সেজান মাহমুদ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং শিক্ষাবিদ। একাধারে তিনি সাহিত্যিক, গীতিকবি, ছড়াকার, চলচ্চিত্রকার এবং কলামিস্ট হিসেবে ব্যাপক সমাদৃত। বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিন-এর মেডিসিন বিভাগে টেনিউরড অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন। তিনি কালচার, হেলথ এন্ড সোসাইটি নামক মডিউলের পরিচালক, ফোকাস ইনকোইয়ারি এন্ড রিসার্চ এক্সপেরিয়েন্স মডিউলের যুগ্ম-পরিচালক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং সহকারি ডিন হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য তিনি প্রশংসনীয় অবদান রেখেছেন। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় পদচারণা থাকা বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই গুণী ব্যক্তির আদ্যোপান্ত প্রবাস মেলার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

ব্যক্তিগত ও শিক্ষাজীবন
সেজান মাহমুদের পেশাগত নাম সালেহ মো: মাহমুদুর রহমান। ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে তার জন্ম। বাবা মরহুম আফাজ উদ্দিন সরকার এবং মাতা ফিরোজা বেগম। সেজান মাহমুদ ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৯২ সালে এমবিবিএস পাশ করার পর আমেরিকার বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অব মেডিসিনের জসলিন ডায়াবেটিস সেন্টার থেকে এন্ডোক্রাইনোলজিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ফেলোশিপ ট্রেইনিং লাভ করেন যা আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের একটি অত্যন্ত সম্মানজনক পুরস্কার হিসাবে অর্জন করেন (১৯৯৬)। এরপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে স্কলারশিপসহ এমপিএইচ (১৯৯৭) এবং বার্মিংহাম থেকে পিএইচডি (২০০১) ডিগ্রি অর্জন করেন। সেজান মাহমুদের জীবন সঙ্গি চিকিৎসক (ইন্টারনাল মেডিসিন) ও ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে অভিনয়-খ্যাত শিল্পী তৃষ্ণা মাহমুদ, তাঁদের দুই ছেলে তিশিয়ান মাহমুদ ও রেনোয়া মাহমুদ কে নিয়ে বাস করছেন আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে।
কর্মজীবন

সেজান মাহমুদ চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন বারডেমের স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগে। যদিও বারডেমে যুক্ত হবার আগেই আমেরিকায় মলিকিউলার বায়োলজিতে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ পান। সেই সূত্রেই বারডেমে অবৈতনিক কাজ শুরু করে বারডেমের কর্মকান্ডে মুগ্ধ হন এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম ছেড়ে দিয়ে সেখানেই পরিপূর্ণভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এখানেই শিক্ষাবঞ্চিত, বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষদের কীভাবে ডায়াবেটিস শিক্ষা দেয়া যায় এবং কীভাবে উন্নতধরনের স্ব-নিয়ন্ত্রিত চিকিৎসা বজায় রাখা যায় তা নিয়ে অভিনব পদ্ধতির সূচনা করেন তিনি। নিজের সাহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সূত্রে কার্টুন ও ছড়া দিয়ে কীভাবে মেডিকেলের জটিল বিষয়গুলো সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করা যায় তা শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম সৃষ্টি করেন। এই সৃজনশীল স্বাস্থ্যশিক্ষাই তাঁকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার এনে দেয়, যার সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের ফেলোশিপ নিয়ে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে যান। তিনি এমপিএইচ এবং পিএইচডি ডিগ্রি লাভের পর ওহাইও মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি ও বোউলিং গ্রীন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা শুরু করেন। ওহাইও থেকে ফ্লোরিডা স্টেটের রাজধানী ট্যালাহাসি শহরে ফ্লোরিডা এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটিতে ফ্লোরিডা স্টেটের প্রথম ডক্টর অব পাবলিক হেলথ প্রোগ্রামের ফাউন্ডিং ফ্যাকাল্টি হিসাবে চাকরি শুরু করেন। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষ, বিশেষ করে কালোদের ওপরে যে অমানবিক নির্যাতন ও দাসপ্রথার মতো অন্যায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেটাই ছিল একটি বড় অনুপ্রেরণা কালোদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্যে। দীর্ঘ একযুগ শিক্ষিকতার মাধ্যমে বহুসংখ্যক আফ্রিকান আমেরিকান গ্রাজুয়েট তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন তিনি এবং এর জন্যে নানান পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনে অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন।

