এবিএম সালেহ উদ্দীন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে: অনেক কষ্টের মধ্যে আরো একটি অপ্রত্যাশিত খবর শুনে হৃদয়টা বিগলিত। এই মহা সংকটকালে প্রিয়জনদের হারনোর বেদনা যে, কতটা যন্ত্রণাদায়ক, তার কোন ব্যাখ্যা নেই। স্তব্ধ হয়ে গেছি। অকল্পনীয়। একজন প্রাণবন্ত প্রিয় খালেক ভাই (কর্নেল অব: খালেকুজ্জমান) ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সকালবেলায় হার্ট অ্যাটাক করে আপনজনদের কাঁদিয়ে পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজেউন)। তিনি এক কন্যা ও এক পুত্র এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
খবরটি প্রথম দেখি ঠিকানা পত্রিকার প্রেসিডেন্ট প্রিয়সজ্জন জনাব এম এম শাহীনভাই’র একটি স্ট্যাটাস থেকে। অবিশ্বাস্য। অথচ একেবারেই সত্যি।
আফিয়া আপাকে কল দিয়ে আরো স্তম্ভিত হয়ে গেছি। তিনি বাকরুদ্ধ। শুধু বলছেন, ভাই আমার সব শেষ। তখনও মেয়ে অন্য স্টেট থেকে এসে পৌঁছেনি। শাহীন ভাই’র সাথেও কথা বললাম।
সত্যিই ভাবতে পারছি না। যখনই মনে পড়ে, শিউড়ে উঠছি। সবসময় দেখা হওয়া প্রিয় মানুষটিকে ভুলে থাকা যায় না। বিমুগ্ধ স্মৃতির পাহাড় চাপিয়ে তার এই আকস্মিক মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। কত বিরল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যায়। খালেক ভাই’র সাথে অনেক স্মৃতি।
তার সহধর্মিনী শামীম আরা আফিয়া একজন সংস্কৃতিমনস্ক কবি ও গীতিকার। শিল্প-সাহিত্যের হয়েই তার সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং শিল্প-সাহিত্যের অগণিত অনুষ্ঠানের সহযাত্রী। নিউইয়র্ক এর সাহিত্য আসরের নবীণ সময় থেকে শুরু করে তিনি ছিলেন জড়িত। সাহিত্য বিষয়ক যখনই অনুষ্ঠানে চেয়েছি, পেয়েছি।
নিউইয়র্ক এর সাহিত্য একাডেমি, একটি কবিতা সন্ধ্যা, বহুবচন, সাজুফতা সাহিত্য ক্লাব, ওমেন্স ক্লাব, বইমেলা, শিল্পকলা একাডেমি, হুমায়ূন আহমেদ ফাউন্ডেশন, গাঙচিল স্বদেশ ফোরাম, বনলতা, শিরি শিশু সাহিত্য আসরসহ অনেক ছোট-বড় অনুষ্ঠান এবং ঘরোয়া অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। নিউইয়র্ক এর সাহিত্য সাংস্কৃতিক অনেকের স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত থাকা আফিয়া নাটকেও তিনি অংশ নিয়েছেন। পৃথিবীর কী নিষ্ঠুর নিয়ম তাদের অনেকেই আমরা খোজটুকু নিতে কার্পণ্য করি।
আমার পরিবারের সঙ্গে তিনি এবং খালেক ভাই একীভূত হয়েছেন। এছাড়া আমাদের সাথে নিউইয়র্ক এর আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনের কয়েক বছর পুরোপুরি সম্পৃক্ত ছিলেন। আমাদের ম্যানহাটন থাকালীন সময়ে বাসায় এবং কুইন্স ভিলেজ এর বাসায় একাধিকবার খালেক ভাইসহ এসেছেন। আমাদের বাসায় সে সময় দেশের খ্যাতিমান তরুণ শিল্পী রেজওয়ান ও সংগীত শিল্পী মনিকা রায়, সাংবাদিক হাকিকুল ইসলাম খোকনসহ বেশ কিছু ঘনিষ্ঠজন ছিলেন।
খালেক ভাই’র জামাইকার হাইল্যান্ড এভিনিউ’র বাসায় আমার সহধর্মিনী রেজভীনসহ গিয়েছি এবং খাওয়া দাওয়া করেছি। রেজভীনের সঙ্গে আফিয়া আপার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
