শেখ মহিতুর রহমান বাবলু, লন্ডন, যুক্তরাজ্য থেকে: আর কয়েকদিন পরই ৪ মে আসছে। প্রতিবছর ৪ মে আসে ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের হৃদয়ে শোক আর কষ্টের দীর্ঘশ্বাস হয়ে। এদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের জন্য বেদনাবিধুর ও বিভীষিকাময় দিন এটি। ১৯৭৮ সালের এই দিনে বর্ণবাদীদের নির্মম হামলায় নিহত হন আলতাব আলী। রচিত হয় ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। শুরু হয় দিন বদলের পালা। সেদিন থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা করে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বলা হয় ১৯৭৮ সালের ৪ মে ছিল এদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের টার্নিং পয়েন্ট।
আলতাব আলী নিহত, সেদিন এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে ভীতি ও ক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিঝরা সেই দিনগুলোতে ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ ভাবে নিজেদের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামে সকলে সামিল হতে থাকে । গড়ে ওঠে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের মঞ্চ। কিন্তু শহীদ আলতাব আলী হত্যার মধ্যে দিয়ে সেদিন শেষ হয়নি বর্ণ ও জাতি বিদ্বেষের নৃশংস অত্যাচার। শুধু জাগিয়ে তুলেছিল এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। জন্ম দিয়েছিল এক নতুন জাগরণের।
যুগ যুগ ধরে পূর্ব লন্ডনে অভিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। এই এলাকায় বর্ণবাদী গোষ্ঠী বরাবরই ছিল সক্রিয়। প্রশাসনের নাকের ডগায় চলতো নাশকতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ সব অনিয়ম দেখেও না দেখার ভান করতো।
প্রশাসনের এ সব উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে সত্তরের দশকে বর্ণবাদী গোষ্ঠীর নির্মমতা চরমে পৌঁছায়। কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের অনুসারীরা এলাকায় একের পর এক সহিংসতা চালাতে থাকে। আলতাব আলী হত্যার পরে উল্লসিত হয়ে এরা তাদের সদর দপ্তর স্থানান্তর করে পূর্ব লন্ডনের সেন্ট মেরিস পার্কের কাছে নিয়ে এলে এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। তাদের জীবন থেকে অতিবাহিত হতে থাকে নির্ঘুম রজনী।

বর্ণবাদী হামলায় ১৯৭৮ সালের জুন মাসে হ্যাকনি এলাকায় ইশহাক আলি নামে মারা যান আরো এক ব্যক্তি। এতে অভিবাসীদের উত্তেজনার পারদ আরো উর্ধমুখী হয়। সার্বিক এ সব বিষয় বিবেচনায় এনে সেদিন অভিবাসীরা বুঝতে পেরেছিলো যে শুধু আলোচনা, সমালোচনা, মিটিং মিছিল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করে এদেশে বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে পৌঁছাতে হবে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে ।
শুরু হলো ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবার নতুন পথ চলা। অবশেষে নব্বইয়ের দশকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কঠোর আন্দোলনের ফলে পুলিশ ও প্রশাসন বর্ণবাদ মোকাবেলায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়। কমে আসে সহিংসতা। যার সুফল এখনও ভোগ করছি আমরা। সুতরাং যে কোনো বিবেচনায় বলাই বাহুল্য শুধু যুক্তরাজ্য নয় বরং শহীদ আলতাব আলী গোটা বিশ্বের প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এক অবিভাজ্য সত্তা। তিনি নিজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে ব্রিটেনের অভিবাসী ইতিহাসের বাঁক-ঘোরানো এক সিংহপুরুষ।
কে এই আলতাব আলী? কেন এবং কিভাবে হত্যা করা হলো তাকে?
১৯৫৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী আলতাব আলী সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সৈয়দরগাঁও ইউনিয়নের মোল্লাআতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা হাজী আব্দুস সামাদ ও মা সোনাবান বিবি। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে আলতাব আলী ছিলেন সবার বড়। তিনি লেখাপড়া করেছেন মুল্লাআতা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও গোবিন্দগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে।