পেশাগত জীবনেও এক ঈর্ষনীয় সাফল্যের নির্দশন সৃষ্টি করেছেন তিনি। স্বাস্থ্য বৈষম্য, গ্লোবাল হেলথ, মানসিক স্বাস্থ্য ও ক্যান্সার প্রতিরোধে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যকারণ কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে তা নিয়ে সেই তিন দশক ধরে গবেষণা করছেন। ২০০০ সাল থেকে আমেরিকার বৃতত্তম ক্যান্সার সারভেইলেন্সের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে মানুষের আর্থসামাজিক সূচক যেমন পোস্টাল জিপকোড ভিত্তিক গড় আয়, প্রতিগৃহে যানবাহনের সংখ্যা, ক্যানসার স্ক্রিনিং সেন্টারের দূরত্ব ইত্যাদির সঙ্গে কীভাবে মানুষের ক্যান্সারের ডায়াগনোসিস স্টেজ নির্ধারণ করে তা নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যা জনস্বাস্থ্যের একটি অন্যতম উপাদানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। তিনি আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ থেকে মাল্টি মিলিয়ন ডলারের গ্রান্ট এ্যাওয়ার্ড পেয়ে বহুবিধ দায়িত্বশীল পদ অলংকৃত করেছেন এবং স্বীকৃতি হিসাবে একাধিক আমেরিকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। বিভিন্ন জার্নালে শতাধিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণাপত্র, নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
সাহিত্য কর্ম

সাহিত্যে সেজান মাহমুদের বিচরণ বহুবিধ ক্ষেত্রে। যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সাফল্য ও সৃষ্টির মণিমুক্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। ছড়াগ্রন্থ ‘হাবিজাবি’ লেখার মাধ্যমে ১৯৮৮ সালে তিনি সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রথম গ্রন্থের জন্যই তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি কর্তৃক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডোদের গৌরবজনক ভূমিকার অকথিত কাহিনী নিয়ে লেখা মুক্তিযুদ্ধের ওপরে বাংলাদেশের প্রথম ডকু-উপন্যাস ‘অপারেশন জ্যাকপট’ ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হলে তা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। অপারেশন জ্যাকপট গ্রন্থটি ইংরেজিতে আনুবাদ করেন বিবিসি’র সাংবাদিক সাগর চৌধুরী যা অ্যামাজনে কিন্ডল ও হার্ড কভারে পাওয়া যায়। তাঁর নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস ‘অগ্নিবালক’ (২০০৯) প্রকাশিত হলে সৃজনশীল ও মননশীল লেখক মহলে নতুনধারার লেখা হিসেবে প্রশংসিত হয়। এই গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা লেখকেরা, যাঁদের মধ্যে অন্যতম হাসান আজিজুল হক। তিনি এ গ্রন্থটিকে বাংলা সাহিত্যের ধারায় একটি ‘রাবার ধরে টান’ উপমা দিয়ে তুলনা করেন। ‘অগ্নিবালক’ উপন্যাসটিও ইংরেজি অনুবাদ করেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ডক্টর ফায়েজা হাসানাত। ‘অগ্নিবালক’ উপন্যাসটি ইংরেজিতে ‘ফায়ার বর্ন’ নামে বৃটিশ প্রকাশনা সংস্থা অস্টিন ম্যাকলি প্রকাশ করেছে ২০২০ সালে এবং সারা বিশ্বের ১৬টিরও বেশি দেশে পুস্তাকালয়ে প্রদর্শিত ও বিক্রি হচ্ছে। তাঁর লেখা ‘পায়ের নিচে এভারেস্ট’ বাংলাদেশ টেক্সটবুক বোর্ড ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবই ‘চারুপাঠ’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে ১৯৯৬ সালে যা কনিষ্ঠতম বয়েসে অর্জিত এক বিরল সম্মাননা। এখন পর্যন্ত ৩৬টি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি এবং নিয়মিত লিখে চলেছেন।

