মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত, রিয়াদ, সৌদিআরব:
বিশ্ব সভ্যতায় এসেছে যান্ত্রিকতা, মানুষ হারাচ্ছে মানবিকতা। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে সামগ্রিক দিক দিয়ে। শিক্ষার হার বাড়ছে দিন দিন কিন্তু এই শিক্ষার সুফল আমরা কতটুকু পাচ্ছি তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। একদিকে বাড়ছে শিক্ষার হার আর অন্যদিকে সমাজে বাড়ছে বিশৃংখলা, কলহ, অশ্লীলতা সহ নানান অপরাধ প্রবণতা। সমাজ ক্রমশ হয়ে উঠছে অস্থির। সামাজিক শৃংখলা আর মূল্যবোধ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, সভ্যতা প্রভৃতির ব্যপক উৎকর্ষতার পরেও যেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এক ধরনের ছন্দপতন আজ চোখে পড়ার মতো। মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে মানুষ আজ কৃপ্রবৃত্তির তাড়নায় সকল হীন কাজে লিপ্ত হচ্ছে এবং কলুসিত করছে পুরো জাতিকে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে যেভাবে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় সহ নানান প্রাকৃতিক দূর্যোগ আসে তেমনি সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হলে সমাজে গুম, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ঘুষ, দূর্নীতি সহ নানান ধরনের অপরাধ সমাজকে অস্থির করে তোলে এবং সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে। যার ফলে সমাজ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হত্যাকা- ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই বুঝা যায় আমাদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। স্বামী কতৃক স্ত্রী হত্যা, পিতার হাতে সন্তান কিংবা সন্তানের হাতে পিতা খুন, এক সহোদরের হাতে অপর ভাই খুন এসব ঘটনা এখন সাধারণ মানুষকে খুব নাড়া দিচ্ছে। পৃথিবীতে যত সর্ম্পক আছে তার মধ্যে পিতা-মাতার সাথে সন্তানের আর ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের বা বোনের সর্ম্পক হচ্ছে সবচাইতে গভীর ও নিরাপদ কিন্তু তাও যেন আজ আর নিরাপদ নয়। যে পিতা তার সন্তানের জন্য সারা জীবন বিলিয়ে দেয়, সন্তানের সুখের তরে নিজের সুখকে বিসর্জন দিতে থাকে আজীবন সেই পিতার হাতে নির্মম ভাবে খুন হচ্ছে সন্তান! এগুলো কীসের আলামত? কোন নারকীয় বর্বরতার বহিঃপ্রকাশ! কেন এমন হচ্ছে? মানুষের অন্তরাত্মা কতটুকু কঠোর আর পাশবিক হলে এসব কর্মকা- করা যায়! আমরা কী তাহলে মানবিকতা ছেড়ে পশুত্ব বরণ করে নিচ্ছি?
আজকে বাংলাদেশের যুব সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় তারা জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ মূলক কর্মকান্ডে যা তাদেরকে ভবিষ্যতে অথর্ব ও কর্মক্ষম হিসেবে গড়ে তুলবে। ইয়াবা, ইলেকট্রনিক ধূমপান ও নানান জাতের নতুন নতুন মাদকের মরণ ছোবল গ্রাস করেছে পুরো যুব সমাজকে। বখাটে, ইভটিজার, মদ্যপ, সন্ত্রাসী, ধর্ষক ইত্যাদি বিশেষণে আজকে বিশেষায়িত আমাদের যুব সমাজ। অথচ এই যুব সমাজই আগামী দিনে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিবে। যারা পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়ছে তারা শুধু নয় যারা লেখাপড়া করে বড় বড় ডিগ্রীধারী হচ্ছে তাদের অবস্থাও আশা জাগানিয়া নয়। কেননা তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোগবাদী ও আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার কারণে হয়ে উঠছে লোভী, ঘুষখোর কিংবা দূর্নিতীবাজ। নৈতিকতাহীন শিক্ষা ব্যবস্থা, অপসংস্কৃতির বেপরোয়া অনুকরণ, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব এবং পারিবারিকভাবে মৌলিক শিক্ষার ঘাটতি আজকের যুব সমাজকে পরিণত করছে মানবিক মূল্যবোধহীন এক যান্ত্রিক মানুষে। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সর্ব ক্ষেত্রে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব গভীরভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে যা সমাজের জন্য বিরাট অশনি সংকেত।

সমাজচিন্তকদের আজ গভীরভাবে ভাবতে হবে নৈতিকতার এ অবক্ষয় থেকে জাতিকে উদ্ধারের ব্যাপারে। সরকার শুধু দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ বা উন্নত দেশের কাতারে দাঁড় করানোর সংগ্রাম করলে হবেনা, সাথে সাথে প্রচেষ্টা থাকতে হবে একটি উন্নত ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি গঠনের দিকে। কেননা নৈতিক মূল্যবোধহীন উন্নয়ন কখনো টেকসই উন্নয়ন হতে পারেনা এবং কোন জাতির জন্য সুদূর প্রসারী কোন উপকারও বয়ে আনতে পারেনা। মনোবিজ্ঞানীদের মতে সমাজে কেউ অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না। মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে। অধিকাংশ সময়ে পরিবেশ তার কাছের মানুষরাই তৈরি করে দেয়। কখনও কখনও সমাজে মানুষদের আচরণ, অসহযোগিতার কারণে পরিবারে, সমাজে দ্বন্দ্ব সংঘাতের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই এসব ব্যাপারে প্রয়োজনে কাউন্সিলিং দরকার এবং পারিবারিক শিক্ষা ও পরিবারে নৈতিকতার চর্চা অপরিহার্য। বর্তমান সময়ে আমরা এমন এক বাস্তবতায় বাস করছি যেখানে পিতা-মাতা দুজনই বেশির ভাগ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি বাড়ির বাইরে নিজেদের চাকরি বা ব্যবসার কারণে। নিজেদের সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে এসব দেখার মতো সুযোগ আমাদের নেই। আর যেসব পিতা-মাতার এসব সুযোগ আছে তাঁরাও যেন সচেতন নই। এসব কারণে আমাদের ছেলে মেয়েরা বেশির ভাগ সময়ই যা ইচ্ছে তাই করছে এবং এক সময় অনৈতিকতার পথে পা বাড়াচ্ছে। আর বিদ্যাপীঠ গুলোতে শাসন ব্যবস্থা বা নৈতিকার পাঠ নেই বললেও চলে। অনেক ভালো পরিবারের সন্তানরাও আজ খারাপ সঙ্গ এবং অভিভাবকের তদারকির অভাবে চলমান অনৈতিকতার ¯্রােতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে অনায়াসে।
সমাজের চলমান অস্থিরতা ও অপরাধ প্রবণতা রোধে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ নিলেই কেবল হবে না, এর মূলে গিয়ে দেখতে হবে এসব অস্থিরতা আর ন্যক্কারজনক মানসিকতার উৎস কী? তাহলেই কেবল এর সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া যাবে। সমাজ থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ আর নৈতিক শিক্ষাকে দূরে ঠেলে দিয়ে একটি সভ্য ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ বিনির্মাণের চেষ্টা সফল হবে না। তাই মানবতার স্বার্থে আজকে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চাকে বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে এবং সুস্থ ও আদর্শিক ভবিষ্যত প্রজন্ম গঠনের ধারা নিশ্চিত করতে হবে।