মুহম্মদ শামসুল হক, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র:
অসামান্য রণকৌশলে বহু যুদ্ধ-বিগ্রহে জয় লাভের পর দিগি¦জয়ী সম্রাট লীয়র গড়ে তুলেছিলেন দিগন্তবিস্তারী বিশাল সাম্রাজ্য। দোর্দ- প্রতাপ এবং অসামান্য সুখ্যাতির সাথে দীর্ঘ ৬০ বছর সাম্রাজ্য শাসনের পর ইংল্যান্ডের সাবেক প্রজাবৎসল মহারাজ লীয়রের বল-বীর্য হ্রাস পাওয়া ছাড়াও বার্ধক্যজনিত নানা রোগ-ব্যাধিও শরীরে স্থায়ী পালঙ্ক পেতে বসেছে। অগত্যা সুবিশাল সাম্রাজ্যের প্রজাসাধারণের দেখ-ভালের দায়িত্ব ৩ কন্যা গনেরিল, রেগান এবং কর্ডেলিয়ার উপর ন্যস্ত করে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন পলিতকেশ রাজা লীয়র। শুরুতে ডাকলেন নিজের বড় কন্যা এবং আলবেনীর ডিউকের বধূ গনেরিলকে। বিপত্নীক এবং বর্ষীয়ান পিতা লীয়রের প্রতি গনেরিলের মমত্ববোধ ও ভালবাসার কথা জানতে চাইলেন। বাকপটিয়সী এবং মিথ্যাচারিণী গনেরিল সভাসদস্যদের উপস্থিতিতে বলল যে, পিতার প্রতি তার মমত্ববোধ এবং হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার বর্ণনায় ভাষা হার মানতে বাধ্য। ন্যুব্জদেহ এবং কুব্জপৃষ্ঠ লীয়র কন্যা গনেরিলের অতিশয়োক্তি এবং বাগ্মিতায় বিগলিত হয়ে বিশাল সাম্রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ তাকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর ডাক পড়ল লীয়রের দ্বিতীয় কন্যা করনওয়ালের ডিউকের স্ত্রী চরম বিশ্বাসঘাতক, বাকপটু-শঠ ও ধুরন্ধর রেগানের। রেগান বলল, পিতার প্রতি ভালবাসার প্রশ্ন করে লীয়ন রেগানের সহজাত পিতৃভক্তি, শ্রদ্ধা এবং অপরিমেয় শ্রদ্ধাকে চরমভাবে অপমানিত করেছেন। ব্যক্তিগত জীবন, স্বামী-সংসার সব কিছুর চেয়ে রেগান তার পিতা লীয়রকে অধিক ভালবাসে। রেগানের বুদ্ধির মারপ্যাঁচে বিমুগ্ধ লীয়র তাকেও বিশাল সাম্রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

এবার ডাক পড়ল মায়ের অবর্তমানে লীয়রের পরম আদর-যত্ন এবং অকৃত্রিম ¯স্নেহবাৎসল্যে বেড়ে উঠা অকপট সত্যভাষিণী ছোট কন্যা কর্ডেলিয়ার। সত্যের পূজারী কর্ডেলিয়া বলল, মায়ের অবর্তমানে তোমার স্নেহবাৎসল্য এবং আদর-যত্নে আমার বড় হওয়া এবং বেড়ে উঠা। জন্ম এবং তোমার অপত্য স্নেহমমতার জন্য আমি তোমার কাছে চিরঋণী। তোমার স্নেহ-ভালবাসা, আদর- আহ্লাদের ডোরে আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও পরিণত বয়সে আমাকে অন্যের সাথে সংসার সাজাতে হবে, সংসারে নতুন মুখের আগমন ঘটবে। তখন সংসারধর্ম পালন করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তোমার প্রতি ভালবাসা-ভক্তি-শ্রদ্ধার ও সেবা-শুশ্রুষায় ব্যাঘাত ঘটা অস্বাভাবিক নয়। আজন্মের সত্যভাষিণী পরম আদুরে কন্যার অকপট সত্য ভাষণে ভীমরতি ধরা পলিতকেশ রাজা লীয়র তেলে-বেগুনে চটে গেলেন। সুযোগ বুঝে চরম মিথ্যাচারিণী এবং ধড়িবাজ বড় কন্যা গনেরিল এবং রেগান অশীতিপর বৃদ্ধ লীয়রের ক্রোধের প্রজ্বলিত আগুনে ঘি ঢালল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য রাজা লীয়র সেই মুহূর্তেই পরম আদুরে কন্যা কর্ডেলিয়াকে এক বস্ত্রে রাজপ্রাসাদ এবং রাজধানী ত্যাগের নির্দেশ দিলেন। রাজা লীয়রের চিরবিশ্বস্ত এবং পরম হিতৈষী সহচর কেন্টের আর্ল সম্রাট লীয়রের চরম অপরিণামদর্শী এবং ভুল সিদ্ধান্তে বিস্ময়বিমূঢ় ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। কর্ডেলিয়ার সততায় বিমুগ্ধ ফ্রান্সের রাজা তার প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিলেন। ফ্রান্সের রাজার সাহসিকতা ও সততায় বিমুগ্ধ কর্ডেলিয়া সকলের উপস্থিতিতে ফ্রান্সের রাজাকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিলেন। স্বামীসহ রাজপ্রাসাদ ত্যাগের পূর্ব মুহূর্তে অশ্রুবিগলিত নয়নে কর্ডেলিয়া পিতার পদযুগল চুম্বনপূর্বক তার আশীর্বাদ ভিক্ষা করলেন। বুকের উপর পাথরচাপা দিয়ে পলিতকেশ লীয়রও অশ্রুসিক্ত বদনে কন্যা কর্ডেলিয়াকে বিদায় দিলেন। কর্ডেলিয়া স্বামীসহ অতি দ্রুত রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করলেন।