চলচ্চিত্র
সেজান মাহমুদের লেখা ও পরিচালনায় প্রথম তথ্যচিত্র ‘লাশকাটা ঘর’। এটি বাংলাদেশের ডোমদের জীবন নিয়ে নির্মিত হয়। লাশকাটা ঘর বা ‘দ্য মর্গ’ ২০১৪ সালে আমেরিকার বিখ্যাত রিচমন্ড ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘অনারেবল মেনশন এ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘মনের ঘুড়ি লাটাই’ অবলম্বনে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘গৌরব’ নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। এটির নির্দেশনায় ছিলেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকার হারুনর রশীদ। বর্তমানে একটি পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য ও একটি টিভি সিরিজের কাজ করছেন সেজান মাহমুদ।
প্রকাশিত গ্রন্থ
সেজান মাহমুদের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: অগ্নিবালক (নিরিক্ষাধর্মী উপন্যাস), হারাম ও অন্যান্য গল্প (ছোট গল্প), মুক্তিযুদ্ধের কিশোর রচনা সমগ্র-১, হার্ভার্ডের স্মৃতি ও অন্য এক আমেরিকা, পথ হারানোর পথ (কলাম সমগ্র-১), বিজ্ঞাননির্ভর এডভেঞ্চার সমগ্র-১, সায়েন্স ফিকশন সমগ্র-১, দেবদূত মানুষ (সায়েন্স ফিকশন), মানুষের মধ্যে মানুষ (সায়েন্স ফিকশন), কসমিক সংগীত (সায়েন্স ফিকশন), লীথী (সায়েন্স ফিকশন), আয়ুষ্কাল ও ত্রিমিলার প্রেম (সায়েন্স ফিকশন), অপারেশন জ্যাকপট (মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ও ডক্যুমেন্টরি), মুক্তিযুদ্ধের সেরা লড়াই (মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ও ডক্যুমেন্টরি), মনের ঘুড়ি লাটাই (মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ও ডক্যুমেন্টরি), কালা কুঠুরি (মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাট্যপোন্যাস), কিশোর রহস্য গল্প (সম্পাদিত গ্রন্থ), নির্বাচিত কিশোর রহস্য গল্প (সম্পাদিত গ্রন্থ)।
সংগীত রচনা

বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেতারের গীতিকার হিসেবে সেজান মাহমুদ লিখেছেন অনেক জনপ্রিয় গান। এর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য কয়েকটি হলো নেলসন মেন্ডেলা (ফকির আলমগীর), আমি নই সেই বনলতা সেন (কনকচাঁপা), কোন এক সুন্দরী রাতে (সামিনা চৌধুরী), এলোমেলো চুল আর ললাটের ভাঁজ (কনকচাঁপা), আমার দু’চোখ দিয়ে তোমাকে যতোই আমি দেখি (তপন চৌধুরী), বাঁচার মতো বাঁচতে চাই (রেঁনেসা), তবু ভালবাসি আমাদের ঢাকা (ফকির আলমগীর ও সহশিল্পীবৃন্দ), শহর থেকে একটু দূরে চলনা (১৬টি ব্যান্ড), সুখের অসুখ ঘুমের আড়ি (ফাহমিদা নবী), তুমি আমি নদীর মতো একা (ফাহমিদা নবী), ভুল ঠিকানায় পৌঁছে গেছে ভালবাসার চিঠি (বাপ্পা মজুমদার) এবং একটি বাংলাদেশ (সামনূর মনির কোনাল)।

পুরস্কার ও সম্মননা
সাহিত্য ও পেশাগত কাজের জন্য সেজান মাহমুদ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৮), রিচমন্ড ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘অনারেবল মেনশন এ্যাওয়ার্ড’ (২০১৪), গ্লোবাল কর্পোরেট এ্যাওয়ার্ড ইন সাইন্স অ্যান্ড একাডেমিয়া, এএসিআর ফ্যাকাল্টি স্কলার এ্যাওয়ার্ড (২০০৮, ২০১০), আমেরিকান পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশন আরলি ক্যারিয়ার এ্যাওয়ার্ড (২০০৬, প্রথম এশিয়ান), আওয়ার প্রাইড এ্যাওয়ার্ড (২০০৫), আলাবামা পাওয়ার ফাউন্ডেশন আউটস্ট্যান্ডিং এচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড (২০০০)।
আলাপচারিতায় লেখা তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন শহীদ রাজু ও মো: মোস্তফা কামাল মিন্টু।