইংরেজি ভাষা জানা থাকলে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। অন্যান্য ভাষার মধ্যে ইতালি, স্প্যানিশ, গ্রীক, আরবি এবং তুর্কিরও প্রচলন রয়েছে।
বেলজিয়ানদের পারিবারিক মূল্যবোধ:

বেশিরভাগ বেলজিয়ানদের জীবনে পরিবার একটি মূখ্য ভূমিকা পালন করে। পরিবারের প্রতি বাধ্যবাধকতা একজন ব্যক্তির প্রথম অগ্রাধিকার। অনেক লোক সেই শহরেই থেকে যায় যেখানে তারা বেড়ে উঠেছে। বেলজিয়ামে সমতাবাদী সমাজের ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। দেশটিতে পিতৃত্বের পাশাপাশি মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিষিদ্ধ করার আইন রয়েছে।
বকশিশ:
বেলজিয়ামের বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় বিলের ১০-১৫ শতাশং বকশিশ চার্জ অন্তর্ভুক্ত। ভ্রমণে বের হলে ট্যাক্সি চালকদের বকশিশ দিতে হয়। হাউস কিপিং/কনসিয়ার্জ বা বার কর্মীদের সাধারণত বকশিশ দেয়া হয় না।
মিটিং শিষ্টাচার:
বেলজয়ামে অপরিচিত কারও সাথে দেখা হলেও হ্যান্ডশেক একটি সাধারণ অভিবাদন রীতি। কারও সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠলে মুখে তিনটি চুম্বন দিতে পারেন যা হ্যান্ডশেকের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। পুরুষরা কখনই অন্য পুরুষদের চুম্বন করে না, তারা সব সময় হ্যান্ডশেক করেন।
উপহার দেয়া-নেয়া:

বেলজিয়ামে কারও বাড়িতে আমন্ত্রণ পেলে হোস্টের জন্য ফুল অথবা ভালো মানের চকলেট নিতে পারেন। উপহার হিসেবে সাদা চন্দ্রমল্লিকা দেবেন না, কারণ এটি দেশটিতে শোকের প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। ফুল বিজোড় সংখ্যা দেয়া উচিত, তবে কখনোই ১৩ নয়। মদ বা ওয়াইন শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দেয়া যেতে পারে। উপহার গ্রহণের পর খোলার রীতি রয়েছে দেশটিতে।
খাবার শিষ্টাচার:
বেলজিয়ানরা তাদের বাড়ি এবং রেস্তোরাঁয় সামাজিকীকরণ রক্ষা করে। দেশটিতে কারও বাড়িতে আপনি লিখিত আমন্ত্রণ পেলে অবশ্যই প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিখিত জবাব পাঠাতে হবে। আপনার হোস্ট বা হোস্টেস অন্যান্য অতিথিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করুন। বেলজিয়ানরা তাদের পোশাক নিয়ে গর্ববোধ করে। তারা আশা করে যে আপনি রক্ষণশীল পোশাক পরিধান করবেন। সময়মত পৌঁছান, সময়ানুবর্তিতা দেশটিতে কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। কোথায় বসতে হবে হোস্টের বলার অপেক্ষা করুন। মহিলারা পুরুষদের আগে আসন গ্রহণ করে। খাওয়ার সময় হাতের কব্জি টেবিলের উপরে রাখুন। পানি পান করার আগে হোস্টকে পান করার জন্য অফার করতে পারেন। বেলজিয়ানরা তাদের রান্না নিয়ে গর্ব করে, তাই খাবার গ্রহণের পর প্রশংসা করতে ভুলবেন না।
ব্যবসায়িক আলোচনা:

ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট আবশ্যক। ব্যবসায়িক আলোচনার ক্ষেত্রে সাধারণত হোস্টই সময় নির্ধারণ করে থাকেন। জুলাই এবং আগস্টের সময় নির্ধারিত মিটিং এড়িয়ে চলুন, যা প্রধানত দেশটিতে ছুটির সময়। এছাড়া ক্রিসমাস (বড়দিন) এবং ইংরেজি নববর্ষের এক সপ্তাহ আগে ও পরে মিটিংয়ের সময় রাখা যাবে না। সময়মতো মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতে হবে। দেরিতে পৌঁছানো অবিশ্বস্ত হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। মিটিং হবে আনুষ্ঠানিক। প্রথম মিটিংয়ে ব্যবসায়িক আলোচনার চেয়ে সামাজিক আলোচনা বেশি হয়, কারণ বেলজিয়ানরা তাদের পরিচিতদের সাথে ব্যবসা করতে পছন্দ করে।
পোশাক পরিচ্ছেদ:
পুরুষদের সাদা শার্ট এবং সিল্ক টাইসহ গাঢ় রঙের রক্ষণশীল ব্যবসায়িক স্যুট পরা উচিত। মহিলাদের ব্যবসায়িক স্যুট বা রক্ষণশীল পোশাক পরা উচিত। দেশটিতে পালিশ করা জুতা পেশাদার ইমেজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ব্যবসায়িক কার্ড বিনিময় করা হয়। ব্যবসায়কি কার্ডের একপাশে ফ্রেঞ্চ বা ডাচ ভাষায় অনুবাদ করে রাখা ভালো।
বেলজিয়ামের কয়েকটি দর্শনীয় স্থান:
১. গ্র্যান্ড প্লেস
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি গ্র্যান্ড প্লেস। ব্রাসেলসের মূল ভ্রমণ স্পট এটি। দুটি ক্ষুদ্র জলাভূমি পরিচিত ব্রয়েক সেলা নামে। গ্র্যান্ড প্লেসকে কেন্দ্র করেই ব্রাসেলসের সবচেয়ে বড় বাজার গড়ে উঠেছে।
২. টাউন হল
গ্র্যান্ড প্লেসের সাথেই টাউন হল। এক জায়গায় গেলেই ব্রাসেলসের দুটি ঐতিহ্য দেখা হয়ে যাবে। আর্চড জানালা এবং বিভিন্ন ভাস্কর্যের সঙ্গে তৈরি টাওয়ারের রূপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
৩. হেইসেল পার্ক এবং অটোমিয়াম
ব্রাসেলসের পশ্চিমে হেইসেল পার্ক অবস্থিত। এই পার্কের মূল আকর্ষণ অটোমিয়াম। ৩৩৫ ফুট উঁচু একটি অ্যাটমের আকৃতি যা পুরোটাই বানানো হয়েছে ইস্পাত দিয়ে।
৪. কোয়েকেলবার্গ বাসিলিকা

পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম চার্চ এটি। ব্রাসেলসের কোয়েকেলবার্গ মিউনিসিপিলিটিতে অবস্থিত এই চার্চটি। এটি ৮৯ মিটার উঁচু এবং ১৬৭ মিটার দীর্ঘ জায়গা জুড়ে অবস্থিত।
৫. রয়েল মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস

এখানে দুটি জাদুঘর রয়েছে, একটি ‘দ্য মিউজিয়াম অব এনশিয়েন্ট আর্ট’ যা নির্মাণ করেছেন নেপোলিয়ন। আরেকটি ‘মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট’। ১৯৮৪ সালে এই জাদুঘরটি নির্মাণ করা হয় পুরোনো জাদুঘরটির সাথে। দুই জাদুঘরে ৬০০ বছরের পুরোনো চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য সংরক্ষিত আছে।