বস্তুত কর্ডেলিয়ার রাজপ্রাসাদ ত্যাগের পর থেকেই বয়ঃবৃদ্ধ লীয়রের অন্তরে রাবণের চিতাসম অশান্তির অনল দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করল এবং আজীবনের পুঞ্জীভূত পাপের প্রায়শ্চিত্ত শুরু হয়ে গেল। রোগ-ব্যাধি ছাড়াও অশ্রুসিক্ত কর্ডেলিয়ার স্মৃতি লীয়রের মানসপটে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত সতত বইতে লাগল। সাম্রাজ্য বন্টনের দ্বিতীয় দিবসে বুকভরা আশা নিয়ে রাজ্যশূন্য সম্রাট লীয়র শতাধিক দাস-ভৃত্য-অমাত্য সমভিব্যাহারে হাজির হলেন বড় কন্যা আলবেনী ডাচ গনেরিলের প্রাসাদে। পিতা-কন্যার চার চোখের প্রথম সাক্ষাতে বৃদ্ধ লীয়রের যাবতীয় আশা-আকাঙ্খা কর্পূরের মত হাওয়ায় মিশে গেল। গৌরচন্দ্রিকায় সময়ক্ষেপণ ছাড়াই ক্রুদ্ধা গনেরিল বলল, বাবা তুমি ত এখন রাজা নও, এমন কি সামান্য ভিটেমাটির মালিক প্রজাও নও; অন্যের অনুকম্পা নির্ভরশীল নেহায়েত পরাশ্রয়ী জীব। লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে লোক-লস্করের বিশাল বহর নিয়ে আমার বাড়ি এসেছ মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য। তোমাকেসহ সর্বোচ্চ ২০/২৫ জনের দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করব আমি। গনেরিলের নিষ্ঠুর আচরণে অপরিণামদর্শী লীয়রের পাকা ধানে মই পড়ল এবং কর্ডেলিয়ার প্রতি রূঢ় আচরণের জন্য বোবা কান্নায় ফেটে পড়লেন। পরাশ্রয়ী জীবনের অভিশাপ, আহার-নিদ্রায় অনিয়ম এবং সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তার ফলে ২ দিনের মাথায় লীয়র মেজ কন্যার বাাড়ি যাওয়ার চিন্তা শুরু করলেন। সৌভাগ্যবশত এ সময় লীয়রের সারাজীবনের বিশ্বস্ত অনুচর এবং পরামর্শদাতা আর্ল অব কেন্ট গনেরিলের প্রাসাদে হাজির হলেন এবং লীয়রের নিকট নিজকে কেইয়াস ছদ্মনামে পরিচয় দিলেন। লীয়রের প্রতি কন্যা গনেরিলের নির্মমতাকে ছদ্মবেশী কেইয়াস- দ্য কার্ট ইজ ড্রইং দ্য হর্স (গাড়ি ঘোড়া টানে প্রবাদে) আখ্যায়িত করে লীয়রকে ভেঙ্গে না পড়ার পরামর্শ দিলেন।

যাহোক, সম্রাট লীয়রকে লাঠি-জুতায় আদর শুরু করে তৃতীয় দিবস সাতসকালে অর্ধচন্দ্র দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন তারই পরম আদুরে কন্যা নাম্নী বাঘিনী গনেরিল। অগত্যা কেইয়াস ও ২ জন অনুচরসহ বর্ষীয়ান লীয়র মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের আশায় পা বাড়ালেন দ্বিতীয় কন্যা রেগানের প্রাসাদ অভিমুখে। শঠতা, কপটাচারিতা, ধড়িবাজি এবং মনুষ্যত্ব বিবর্জিত রেগান বড় বোন গনেরিলের চেয়েও কয়েক গুণ আগ বাড়া ছিল। তাই লোকমুখে নিজ প্রাসাদে পিতার আগমন বার্তা শোনামাত্রই ঝাটা হস্তে পিতা ও তার লোকজনকে খেদানোর জন্য প্রস্তুতি নিল রেগান। পিতাকে দেখামাত্রই এক গাল বিষবাষ্প উদগীরণ করল রেগান। ক্লান্ত ও অবসন্ন লীয়রকে বলল, দারিদ্র্য ও অসহায়ত্ব তোমার সাধারণ বিবেক-বুদ্ধিকেও গ্রাস করেছে। লজ্জা-শরমের বালাই থাকলে মেয়ের আশ্রয়ে লোক-লস্কর নিয়ে আসতে না। নিজ কৃতকর্মের জন্য গনেরিল এবং তার স্বামীর নিকট ক্ষমা চেয়ে তাদের আশ্রয়ে ফেরত যাও। উত্তপ্ত কড়াই থেকে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে উত্তরণের আকস্মিকতায় বিস্ময়বিমূঢ় ও চরম ক্ষুব্ধ লীয়র উন্মাদ বনে গেলেন। প্রলাপের সুরেও নবতিপর বৃদ্ধ লীয়র বকতে লাগলেন,

