বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী হায়াৎ একাধারে একজন পরিচালক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক এবং অভিনেতা। ১৯৭৯ সালে ‘দি ফাদার’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালনা জীবন শুরু করেন তিনি। এর আগে ১৯৭৪ সালে পরিচালক মমতাজ আলীর সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে কর্মজীবন শুরু তার। ১৯৭৬-১৯৭৭ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের সাথে সীমানা পেরিয়ে ছবিতেও সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন কাজী হায়াৎ। সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তিনি প্রবাস মেলা অফিসে এসেছিলেন। কিংবদন্তীর এই চলচ্চিত্র নির্মাতার সাথে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার জীবনের নানা কথা। সেসবের চুম্বক অংশ প্রবাস মেলার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
জন্ম ও বেড়ে উঠা

স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াৎ ১৯৪৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার ফুকরা ইউনিয়নের তারাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের পাঠশালাতেই তার লেখাপড়া শুরু। হৃষিকেশ মুখার্জী নামে একজন শিক্ষক স্বেচ্ছাশ্রমে দুই মাইল কাদামাটি ঠেলে তারাইল গ্রামে দু’চালার একটি ঘরে এসে শিক্ষা দিতেন। সেখানেই কাজী হায়াৎ এর বর্ণ পরিচয় হয়। এরপর ক্লাস ওয়ানে উঠলে তিনি স্থানীয় ফুকরা মডেল স্কুলে প্রাথমিকে ভর্তি হন। সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া শেষ করে ফুকরা মদন মোহন একাডেমিতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কাজী হায়াৎ এর কলেজ জীবন শুরু হয় রামদিয়া শ্রীকৃষ্ণ কলেজে। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন কলেজ) থেকে হিসাব বিজ্ঞানে এম.কম সম্পন্ন করেন।
পারিবারিক জীবন
কাজী হায়াৎ এর স্ত্রীর নাম রমিসা হায়াৎ। তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে কাজী মারুফ চলচ্চিত্র অভিনেতা। অ্যাকশন ঘরানার চলচ্চিত্রে অভিনেতা কাজী মারুফ তার চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন ‘ইতিহাস’ ছবির মাধ্যমে। কাজী হায়াৎ পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ২০০২ সালে। প্রথম ছবিতেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেন কাজী মারুফ। কাজী মারুফ সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছেন। কাজী হায়াৎ এর মেয়ের নাম কাজী আফরোজা মিম। বর্তমানে দেশের নামকরা একটি প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। কাজী হায়াৎ এর বাবার নাম মো: কুটি মিয়া কাজী, মায়ের নাম আফরোজা বেগম। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।
চলচ্চিত্রে যাত্রা
ছাত্রজীবন থেকেই চলচ্চিত্র পরিচালনার আগ্রহ ছিল কাজী হায়াৎ এর। এম.কম পরীক্ষা দেয়ার পরপরই তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক সহকারীর প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। প্রথমে ১৯৭৪ সালে মমতাজ আলীর সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন তিনি। পরে আলমগীর কবিরের সাথে সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭) ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। তিনি পূর্ণ-পরিচালক হিসেবে ১৯৭৯ সালে ‘দি ফাদার’ ছবিটি পরিচালনা করেন, যা শৈল্পিক দিক থেকে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন জন নেপিয়ার অ্যাডামস, বুলবুল আহমেদ ও সুচরিতা। এ ছবির ‘আয় খুকু আয়’ গানটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। রুচিশীল দর্শকদের ছবি হিসাবে পরিচিতি পাওয়া এই ছবিটির পর তিনি কেন গতানুগতিক ধারার ছবি তৈরী শুরু করলেন তার উত্তরে তিনি বলেন, ‘দি ফাদার’ ছবির প্রযোজক তাঁকে আর তাঁর অফিসে ঢুকতে দেননি কারণ ছবিটি শহরে চললেও গ্রামে চলেনি। তাই এরপর থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ছবিকে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান করতে হবে। পরের বছর নির্মাণ করেন বাণিজ্যিক ধারার ছবি দিলদার আলী। কাজী হায়াৎ তার বেশিরভাগ ছবিতে বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সমসাময়িক জনদুর্ভোগের চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি কাজী হায়াৎ অসংখ্য চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন।

নির্মাতা কাজী হায়াৎ এর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র
কাজী হায়াৎ এ পর্যন্ত ৫১টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। তার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫০টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। ‘বীর’ চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি ৫০তম চলচ্চিত্র পরিচালনার মাইলফলক স্পর্শ করেন। কাজী হায়াৎ পরিচালিত অন্যতম চলচ্চিত্রসমূহ হল দাঙ্গা (১৯৯২), ত্রাস (১৯৯২), চাঁদাবাজ (১৯৯৩), সিপাহী (১৯৯৪), দেশপ্রেমিক (১৯৯৪), লাভ স্টোরি (১৯৯৫), আম্মাজান (১৯৯৯), ইতিহাস (২০০২), কাবুলিওয়ালা (২০০৬) এবং ওরা আমাকে ভাল হতে দিল না (২০১০)। তার পরিচালনায় সর্বশেষ সরকারি অনুদানের সিনেমা ‘জয় বাংলা’ সেন্সর পেয়েছে। এটি আগামী ১৬ ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়া হবে বলে তিনি জানান। মুনতাসীর মামুনের ‘জয় বাংলা’ উপন্যাস থেকে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি অনুদানে টুঙ্গিপাড়া চলচ্চিত্রের ব্যানারে ‘জয় বাংলা’ নির্মিত হয়েছে।
অভিনেতা কাজী হায়াৎ

চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি কাজী হায়াৎ অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। চলচ্চিত্রে তার অভিনয় দর্শকদের হৃদয় কাড়ে। পরিচালক কাজী হায়াৎ যেমন প্রতিবাদী তেমনি অভিনেতা কাজী হায়াৎও তেমন প্রতিবাদী। যে সকল পরিচালক তার সিনেমায় সমাজের দুর্নীতি, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা তুলে ধরতে চান তাদের প্রথম পছন্দ কাজী হায়াৎ। তাকে উপলক্ষ করেই তারা চিত্রনাট্যের সংলাপ তৈরি করেন। এধরণের অভিনয়ে কাজী হায়াৎকে তারা একজন ব্র্যান্ড অভিনেতা মনে করেন। তার অভিনীত সিনেমার মধ্যে ইতিহাস, মিনিস্টার, ধাওয়া, আজকের সমাজ, রাজধানী, পিতার আসন, বিদ্রোহী রাজা, সন্তান আমার অহংকার, শ্রেষ্ঠ সন্তান, ভালোবাসার লাল গোলাপ, আমার স্বপ্ন আমার সংসার, পিতা পুত্রের গল্প, পাগলা হাওয়া, আশীর্বাদ অন্যতম।
বিজ্ঞাপনের মডেল কাজী হায়াৎ
চলচ্চিত্র পরিচালনা ও অভিনয়ের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হয়েছেন কাজী হায়াৎ। জানা যায়, ফজর আলীর লুঙ্গির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তিনি মডেল হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। জাভেদ মিন্টুর পরিচালনায় রাজধানীর একটি হাসপাতালের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

চলচ্চিত্রের দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে কাজী হায়াৎ
কাজী হায়াৎ পরিচালিত ছবিগুলোতে সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম, প্রতিবাদ, অরাজকতার চিত্র ফুটে উঠে। কিংবদন্তীর এ চলচ্চিত্র নির্মাতা বলেন, বাণিজ্যিক ছবি হওয়া সত্ত্বেও আমার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো মানুষের জীবনের কথা বলেছে, অন্যায়ের কথা বলেছে, সমাজের কথা বলেছে। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি ছবিতে দর্শকদের প্রতি একটা অঙ্গীকার থাকা উচিত, সাধারণ মানুষকে বিনোদনের বাইরে বাড়তি কিছু দেয়া উচিত। তাই আমি চেষ্টা করেছি ছবিতে দেশপ্রেম, মানুষের মুক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলার। আমাদের এই দরিদ্র দেশে উন্নত সিনেমার চেয়েও জরুরী এমন সিনেমা যেখানে মানুষ বিনোদনের সাথে একটি বার্তা পায়। যেমন আমার অনেক ছবির নায়ক মান্নার মৃত্যুর পর তার জানাজায় মানুষের ঢল থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে সাধারণ মানুষ মান্নাকে তাদের ত্রাণকর্তা মনে করতো।
নায়ক মান্না সম্পর্কে কাজী হায়াৎ

নায়ক মান্না প্রসঙ্গে কাজী হায়াৎ বলেন, ১৯৮৫ সালে আমার পরিচালনায় ‘পাগলী’ চলচ্চিত্রে মান্না অভিনয় করে। তারপর আমরা জুটি হয়ে ‘তা-বলীলা’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘দেশপ্রেমিক’, ‘যন্ত্রণা’, ‘দাঙ্গা’, ‘ত্রাস’, ‘সিপাহী’, ‘আম্মাজান’, ‘ধর’, ‘কষ্ট’, ‘লুটতরাজ’, ‘তেজি’, ‘মিনিস্টার’, ‘সমাজকে বদলে দাও’, ‘বর্তমান’, ‘পাঞ্জা’ র মতো সামাজিক অ্যাকশন থ্রিলার চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছি ঢালিউডকে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্রে দাপিয়ে বেড়ানো মান্না বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন একটি ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। তার অসংখ্য ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে তরতর করে এগিয়ে দিচ্ছিলো। কিন্তু মান্নার চলে যাওয়ার সঙ্গে চলচ্চিত্রের একটি ধারারও সমাপ্তি ঘটে’।
পুরস্কার

কাজী হায়াৎ তার চলচ্চিত্র জীবনে আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও অন্যান্য চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ সর্বমোট ৭৩টি পুরস্কার লাভ করেছেন। তিনি তেহরান, মস্কো, চেকোস্লাভিয়াসহ চারটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন। দাঙ্গা চলচ্চিত্রের জন্য আফ্রো-এশিয়ো সরিডরি কমিটি অ্যাওয়ার্ড কর্তৃক প্রদেয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকার হিসেবে চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে নয়টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং লেখনীর জন্য তিনটি বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন।
(আলাপচারিতায় লেখা তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন– মোস্তফা কামাল মিন্টু।)