আবদুল্লাহ জাহিদ: বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক ও প্রভাব সৃষ্টিকারী কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।তা কে নিয়ে কথা বলা জরুরি বিবেচনা করি। সাহিত্যের সীমায় তাঁর অবদানের তুল্যমূল্য পরিমাপ না হলে শুধু জনপ্রিয়তা তার প্রকৃত প্রতিরূপ ঢেকে ফেলবে। বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর কবিতায় প্রেম, প্রতিবাদ, মানবিকতা এবং সামাজিক মূল্যবোধের মেলবন্ধন অসাধারণ শৈলীতে উঠে আসে, যা পাঠকদের গত চার দশক ধরে মুগ্ধ করে রেখেছে।
জীবন ও সাহিত্যিক যাত্রা
রেজাউদ্দিন স্টালিনের জন্ম ১৯৬২ সালের ২২ নভেম্বর, ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার নলভাঙ্গা গ্রামে। লেখালেখির প্রতি আকর্ষণ এবং সামাজিক পরিবর্তনের স্বপ্ন তাঁকে ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ও কবিতার পথে নিয়ে আসে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে উপস্থাপনায় প্রভূত সাফল্য অর্জন ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর লেখনীতে সবসময় মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সামাজিক অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদ এবং পৃথিবীর সৌন্দর্যকে ভিন্নমাত্রায় প্রকাশ করার এক অনন্য দক্ষতা লক্ষ্যনীয়।
সাহিত্যকর্ম ও তার বৈশিষ্ট্য
রেজাউদ্দিন স্টালিনের সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রধানত কবিতা, তবে তিনি গল্প, প্রবন্ধ এবং গবেষণাধর্মী রচনাও রচনা করেছেন। তাঁর রচিত কবিতার বইগুলির মধ্যে “ফরিনি অবাধ্য আমি” “আশ্চর্য আয়নাগুলো” এবং “আশীর্বাদ করি আমার দু:সময়কে”, “সবজন্মে শত্রু ছিলো যে”, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর কবিতায় মানবিক বোধ এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ মূর্ত হয়ে ওঠে। বাস্তববাদী ও আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা এই কবিতাগুলোতে তিনি কখনো প্রেমের আবেদন, কখনোবা মানবিক সংকটের কথা গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
তিনি যখন বলেন-
জগতের আছে একটি মাত্র ভাষা,
ভালোবাসা, ভালোবাসা।
কিংবা
ভেবো না প্রিয়তমা
তোমাকে কেউ আকাশ দিলে
সূর্য দেবো আমি।
কবিতায় প্রেম ও মানবিকতা
স্টালিনের কবিতায় প্রেম এবং মানবিকতার চিত্রায়ণ অন্যদের থেকে একটু ভিন্ন। তাঁর কবিতা প্রেমের চিরাচরিত অর্থকে ছাড়িয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সমগ্র বিশ্বকে আলিঙ্গন করা এবং জীবনের গভীরতা খোঁজার অনুরণন তুলে ধরে। তাঁর কবিতা কেবল প্রেমের বাহ্যিক রূপ নয় বরং এক গভীর অনুভূতির প্রকাশ, যা মানুষকে একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধ করে তোলে। “আশ্চর্য আয়নাগুলো” -কাব্যগ্রন্থে তিনি প্রেমকে যে রূপে দেখিয়েছেন তা মননশীল পাঠকদের জন্য একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।
সমাজ এবং সমাজতত্ত্বের প্রতিফলন
স্টালিনের কবিতাগুলি সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে কথা বলে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে তিনি কবিতায় তুলে ধরেছেন। তিনি যুদ্ধ এবং শান্তির দ্বন্দ্ব, সামাজিক পরিবর্তন, শোষণ এবং মানবাধিকার সম্পর্কে সরাসরি তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। “যুদ্ধ নয় শান্তি” গ্রন্থে তিনি যুদ্ধের বিরোধিতা করে শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর কবিতায় যেমন একটি প্রতিবাদের সুর, তেমনি আছে গভীর দার্শনিক চিন্তাধারা, যা পাঠকদের চিন্তাকে উজ্জীবিত করে। দরোজা – কবিতায় তিনি বলেন-
আমাদের এখন বাইরে যেতে হবে/ ঘরটা ভীষণ শীতল এবং অন্ধকার/ কয়েদি সেলের মতো সংকীর্ণ দরোজা/ প্রিয় স্বজনের কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাচ্ছি/
অনুভবে তাদের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি – স্পর্শে অবয়/ তবু দেখতে পাচ্ছি না কাউকেই / একথা বিশ্বাস করি না যে – সব অন্ধকারে মানুষকে দেখা যায় না/বরং কোনো কোনো অন্ধকারে মানুষের মুখ খুব প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
এখানে মানুষের প্রতি রেজাউদ্দিন স্টালিনের বিশ্বাস এখানেই তিনি স্বতন্ত্র।
ভাষার অলংকার ও শৈলী
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর ভাষার বৈচিত্র্য এবং অলংকারের ব্যবহারে নতুনত্ব। সহজ ও গভীর ভাষার মিশ্রণে তিনি তাঁর কবিতাকে অসামান্য করে তুলেছেন। তাঁর কাব্যিক বাক্যবিন্যাস এবং শব্দের প্রয়োগ, অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তর্নিহিত দর্শনের জন্য তাঁকে আধুনিক বাংলা কবিতার এক অন্যতম স্রষ্টা বলে গণ্য করা হয়।
যখন বলেন-
বিচূর্ণ আয়নায় রক্তাক্ত শিশুর মুখ/কিন্তু শিশুটি মাতৃগর্ভে।
তখন আমাদের বিষ্ময়ের সীমা থাকে না।
কবির অবদান ও প্রভাব
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে রেজাউদ্দিন স্টালিনের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর কবিতাগুলি যে ধরনের প্রেরণা জাগিয়ে তোলে, তা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং নতুন প্রজন্মের কবিদের অনুপ্রাণিত করছে। পাঠকরা তাঁর কবিতার মাধ্যমে বিশ্বকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শিখেছেন এবং সাহিত্যকে মানবিক সম্পর্ক ও বিশ্ববোধের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে উপলব্ধি করেছেন।
উপসংহার
রেজাউদ্দিন স্টালিনের জীবন ও সাহিত্য বাংলা কবিতার একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। তাঁর সাহিত্যের মূল সুর মানবিকতা, প্রেম এবং শান্তির বাণী। কবির জন্মদিনে আমরা তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে নতুন করে তাকে আবিষ্কার করতে পারি এবং তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পারি। রেজাউদ্দিন স্টালিনের সাহিত্যকর্ম বাংলাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে এবং তিনি ভবিষ্যতেও আমাদের মাঝে তাঁর কবিতার মাধ্যমে জীবিত থাকবেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার বিভূতি সপ্রকাশিত।
লেখক পরিচিতি: আব্দুল্লাহ জাহিদ- কবি, প্রাবন্ধিক।