১৯৬৯ সালে প্রবাসী চাচার সাহায্যে আলতাব আলী পাড়ি জমান বিলেতে। সেখানে তিনি থাকতেন পূর্ব লন্ডনের ওয়াপিংয়ে। বস্ত্র শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন বাংলা টাউনের ব্রিকলেন সংলগ্ন হানবুরি স্ট্রিটের একটি পোশাক কারখানায়। ১৯৭৫ সালে আলতাব আলী প্রথম বারের মতো দেশে গিয়ে বিয়ে করেন। নবপরিণীতা স্ত্রী জাহানারা বেগম কে নিজ বাড়িতে রেখে ছয় মাস পর আবারো জীবিকার তাগিদে ফিরে আসেন লন্ডনে। স্বপ্ন ছিল পরিবারকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেবেন। প্রিয়তমা জীবন সঙ্গীকে নিয়ে আসবেন লন্ডনে। কিন্তু তার সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।
১৯৭৮ সালের ৪ মে। সে দিন ছিল স্থানীয় সরকার নির্বাচন। কাজ শেষে বাজার করে বাসায় ফেরার পথে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে অজ্ঞাত কয়েকজন বর্ণবাদীর হাতে ২৫ বছর বয়স্ক আলতাব আলী নির্মমভাবে নিহত হন। তার ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল তিন শ্বেতাঙ্গ কিশোর- রয় আর্নল্ড, কার্ল লাডলো এবং আরেক কিশোর। আর্নল্ড আর লাডলোর বয়স ছিল ১৭। অন্যজন ছিল ১৬ বছরের কিশোর। তারা আলতাব আলীকে চিনতো না। অন্য বর্ণের মানুষকে মারাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
বর্ণবাদীরা তখন শ্যামলা বর্ণের মানুষ দেখলে ‘পাকি’ বলে গালি দিত।গ্রেফতারের পর একজন ঘাতক কিশোর পুলিশকে বলেছিল, “আমরা পাকিদের দেখলে গালি দেই ,অর্থ নেই,মারধোর করি । আমি নিজেই অন্তত পাঁচবার পাকিদের মারধর করেছি।
মৃত্যুর এক মাস পর, দেশে আলতাব আলীর গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। নির্মম এই হত্যাকান্ড সেদিন গোটা বাংলাদেশি কমিউনিটিকে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি জুগিয়েছিল। দীর্ঘ দিন ধরে অত্যাচার সহ্য করে চলা মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল আলতাব আলীর তাজা রক্ত। অবশেষে বেঁচে থাকার জন্য লড়াইয়ে নামলে সেই সংগ্রামে বাংলাদেশিদের পাশে ছিলেন যুক্তরাজ্যের নিরীহ শ্বেতাঙ্গ, পাকিস্তানি, ভারতীয়, ক্যারিবীয় সকলেই।

আলতাব আলীর মৃত্যুর দশ দিন পর, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে প্রায় ৭ হাজার মানুষ তাঁর কফিন নিয়ে মিছিল করে। প্রথমে তারা যান লন্ডনের রাজপথ ধরে। কফিন কাঁধে মিছিল হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কয়ার এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছায়। সেদিন ঐ বিশাল জনতার কণ্ঠে ছিল শ্লোগান ‘কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ এক হও এবং লড়ো’ – ‘ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট- ইউনাইট এন্ড ফাইট।‘ এই গণবিস্ফোরণ যূক্তরাজ্যে বর্ণবিদ্বেষী অবস্থার পরিবর্তনের সূচনা হয় ।
১৯৯৮ সালে আলতাব আলী হত্যাকাণ্ডের স্থান সেন্ট মেরিস পার্ককে ‘শহীদ আলতাব আলী পার্ক’ নামে নামকরণ করা হয়। ১৯৯৯ সালে আলতাব আলী পার্কের দক্ষিণ প্রান্তে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি শহীদ মিনার যা বাংলাদেশি ভাষা-শহীদদের স্মরণে বহির্বিশ্বে বানানো প্রথম শহীদ মিনার। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। পরবর্তীতে আলতাব আলী পার্ক সংলগ্ন বাস স্টপের নামকরণও করা হয় কালের সাক্ষী এই মানুষটির নাম।

