নজরুল ইসলাম টিপু, আবুধাবী, ইউএই
বাবা-মা বিশ্বাস করে না যে, আমার চাকরি নেই, বড় কষ্টে আছি। কবেতক পেটভরে খেয়েছি মনে করতে পারছিনা। তারা এসবের কিছুই বিশ্বাস করে না! যতই কষ্টের কথা বলি, যেভাবে বুঝাই, তারা তাদের প্রিয় পুত্রের কথাকে বিশ্বাস করে না! তাদের বিশ্বাস স্ত্রীকে সুখে রাখার জন্যই টাকা লুকাচ্ছি। অথচ স্ত্রীও তাদের সাথে থাকে! তাদের সোজা কথা, নতুন স্ত্রীর কারণেই আমি খারাপ হয়ে গিয়েছি; তাই আগের মত আর টাকা দিচ্ছি না। এই অন্ধ সন্দেহের কারণে স্ত্রীকে তারা এক মুহূর্তের জন্যও সুখ দেয় না। খোটা, টিপ্পনীর উপর সর্বদা অতিষ্ঠ করে রাখে। তারা বুঝতে চায় না, বিদেশের চাকরীতে কখনও বেতন বন্ধ হতে পারে, কখনও কমেও যেতে পারে। তাছাড়া তাদের ছেলেও আর আগের মত তরুণ নয়। বউকে সান্ত¡না দেবার জন্য কখনও কর্জ করে ফোন করি। আর মা-বাবা ভাবেন কোন চক্রান্ত করছি। তাদের সামনে কথা বললে, বউকে প্রশ্ন করে, তোমাকে কানে কানে কি বলেছিল? সামনে-পশ্চাতে যেভাবেই কথা বলি, স্ত্রীকে আক্রমণ করবেই!
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে এসব বলছিলেন ভিসা ও চাকরীবিহীন এক রেমিটেন্স যোদ্ধা। তিনি বলছিলেন, দু’মাসের খানার বিল বাকি, একটি প্যান্ট ও এক শার্ট পড়েই আছি। রোজার আগে বহুজন থেকে ধার-কর্জ করে বাবার জন্য পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম। এই টাকা পেয়ে বাবা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন! তিনি চিল্লাচ্ছেন! এই টাকা দিয়ে তিনি কিভাবে রোজার মাসের সংসার চালাবেন! এভাবে চিল্লায়ে তিনি পুরো গ্রাম মাথায় তুলছেন। টলমল চোখে যুবক বলল, আমি নিশ্চিত জানি গ্রামীণ জীবনে রোজা পার করার জন্য এই টাকাটা মোটেও কম নয়।
কোম্পানির লাইসেন্স এর কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি। স্বয়ং কোম্পানির ম্যানেজারেরও ভিসা নেই। মালিক জানিয়েছে বিপদের দিনে সবাই কেটে পড়েছে, তুমিও চলে গেলে এই মরা কোম্পানি আর দাঁড় করানো সম্ভব হবে না। সমস্যাটা সাময়িক, ইনশায়াল্লাহ্ অল্পদিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তার এই সাময়িক সমস্যা দুই বছরের বেশী সময় পার হবার পরও ঠিক হয়নি। এখন আর ইচ্ছা করলেই আর দেশে ফিরে যাওয়া যাবে না। মামলা হবে, আদালতে তার ফায়সালা হবে, তবেই সিদ্ধান্ত আসবে। সমস্যা ভেদে জরিমানা কিংবা জেলও হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে এই ধরনের কাছাকাছি সমস্যা অনেকেরই আছে। আমিরাতে বাংলাদেশিদের জন্য নতুন ভিসা বন্ধ। এমনকি এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানিতে ভিসা হস্তান্তর পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশিরা দক্ষ হওয়া সত্তে¡ও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশ্বের সমুদয় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশিদের এই দুরবস্থার কথা জানে। তাই তারা বাংলাদেশিদের বেতন বাড়ায় না, প্রমোশন দেয় না, সুবিধাদি কমানোসহ নানাবিধ হয়রানি করে থাকে। এসব নিয়ে প্রতিবাদ করার সুযোগ এখানে সীমিত। এ দেশের আইন বলে, দু’মাসের বেতন না পেলেই কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা কর। সরকার তা পাইয়ে দিবে কিন্তু তাকেও চাকরি ছেড়ে দেশে চলে যেতে হবে। এটা আরো জটিল। মৌন গোস্বা, অভিমান কিংবা রাগ করলে, ওয়ার্নিং লেটার জুটবে, সোজা বলে দিবে, পছন্দ না হলে ভিসা বাতিল করে দেশে চলে যাও। প্রচুর টাকা খরচ করে প্রবাসে এসেছে, এখনও বহু টাকা কর্জ বাকি তাই মনে মনে গোস্বা দেখালেও অধিকাংশ বাংলাদেশির পক্ষে ভিসা বাতিল করে যাওয়া সম্ভব হয় না। এই অসুবিধার কথা জেনেই কোম্পানিগুলো বাংলাদেশিদের তির্যকপূর্ণ ধমক দেয়।
