আতাউর রহমান:
১. আমাদের জাতীয় জীবনে গত সাত দশকজুড়ে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অবদান একবাক্যে স্বীকার্য। এটি স্মরণে রেখে ভবিষ্যতে তাঁর নামে এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নামকরণ হবে বলাই বাহুল্য, এমন উদ্যোগ জরুরিও বটে, তবে অনেকেই বোধকরি জানেন না—তাঁর নামে ইতোমধ্যেই একটি স্থাপনার নামকরণ হয়েছে দেশের সুদূর পার্বত্যঞ্চলে। বান্দরবান লামার কোয়ান্টাম কসমো স্কুল এন্ড কলেজের অন্যতম শিক্ষার্থী আবাসন—‘ড. আনিসুজ্জামান হল’। দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপে নির্মিত এবং প্রায় আড়াইশ শিক্ষার্থীর বাস-উপযোগী এ সুপরিসর আবাসনটি ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন আনিসুজ্জামান স্যার নিজেই।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্যারের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় তাঁর স্বভাবসুলভ মৃদু রসিকতাটা মনে পড়ে—‘আমার নামে এখানে একটি স্থাপনার নামকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এমন উদ্যোগ সাধারণত আমরা দেখি ব্যক্তির মৃত্যুর পরেই নেয়া হয়ে থাকে। আমি এখনও বেঁচে থেকে আজকের অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের কিছুটা বিপদে ফেলে দিয়েছি তা স্বীকার করি!’।
প্রেস-মিডিয়ার উপস্থিতিহীন নিতান্তই অনাড়ম্বর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর ৫,২৮০ বর্গফুট বিশিষ্ট পুরো হলটি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একবার ঘুরে দেখেন। সকৌতূহলে খোঁজ নেন শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আর ওদের দৈনন্দিন নির্ঘণ্ট সম্পর্কে। কথা বলেন পাহাড়ি-আদিবাসী-বাঙালি কয়েকজন ক্ষুদে শিক্ষার্থীর সাথেও। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল জাতীয় আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং এদেশে শিক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁর নামে এই হলটি নামাঙ্কিত করে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।
২. কোয়ান্টামমে স্যারের অবস্থানস্থল ‘রাহমাতান’ বাংলো থেকে সেদিন সকালে আমরা যাচ্ছিলাম অনুষ্ঠানস্থল ভ্যালি হিকমান ক্যাম্পাসে। দূরত্ব সামান্যই, কিন্তু যেতে হবে পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে। বাহন একটি ফোর হুইলার জিপ, স্থানীয় ভাষায় ‘চাঁদের গাড়ি’। যাত্রাসঙ্গী স্যারের প্রথম জীবনের ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থার পরিচালক অধ্যাপক ড. নূরুর রহমান খান, শিল্পী ও উদ্যোক্তা মাসুম রহমান এবং আমি। যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরই জলমগ্ন পাহাড়ি ছড়া পেরিয়ে গাড়ি উঠতে লাগল পাহাড়ি পথে। এদিকে আগের রাতে হয়ে গেছে অসময়ের এক পশলা বৃষ্টি। পথ স্বাভাবিকভাবেই কর্দমাক্ত। রাস্তাজুড়ে পুরু কাদার স্তর। বহু চেষ্টা করেও ফোর হুইলার ফেল। জোর গর্জনে তার চাকা ঘুরছে, চারদিকে সমানে কাদা ছিটাচ্ছে কিন্তু সামনে এগোনোর নাম নেই। এখন উপায়?