হে জগদীশ্বর আমার চরম বেঈমান-বিশ্বাসঘাতক দুই কন্যাকে সমুচিত শাস্তি দেয়ার জন্য আমি তোমার দরবারে প্রার্থনা জানাচ্ছি। হে বিশ্ববিধাতা- ভূমিকম্প, বজ্রপাত এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে তাদের সমূল বিনাশ কর।
অকস্মাৎ সূচিভেদ্য অন্ধকার চারদিক আচ্ছাদিত করে ফেলল এবং মুহুমুহু বজ্রপাতে সমগ্র সাম্রাজ্য থর থর করে কাঁপতে শুরু করল। সেই বর্ণনাতীত ভীতিবিহ্বল পরিবেশ এবং সূচিভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে উন্মাদ লীয়র প্রাসাদ থেকে একাকী বেরিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগল। আর্ল অব কেন্ট বা ছদ্মবেশী কেইয়াস ছাড়া সেই চরম যুগসন্ধিক্ষণে শিরে সংক্রান্তি নিয়ে কেউই লীয়রের পেছনে ছুটলনা। অবশেষে তারা একটি পরিত্যক্ত পর্ণকুটিরের সন্ধান পেলেন। সেই কুটিরে বহু কষ্টে রাত যাপনকালে কেইয়াস নিজের ছদ্মবেশ খুলে ফেলে নিজকে লীয়রের সম্মুখে তার চিরপরিচিত আর্ল অব কেন্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। অবশেষে রাতের শেষ প্রহরে আর্ল অব কেন্ট উন্মাদপ্রায় গুরুতর অসুস্থ রাজা লীয়রকে বহু কষ্টে নিজ আলয়ে নিয়ে আসেন এবং তার সেবা-শুশ্রুষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে আর্ল অব কেন্ট রাজা লীয়রের প্রতি তার ২ কন্যার পাশবিক আচরণ এবং প্রয়োজনীয় প্রতিশোধ গ্রহণের বার্তা নিয়ে কর্ডেলিয়ার প্রাসাদে হাজির হলেন। সবিস্তারে সব কিছু জানার পর কর্ডেলিয়ার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ শুরু হল। আর্ল অব কেন্ট এবং কর্ডেলিয়া তার স্বামীর নিকট করজোড়ে মিনতি জানালেন ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীর সাহায্যে গনেরিল এবং রেগানের সাম্রাজ্যে অভিযান চালিয়ে তাদের সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য। তার পূর্বে আর্ল অব কেন্টের প্রাসাদে কর্ডেলিয়া অসুস্থ পিতা লীয়রের সাথে সাক্ষাৎ করলে পিতা-কন্যা পরস্পরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ফেটে পড়লেন। এদিকে, ফ্রান্স বাহিনীর আক্রমণের খবর পেয়ে গনেরেলের স্বামী ডিউক অব আলবেনী এবং রেগানের স্বামী ডিউক অব করনওয়াল এক বিশাল বাহিনীসহ প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করল। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ফ্রান্সবাহিনী পরাজিত হল এবং বুড়ো রাজা লীয়র ও কর্ডেলিয়া বন্দী হলেন। কারাগারে কর্ডেলিয়াকে খুন করা হল এবং কন্যার মৃতদেহ দেখার পর বুড়ো লীয়র গগনবিদারী আর্তনাদ করে বলল, হে বিশ্ববিধাতা- তোমার বিশাল সাম্রাজ্যে লাখ লাখ কুকুর-বিড়াল-বন্য প্রাণী অবাধে বিচরণ এবং বেঁচে থাকার সুযোগ পাচ্ছে। অথচ রাজা লীয়র এবং তার ভাগ্যাহত কন্যা কর্ডেলিয়ার মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও শেষ পর্যন্ত তুমি কেড়ে নিলে। এরপর তার প্রাণহীন দেহ কর্ডেলিয়ার মৃতদেহের পাশে লুটিয়ে পড়ল। এদিকে লীয়রের বড় কন্যা গনেরিল এবং মেজ কন্যা রেগান একই ব্যক্তি আর্ল অব গ্লুসেস্টারের সাথে গোপন প্রণয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ল। খবরটি রাষ্ট্র হওয়ার পর আর্ল অব আলবেনী নিজ স্ত্রী গনেরিল এবং বিধবা শ্যালিকা রেগানকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে তাদের পাপের সমুচিত বিধান করলেন।
লেখক: সহযোগি সম্পাদক, সাপ্তাহিক ঠিকানা, নিউইয়র্ক।