মম মজুমদার, কোলকাতা, ভারত থেকে: দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল। তার আগেই শুরু হয়েছিল ভাষা বিতর্ক। মাতৃভাষা আন্দোলনকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়।
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো।
প্রথম লড়াইটা শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ যখন উর্দু ভাষাকে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব দেন। ততোদিনে বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে আত্ম-অন্বেষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানে সার্ভিস কমিশন, মুদ্রা ডাকটিকিট এবং সরকারি সকল ক্ষেত্রে ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহার করা শুরু করেছিল যে কারণে বুদ্ধিজীবী মহল শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, আগামী প্রজন্ম মাতৃভাষা বাংলার বদলে উর্দু রাখলে সম্পূর্ণ অশিক্ষিত হয়ে থাকবে।
সেই সময় থেকে ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা বিক্ষোভ শুরু করে মাতৃভাষা বাংলার স্বপক্ষে। এর উপর কারণ ছিল ২০০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূ-খণ্ডের মানুষের সাংস্কৃতিক পার্থক্য অনেক। শুধু ধর্মের স্বপক্ষে যোগসূত্র রক্ষা করা কোনদিনই সম্ভব নয় সাধারণ মানুষ বুঝে গিয়েছিল।
সেই সময় পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাভাষীর সংখ্যা উর্দু ভাসির চেয়ে গরিষ্ঠ হলেও ১৯৪৮ সালের ২১ শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান এর রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা। এরপর একটি লক্ষ্য ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীদের ওপর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভুত্ব কায়েম করা।
১৯৫২ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য বিক্ষিপ্ত আন্দোলন করলেও এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল ১৯৫২ সালে ২৬ শে জানুয়ারি যখন উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
পূর্ববঙ্গের অধিবাসী ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা পল্টনে এসে নাজিমউদ্দিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে সমর্থন করে। সেই সময় এর তীব্র প্রতিবাদ ওঠে, সকলের চাইল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করতে।
খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল। তারপর দিনে অর্থাৎ ২৮ শে জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। মিটিং-মিছিল, সমাবেশ-সব নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে নানা তর্কবিতর্ক চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে একুশের কর্মসূচি পালনেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। সেই বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে রফিক, বরকত জব্বার, শফিউল্লাহ সহ নাম না জানা আরও অনেকেই শহীদ হন। ঠিক কতজন ওই সময় মারা গেছিল তার হিসেব পাওয়া যায়নি আজও পর্যন্ত।
ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল এই পৃথিবীতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। যার রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা।
একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীক। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহর থেকে বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে ভাষা শহীদদের স্মরণ করে হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে।
সকলের কণ্ঠে বাজে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’।
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিসত্তার শেকড়ে অনুপ্রেরণার দিন। আজ বাংলা ভাষার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে সম্মানের আসন লাভ করেছে।
এই ভাষায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি রচনা করে নোবেল পান। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বাংলাকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে গিয়েছিলেন।
একুশে ফেব্রুয়ারীর দিনটি উদযাপন করা শুরু হয় ১৯৫৩ সাল থেকে। এই দিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ খালি পায়ে প্রভাত ফেরিতে অংশগ্রহণ করে। শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধার সাথে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে সেই সব বীর বিপ্লবীদের প্রতি যাদের রক্তের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া সম্ভব হয়েছিল। সারাদিন ধরে প্রত্যেকের কালোব্যাচ পরিধান করে নানা আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্মরণে রাখা হয়।
বাংলা শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা নয় এটি বিশ্বের কাছে এক গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষা। ১৯৯৯ ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের অঙ্গীকার করে সারা বিশ্বের কাছে এবং সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়েছিল বিশ্ব দরবারে।
আজ বাংলা ভাষা বিশ্বায়ন প্রতিক্রিয়া চলমান। প্রতি মুহূর্তে বহিবিশ্বে ৩০টি দেশে ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয় চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ। সেখানে হাজার হাজার অবাঙালি প্রতিবছর বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছে।
বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা অসমের বরাক উপত্যকায়, আফ্রিকার সিয়ের লিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
রবীন্দ্র রচনাবলী ৩৩ খন্ড, লালনের গান ও দর্শন, চীন ও জাপান ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। সারা বিশ্বে অধিকারজনিত সংগ্রাম ও মর্যাদার প্রতীক হলো একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
জন্মের পর প্রথম মা ডেকেছিলাম
সে হলো বাংলা ভাষা
প্রথম ক্ষুধার অন্ন চেয়েছিলাম সেও ছিল বাংলা ভাষা।
যে ভাষায় প্রথম প্রেম এসেছিল তাও বাংলা ভাষা!
শয়নে স্বপনে চিন্তনে জীবনের প্রতি মুহূর্তে
যা কিছু উপভোগ হয়েছে তাও বাংলা ভাষায়!
আজ বিশ্ব মাঝারে পেয়েছো সাফল্য
রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রুয়ারির সহায়
হাজারো সেলাম ওই রক্ত ঝরা বিপ্লবীদের
যার রক্তে আমার একান্ত প্রিয় বাংলা ভাষা পেয়েছো
জগতের মাঝে উজ্জ্বলতম স্থান।
আমি গর্বিত, আনন্দিত!
আমি মুখরিত হয়েছি তোমার পরশ পেয়ে।