অতঃপর আনা হলো একখানা দশাসই ট্রাক। ট্রাকের পেছনের বাম্পারের সাথে মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো আমাদের জিপের সামনের বাম্পার। ঘড় ঘড় শব্দে ট্রাক স্টার্ট নিল। আর তার পেছন পেছন হেলতে দুলতে চলতে আরম্ভ করল জিপ। উঁচু-নিচু এবড়ো থেবড়ো, সবমিলিয়ে সে এক দুর্গম যাত্রাপথ। গাড়ি একেকটা ঝাঁকি খায়, আমরা দুলে উঠি। গাড়ির ভেতরে এদিক সেদিক বাড়ি খেয়ে আমাদের চোখমুখ আপনিই কুঁচকে ওঠে, কখনও-বা স্বগতোক্তির মতো মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ইস্-আহা-উঁহু জাতীয় শব্দ।
স্যার বসেছেন ড্রাইভারের পাশের সিটে, আমরা তিনজন পেছনে। বেশ অনেকক্ষণ পর খেয়াল করলাম—প্রতিটা ঝাঁকির প্রতিক্রিয়ায় আমরা যা-ই বলি বা করি না কেন, স্যার একেবারে নির্বিকার। মুখভঙ্গি পুরোদস্তুর স্বাভাবিক। কোনো রকম খেদোক্তি তো দূরের কথা। যত বারই খেয়াল করছিলাম, দেখি বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত তিনি। গাড়িতে সর্বজেষ্ঠ্য (স্যারের বয়স তখন ৭৯) এই মানুষটির দিকে তাকিয়ে বরং মনে হচ্ছিল যে, দড়ি বেঁধে ট্রাকের সাহায্যে জিপ টেনে নিয়ে যাওয়াসহ পুরো ব্যাপারটাতে তিনি কিছুটা কৌতুকই বোধ করছেন!
পরে বাংলোয় ফিরে এসে চা খেতে খেতে কথাপ্রসঙ্গে তুললাম সকালের পর্বতোত্থান বিষয়ক আলাপ। স্যার বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা মনে পড়ছিল। অনেকটা এরকম দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েই নিজে গাড়ি চালিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে সপরিবারে ভারতে পাড়ি দিয়েছিলাম।’
৩. সেই দুদিনে (৪ ও ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬) স্যারের সাথে টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি। এর আগে তাঁর আত্মজীবনীমূলক বইগুলো পড়া, গুলশানের বাসা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কক্ষে একাধিকবার যাওয়া-আসা, নানা অনুষ্ঠান ও কাজের সূত্রে দরকারি আলাপ—এর মধ্য দিয়ে তাঁকে যতটা চিনেছিলাম, তার চেয়ে বেশি জেনেছি ও একান্তে বুঝেছি এই দুদিনে। খুব কাছে থেকে দেখেছি, ছোট বড় সাধারণ পদস্থ নির্বিশেষে সবার সাথে আক্ষরিক অর্থেই তিনি সমান গুরুত্ব দিয়ে কথা বলছেন।
প্রসঙ্গত বলি, কোয়ান্টামমে পৌঁছার প্রথম দিন (৪ ডিসেম্বর) বিকেলে বাংলোর বারান্দায় বসে চা-আড্ডা হচ্ছিল। স্বাভাবিকভাবে স্যারই ছিলেন মধ্যমনি। এমন সময় জনাকয়েক পুলিশ এলো ওখানে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আসবেন জেনে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তাঁর নিরাপত্তা বিবেচনায় পার্শ্ববর্তী কেয়াজুপাড়া থানা থেকে পাঠিয়েছেন ওদের। স্যার যতক্ষণ এখানে থাকবেন ততক্ষণ ওরা যে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন, সালাম জানিয়ে তা অবহিত করাই ছিল ওদের উদ্দেশ্য। এটুকু বলেই ওরা চলে যাচ্ছিলেন। স্যার ওদের বসতে বললেন। চা খাওয়ালেন। আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে গল্প করলেন—ওরা কতদিন ধরে এ এলাকায় আছেন থেকে শুরু করে পাহাড়ি লোকালয়ে হাতির পাল ঢুকে পড়লে কীভাবে ওরা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার উদ্যোগ নেন অবধি বিস্তৃত সেই গল্প।
আসলে আনিসুজ্জামান স্যারকে নিয়ে এমন ছোট বড় অগণিত অমূল্য ঘটনার রেশ জেগে আছে কেবল আমার একার বা আমাদের নয়, দেশে-বিদেশে তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী ও স্নেহ-ভালবাসাধন্য নানা বয়সী মানুষের স্মৃতিঝুলিতে। যথার্থই তিনি তাঁর চারপাশের সবার জীবনে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন ব্যক্তিগত আনন্দের অফুরান স্মৃতি।
লেখক:মেডিকেল কাউন্সিলর এন্ড মোটিভিয়ার, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন