তার পৈত্রিক নাম রওশন আরা বেগম। তবে তিনি রওশন আরা মনি নামে সমধিক পরিচিত। ধর্মীয় অনুশাসনের আবর্তে বাঁধা থাকলেও পরিবারের সবাই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ও সংগীতের চেতনায় সমৃদ্ধ। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আব্দুস সমরু। মনির মা সৈয়দা সুফিয়া খানম। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মনি সবার ছোট। তিনি ছোটবেলা থেকেই গান শুনতে শুনতে অজান্তে এক সময় গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন। এখন পুরোদস্তুর একজন সঙ্গীতশিল্পী। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বসবাস করছেন। তাকে নিয়েই আমাদের এবারের প্রচ্ছদ কাহিনী।

জন্ম, বেড়ে ওঠা ও সঙ্গীতে হাতেখড়ি: ৭০ দশকের প্রথমার্ধে বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজারে এক প্রগতিশীল মুসলমান পরিবারে মনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালে মনির বাবা সমরু মিয়া মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিলেতে গিয়েছিলেন। সে সুবাদে খুব ছোটবেলায় মনির লন্ডনে যাওয়া। সেখানে স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তবে সেখানে তখন বাংলা ও আরবী শেখার খুব সহজ পরিবেশ ছিলনা। তাই তিনি দেশে এসে মৌলভীবাজারের আলী আমজাদ গার্লস স্কুলে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন এবং ভালো করে আরবী ও বাংলা শিখেন। স্কুলের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মনি নিয়মিত অংশ নিতেন। মনি তখন থেকেই একটু একটু গানের চর্চা শুরু করেছিলেন। একা একা গান গাইতেন। তাই দেখে মা তাকে উৎসাহ দিয়ে বাড়িতে গান করার সুযোগ তৈরী করে দিয়েছিলেন। মনির প্রথম গানের হাতেখড়ি হয় চট্টগ্রামের ওস্তাদ গুরুজী চন্দ্রশেখর দত্তের কাছে। দেশে থাকতে মাত্র ৭ বছর বয়সে মনি সিলেট বেতারে গান করেছেন। খেলাঘর, চাঁদের হাট, কচি কাঁচার মেলার মতো শিশুদের অনুষ্ঠানগুলিতে প্রায়ই মনির ডাক পড়তো। ছোটদের নাটক, নাচ এবং কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানেও তিনি অংশ নিয়েছেন। ‘স্বপ্নপুরি’ নাটকে অভিনয় করে সেসময় অনেক নাম হয়েছিল মনির। নাটকে ‘আমাদের স্বপ্নপুরি’ ও ‘প্রজাপতি প্রজাপতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা’ গান পরিবেশন করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। রওশন আরা মনি দশ বছর বয়সে আবার লন্ডনে ফিরে আসেন। সেখানকার নটিংহিল হল্যান্ড পার্ক স্কুলে ভর্তি হন এবং তিনি ‘জি.সি.এস.সি’ ও ‘এ’ লেভেল পাশ করেন।

কর্মজীবন: রওশান আরা মনির বিলেতের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। প্রথমে তিনি সিটিজেন এডভাইজ ব্যুরোতে এক বছর এবং পরে বাংলাদেশ সেন্টারে ইয়ুথ ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেন্টারে জুনিয়র টিচার হিসেবে তিনি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেকে বাংলা, আরবী ও গান শেখাতেন। তারপর ২০০১ সালে তিনি ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টে সিনিয়র মেডিকেল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে সেই চাকরিতেই তিনি বহাল আছেন।

সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড: ১৯৮৬ সালে রওশান আরা মনি পূর্ব লন্ডনের বহুল আলোচিত বাঙালিদের একমাত্র সংগীতের দল ‘দিশারী শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে জড়িত হয়েছিলেন। ১৯৮৫ সালে টয়েনবি হলে বাংলাদেশ সেন্টারে একটি সুবৃহৎ কালচারাল ফাংশানের আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে বিলেতের দুই বাংলার অনেক নামী-দামী বাঙালি শিল্পীদের মধ্যে রওশন আরা মনিও অংশগ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রথম যখন গানের পথে পা রেখেছিলাম তখন ভাবতে পারিনি বিলেতের মতো জায়গায় বড় বড় অনুষ্ঠানে নামকরা শিল্পীদের সাথে গান গাওয়ার সুযোগ পাবো। আমি খুবই ভাগ্যবতী যে বিলেতের বাঙালি কমিউনিটির কাছে আমার একটা পরিচিতি হয়েছে। বিলেতে সংগঠিত বাংলাদেশের সবগুলি জাতীয় অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিতে পেরেছি’।
ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অংশগ্রহণ: ১৯৯৮ সালের মে মাসে রওশন আরা মনি লন্ডন থেকে সম্প্রচারিত বাংলা রেডিও ‘সান রাইজ রেডিও’-তে প্রেজেন্টার হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি স্পেকট্রাম রেডিও বাংলায় যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্পেকট্রাম রেডিও থেকে ‘স্বাধীনতা’ নামে প্রথম একটি বাংলা নাটক প্রচারিত হয়েছিল। তিনি সে নাটকে অভিনয় করেছেন। এরপর ‘সোনার হরিণ’ ও ‘একুশের পদক’ নাটক দুটিতেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। রওশন আরা মনি টেলিভিশনের নাটকেও অভিনয় করেছেন। নব্বই দশকের শেষের দিকে বাংলা টিভি থেকে সম্প্রচারিত কথাসাহিত্যিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ও উর্মি মাযহারের নির্দেশনায় ‘লাল গোলাপ’ নাটকে গানের শিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করে প্রচুর প্রসংশা লাভ করেছিলেন। তিনি চ্যানেল নাইন-এ ‘প্রিয় শিল্পী প্রিয় গান’ নামে একটি আধুনিক গানের অনুষ্ঠান করতেন এবং চ্যানেল এস’-এ ‘রক্ এ্যান্ড পপ’ নামে একটি পপ গানের অনুষ্ঠান করতেন। তিনি মঞ্চ নাটকেও অভিনয় করেছেন। অধ্যাপক মোমতাজউদ্দিন আহমেদের লেখা ও তসলিম আহমেদ পরিচালিত ‘ক্ষত বিক্ষত’ নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। এছাড়া তার নিজের লেখা ‘ডিনার’ নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন।