প্রতি বছর ৪ মে আলতাব আলী দিবস সহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে শহীদ আলতাব আলীকে স্মরণ করা হয় ব্রিটেনে। ঐ দিন টাওয়ার হ্যামলেটের নির্বাহী মেয়র, লন্ডনস্থ হাইকমিশনের উর্দ্ধতম কর্মকর্তা,স্থানীয় এমপি, আলতাব আলী ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ আলতাব আলী পার্কের শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শহীদ আলতাব আলীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এছাড়া মঞ্চায়িত হয় নাটক। টিভি চ্যানেল থেকে প্রচারিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠান। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় বিশেষ ক্রোড় পত্র।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল ব্রিটেনে এতো কিছু হলেও প্রবাসে বাংলাদেশিদের আত্মপরিচয়ের পথ সুগম করা আলতাব আলীর জন্ম স্থান সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সৈয়দরগাঁও ইউনিয়নের মোল্লাআতা গ্রামের কেউ তাকে চেনেনা। সেখানে তার নাম গন্ধের ন্যূনতম কোনো চিহ্ন নেই। সিলেট শহরেও তাকে চেনেন না কোনো মানুষ। তবে কি কালজয়ী এই মানুষটির কথা জানবে না দেশের আগামী প্রজন্ম? আলতাব আলীর ইতিহাস জানার কথা ছিল গোটা জাতির। কিন্তু, সে ইতিহাস সীমাবদ্ধ রইলো শুধু যুক্তরাজ্যে। এ লজ্জা কার?
আলতাব আলীর সেই আত্মদানের ইতিহাসে কি উজ্জীবিত হতে পারে না আমাদের নতুন প্রজন্ম? কিভাবে পারবে? অপ্রিয় হলেও সত্য যে, রাষ্ট্র, জাতিকে আলতাব আলীর ইতিহাস জানানোর এখনো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কোনো আগ্রহ নেই এর সাথে সম্পৃক্ত সিলেটের নেতাদের। এ কেমন দেশ এ কেমন জাতি যারা বীরের সম্মান দিতে পারে না! এ কেমন সরকার এ কেমন জনতা যারা আলতাবের রক্তের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না!

আজকের যে শিশু বেড়ে উঠছে প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে। কাল সেই শিশু কিভাবে জানবে কেমন ছিল ৭০’র দশকে তাদের পূর্বপুরুষ ব্রিটেনের প্রবাসী বাংলাদেশিদের দুর্বিসহ দিনগুলোর কথা। সুতরাং আমার দাবি- বীর শহীদ আলতাব আলীর ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনে ৪ মে আলতাব আলী দিবস বিশেষ ভাবে পালন এখন সময়ের দাবি। ঢাকা ও সিলেট শহরে আলতাব আলী চত্বর তৈরী করে জাতির এই সূর্য সন্তানের ইতিহাস সর্বসাধারণের জন্য লিপিবদ্ধ করা ভীষণ প্রয়োজন। সেখানে প্রতিবছর আয়োজন করতে হবে বিশেষ অনুষ্ঠানের। সিলেট, লন্ডন সহ বহির্বিশ্বে বৈশাখী মেলার আদলে আলতাব আলী মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। এ ছাড়া ছাতকের মুল্লাআতা গ্রামে স্কুল কলেজ পাঠাগার রাস্তাঘাট ইত্যাদির নামকরণ আলতাব আলীর নামে করলেই তার স্মৃতি ধরে রাখা সহজ হবে।
দেশে আলতাব আলীর দুই ভাই এক বোন চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিন যাপন করছেন। মানবাধিকারের সূতিকাগার ব্রিটেন সরকারের কাছে আবেদন আলতাব আলীর পরিবারকে পুনর্বাসন করা হোক। আলতাব আলী থাকতেন ওয়াপিংয়ে,কাজ করতেন হানবুরি স্ট্রিটে, নিহত হয়েছিলেন এডলার স্ট্রিটে। এই তিনটা রাস্তার অন্তত একটি আলতাব আলী স্ট্রিট নামকরণ করারও জোর দাবি জানাচ্ছি। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ আলতাব আলীর স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট লেখক ও টিভি উপস্থাপক।