স্মৃতি সর্বদা মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কত স্মৃতি। মনে পড়ে, কয়েকবছর আগে স্বনামধন্য খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুস্তাফা জামান আব্বাসী ভাই, ভাবী অধ্যাপিকা আসমা আব্বাসী, শিল্পী আফিয়া আপা ও রেজভীন আমার গাড়িতে সুদূর পেন্সেলভ্যানিয়ায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিসেবী বন্ধুবর নূর ইসলাম বর্ষন, কবি সালেম সুলেরী, সংগীত শিল্পী নাজমা আনোয়ার ও বন্ধুবর শিল্পী আনোয়ার হোসেনসহ অনেকেই সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া পোকেপ্সি ও আলবানীসহ গিয়েছিলেন।সেইসব অনুষ্ঠানগুলোর উপস্থাপনায় ছিলাম।
শেষের দিকেও আফিয়া আপাকে কবিতারI অনুষ্ঠানে পেয়েছি। ক্লাব সনমে শতকন্ঠে বিজয়ের কবিতা, একুশের কবিতা ও স্বাধীনতার কবিতার অনুষ্ঠানে তিনি কবিতা পড়তে এসেছিলেন প্রিয় খালেক ভাই’র সঙ্গে।
শামীম আরা আফিয়া’র কবিতার বই আমাদের বাড পাবলিকেশন্স থেকে বের হয়েছিল।
বেশ কয়েক বছর আগে নিউইয়র্ক এর জুইস সেন্টারে শামীম আরা আফিয়া’র একক গানের সিডি’র প্রকাশনা অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। অনুষ্ঠানটিরও উপস্থাপনার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। সেই অনুষ্ঠানে আফিয়া আপা ছাড়াও তাদের কন্যা আয়েশা জামান সিনা সুললিত কন্ঠে গান করেছিলেন।
ভাবতেই পারছি না। শিউড়ে উঠছি।
বিমুগ্ধ স্মৃতির পাহাড় চাপিয়ে চলে গেলেন।কতটা বিমর্ষকাতর ও বেদনাহত হয়েছি এবং কষ্ট পেয়েছি তা বুঝানোর ভাষা জানা নেই। নিউইয়র্ক এর সাহিত্য আসরের নবীণ সময় থেকে শুরু করে অনেক শামীম আরা আফিয়া আপার এই জীবনসঙ্গী একাকার হয়েছিলেন। পরবর্তীতে নিয়মিতভাবে একটি কবিতা সন্ধ্যা ও সাহিত্য একাডেমি’র আসর সমূহে তার স্বতস্ফূর্ত যোগদানের পর্বে পর্বে উজ্জ্বলতর স্মৃতি মুগ্ধতা ছড়ায়।
একজন সুদক্ষ সেনা অফিসার এত বিনয়ী, এত ভদ্র হতে পারেন, তা বিরল। স্মৃতির পুষ্পায়নে এই সদা হাস্যজ্জ্বল মানুষটি আমাদের সাথে এত আপনরূপে মিশে গিয়েছিলেন তা বিস্মৃত হওয়ার নয়।
একজন ভালো মানুষ। সহজ ও নীরবভাবে জীবনযাপনকারী সদা হাস্যজ্জ্বল মানুষটি আপনরূপে মিশে গিয়েছিলেন, যা কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়। “কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মাউত” কুরআন পাকের মহা সত্যটিকে তিনি চির বিদায়ের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে, মৃত্যু হচ্ছে মহাজীবনের মহাযাত্রা। জামাইকা মুসলিম সেন্টারে ৮ ফেব্রুয়ারি তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আমরা শোকাহত। তার শোকগ্রস্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
সকলের কাছে একান্ত অনুরোধ। আসুন, আমরা এই মহত মানুষটির জন্য দোয়া করি। মহান আল্লাহপাক মরহুম খালেকুজ্জামান ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।