সঙ্গীতে স্টেজ পারফর্ম: রওশন আরা মনি লন্ডনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্টেজ পারফর্ম করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ২০১৫ সালে পূর্ব লন্ডনের বাংলা টাউনে বৈশাখী মেলার মঞ্চে ‘পীরিতি বসন্তকালে’ নামে ফোক গান পরিবেশন করেন। সেসময় গানটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে। গানটি ইউটিউবে ব্যাপক প্রচার হয়েছিল এবং প্রায় ৪৪ লক্ষেরও বেশি ভিউ হয়েছে। তিনি ইউরোপের ফ্রান্স, জার্মানী বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, ইতালিসহ বেশ কয়েকটি দেশে গানের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। একক গানের অনুষ্ঠান করতে কানাডা এবং আমেরিকাতেও সফর করেছেন। তিনি বাংলাদেশের কয়েকটি শহরেও একক সংগীতের অনুষ্ঠান করেছেন। বাংলাদেশের অনেক খ্যাতনামা শিল্পীদের সাথে একই মঞ্চে তিনি গান করেছেন। তিনি অধিকাংশ সময়ে শাহ আব্দুল করিমের গান, হাছন রাজার গানসহ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান পরিবেশন করে থাকেন। রওশন আরা মনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পি ভারতের মান্না দে ও হৈমন্তি শক্লার সাথে একই মঞ্চে গান করার সুযোগ লাভ করেছেন।

চ্যারিটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ: ২০১৪ সাল থেকে উপমহাদেশের গোল্ড মেডেলিস্ট পাটিয়ালা ঘারানার ওস্তাদ নাচি ইরফানের কাছে মনি গান শিখছেন। ইস্ট লন্ডনের প্ল্যাস্টো এলাকায় ‘নাফিস ইরফান এ্যাকাডেমি‘ নামে তার একটি মিউজিক ইন্সটিটিউট আছে। মনি সেখানকার নিয়মিত ছাত্রী। রওশন আরা মনি ২০০৯ সালে বাউল সম্রাট অসুস্থ শাহ্ আব্দুল করিমের চিকিৎসার জন্যে নিজস্ব উদ্যোগে একটি ফান্ড রেইজিং প্রেগ্রাম করেছিলেন। আরেকটি চ্যারিটি অনুষ্ঠানে পপস¤্রাট আযম খানের চিকিৎসার জন্যে ফান্ড রেইজ করে। বর্তমানে রওশন আরা মনি লন্ডনের এ-ওয়ান টি.ভি, পাকিস্তান টি.ভি, দুনিয়া চ্যানেল, জি-ও টিভি, পাঞ্জাবী চ্যানেল এবং সি-৪৪ চ্যানেল-এ নিয়মিত প্রোগ্রাম করছেন।

গানে এখন: বর্তমানে রওশন আরা মনি ‘মেলোডি ফর ইউ‘ নামে নিজে একটি ‘সং গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই গ্রুপের এন্টারটেইনমেন্ট এ্যারেঞ্জার হিসেবে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। এ প্রসঙ্গে মনি বলেন, আমার সং গ্রুপ ‘মেলোডি ফর ইউ’-এর নামে আমি একটি গানের ইনস্টিটিউট করতে চাই। সেখানে আগ্রহী ছেলেমেয়েরা সহজে এবং কম খরচে গান শেখার সুযোগ পাবে।

এ্যালবাম প্রকাশ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা: ২০০২ সালে লন্ডনের একটি প্রাইভেট রেকর্ডিং কোম্পানী ‘নিঝুম রাত’ নামে রওশন আরা মনির একটি গানের এ্যালবাম বের করেছে। এই এ্যালবামে মোট দশটি গান আছে। সেগুলির মধ্যে ছয়টি গানের রচয়িতা গীতিকার কবি মোহাম্মদ ইকবাল, দুইটি গান রচনা করেছেন জুবায়ের তানসেন এবং বাকি দুইটি গান সংগৃহিত। সবগুলি গানের সংগীত ও সুর সংযোজনা করেছেন জুবায়ের তানসেন। তবে তিনি জানান, খুব শীঘ্রই বাংলা এবং উর্দু গজলের সমন্বয়ে একটি এ্যালবাম বের করবেন।

পারিবারিক জীবন: রওশন আরা মনির স্বামী মোহাম্মদ ইকবাল একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি দেশ বিদেশের বেশ কয়েকটি সাহিত্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। বর্তমানে তিনি ব্যবসা করছেন এবং তিনি একজন কবি। তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান মোহাম্মদ শাবাব ইকবাল লন্ডনের কুইনমেরী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস এবং বিএসসি অনার্স (নিউরোলজি) তে ডিগ্রী অর্জন করেছেন।
(আলাপচারিতায় লেখা তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন– শহীদ রাজু)