দীপক তালুকদার, বার্লিন, জার্মানি:
জার্মানিতে অভিবাসীদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশটির প্রতি চারজন উদ্যোক্তার মধ্যে অন্তত একজন অভিবাসী। নানা জটিলতা, যেমন অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয়ের সুযোগ কম থাকা, অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, ভাষাগত সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি সত্ত্বেও অভিবাসী ও অভিবাসী পরিবারের সদস্যদের উদ্যোক্তা হিসেবে এভাবে এগিয়ে যাওয়ার বাস্তাবতায় বুঝা যায় যে, তারা দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ইনফোমাইগ্রেন্টস- এ প্রকাশিত সংবাদসূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জার্মানিতে অভিবাসীদের মালিকানাধীন বিভিন্ন স্টার্ট-আপের তালিকা বেশ লম্বা। যেমন: অটো ১, ডেলিভারি জিরো, রিসার্চগেট, ওমিও, গেটইয়োরগাইডস- এমন অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন অভিবাসীরা। আর মেডিক্যাল স্টার্ট-আপ বায়োনটেকের কথা তো সবারই জানা। তুরস্কে জন্মগ্রহণকারী জার্মান অভিবাসী উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠান বায়োনটেক ২০২০ সালে করোনা ভ্যাকসিন তৈরি করে সারাবিশ্বে সাড়া ফেলেছিল।
জার্মানির বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণা বলছে, অভিবাসীদের উদ্যোগে গঠিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ২৩ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। আর জার্মান স্টার্ট-আপ অ্যাসোসিয়েশন এবং ফ্রিড্রিশ নয়েমান ফাউন্ডেশনের জরিপ বলছে, ২০২২ সালে জার্মানির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের শতকরা ২২ ভাগ অভিবাসী বা অভিবাসী পরিবারের। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল শতকরা ২১ ভাগ।
মাইগ্রেন্ট ফাউন্ডারস মনিটর নামে একটি সংস্থার জরিপ বলছে, জার্মানিতে ৩৯৪জন অভিবাসী উদ্যোক্তা রয়েছেন। এর মধ্যে শতকরা ৫৯ ভাগ উদ্যোক্তা প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী এবং ৪৩ ভাগ দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী। প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী বলতে সেসকল অভিবাসীদের বুঝানো হচ্ছে, যারা জার্মানির বাইরে জন্মগ্রহণ করেছেন। জরিপে আরো যা দেখা গেছে, নতুন উদ্যোক্তাদের প্রতি ৫ জনে ১ জন অভিবাসী। রাজধানী বার্লিন এবং জার্মানির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নর্থ রাইন ওয়েস্টফালিয়াতে অভিবাসী উদ্যোক্তার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। উদ্যোক্তাদের শতকরা ৫০ ভাগই পূর্ব ইউরোপ এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা। রাশিয়া, পোল্যান্ড এবং ভারত থেকে আসা অভিবাসীরা তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছেন। প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের এক তৃতীয়াংশই জার্মানিতে পড়াশোনা করেছেন। প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কর্মী বিদেশি। সেখানে কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসীও রয়েছেন।
প্রথম প্রজন্মের এসব উদ্যোক্তার শতকরা ৭৬ ভাগ নিজেদের ব্যবসা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থাৎ জার্মানির বাইরে ছড়িয়ে দিতে চান। জার্মানির ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কেননা জার্মান ব্যবসায়ীদের অনেকেই স্থানীয় বাজারে সীমাবদ্ধ থাকতে চান। তবে অভিবাসীরা জার্মানিতে ব্যবসাক্ষেত্রে এভাবে এগিয়ে গেলেও তাদেরকে নানান প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। মাইগ্রেন্ট ফাউন্ডার্স মনিটরের জরিপে এমন কিছু প্রতিকূলতার কথাও বেরিয়ে এসেছে। যেমন: প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তদের এক তৃতীয়াংশ বলছেন, তাদের সাথে স্থানীয় অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো ধরনের ব্যবসায়িক সমন্বয়ে যেতে চান না। অর্থায়ন পাওয়ার বিষয়টিও অভিবাসী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। প্রথম প্রজন্মের শতকরা ৪৩ ভাগ উদ্যোক্তা বলছেন ব্যবসার জন্য অর্থ সহযোগিতা পেতে তাদেরকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়।
প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের যারা দেশের বাইরে পড়াশোনা করেছেন তাদের অর্ধেকের বেশি বলেছেন যে, উদ্যোক্তা হিসেবে তাদেরকে বর্ণবাদী আচরণের মুখোমুখি হতে হয়। আর দ্বিতীয় প্রজন্মের শতকরা ১৭ ভাগ অভিবাসী উদ্যোক্তা এমন পরিস্থিতিতে পড়ার কথা বলেছেন। শতকরা ২১ ভাগ অভিবাসী বলছেন, ভাষার সীমাবদ্ধতা উদ্যোক্তা হওয়ার পথে একটি বড় বাধা। তাছাড়া, সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টিও অভিবাসীদের কাছে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, জার্মানিতে মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৫ দশমিক ৯ ভাগ লোক হয় নিজেই অভিবাসী অথবা তাদের বাবা কিংবা মায়ের মধ্যে কোনো একজন জন্মের সময় জার্মান নাগরিকত্ব ছিল না।