মূলত এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের জন্য কোন অভিভাবক নেই। বরং বাংলাদেশের খেয়ে পদে বসে পিন মারার মানুষ আছে। অনেক তো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা মারতে আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলে বসে, ‘কি দরকার বিদেশে থেকে, দেশে এসে রিক্সা চালিয়ে খাও!’ কিন্তু প্রতিনিয়ত ফ্রি ভিসার নামে দলে দলে অকর্মণ্য ব্যক্তিরা কাজের সন্ধানে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে, তাদেরকে উপদেশ দেবার হিম্মত কি এদের আছে? নিজের দেশে কাজের পরিবেশ থাকলে, কোন মানুষই নিজের মাতৃভূমি পাড়ি দিয়ে বিপদসংকুল পরিবেশে জীবন চালাতে চায় না। সমাজ ও জীবন তাদের বাধ্য করে। যেহেতু তারা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে, নিজের বুকের সাহসকে পুঁজি করে, জীবনের এই চরম ঝুঁকি গ্রহণ করে, তাই তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া পুরো জাতির কর্তব্য। পক্ষান্তরে তাদের মাধ্যমে তো পুরো জাতি উপকৃত হয়। দেখা গেছে, জীবনে কেউ একবার প্রবাসী হলে, বাকী জীবনে সে আর দেশীয় জীবনে সুবিধা করতে পারে না। প্রবাসের অগ্রগামী দক্ষতা দেশের পিছিয়ে পড়া কারিগরি ক্ষেত্রের কোথাও কাজে লাগাতে পারে না। ফলে প্রবাসীর জীবন প্রবাসেই শেষ হয়। কেবল মৃত্যুর জন্যই তাদেরকে শেষ বয়সে দেশে ফিরে আসতে হয়।
প্রতিটি পরিবারের উচিত, তাদের প্রবাসী সন্তানদের প্রতি সদয় আচরণ করা। তার আয়ের প্রতি সুবিচার করা। স্ত্রীদের উচিত স্বামীর আয়কে যথাযথ হেফাজত করা। প্রবাসী যদি শান্তিতে থাকে, তার স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, মন ভালো থাকবে, সে সদা কর্মক্ষম থাকতে পারবে। আর প্রবাসের জন্য এটাই সবচেয়ে বেশী দামী সম্পদ। স্বাস্থ্যহানী হয়ে প্রবাসীরা দেশে ফিরে আসলে, তা পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র কারো জন্য উপকারী হয় না। আমাদের সমাজে দেখা যায়, ঘরের একজন প্রবাসী হলেই সে পরিবারের চালচলনের ধরণ বদলে যায়। আগে পিতার কাছে মুদির দোকান থাকলে, তিনি সেখান থেকে ইস্তফা দেন। হাট-বাজারে হেটে যাবার অভ্যাস ছিল তো, সন্তান প্রবাসী হবার পর থেকে পিতা রিক্সায় যাতায়াত করেছেন। এভাবে অনেকে পরিবারের জীবন চিত্র বদলিয়ে নেন। নিজেরা দু’টাকা আয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে প্রবাসী সন্তানের আয় দিয়েই জীবনে সুখের তালাশ খুঁজে। যখন দেখে একটি মাস কিংবা পরবর্তী মাসে সুখের জীবনে একটু ঘাটতি পড়তে পারে, তখন তারাই তার প্রবাসী সন্তান কিংবা স্বামীর উপরের কথার অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
তারা একটু চিন্তা করে না, তিনি বেঁচে আছেন বলেই কথার অস্ত্র চলছে, ধমক দেওয়ার সুযোগ চলছে। যদি কোন অঘটন ঘটে যায়, তারপর দিন থেকেই তারা মিসকিনে পরিণত হবেন। মানুষের কাছে কান্নাকাটি, হাত পাতা ব্যতীত কোন রাস্তা নেই, তাহলে কোন দিনই প্রবাসীর অর্থ দিয়ে অহংকার, দাম্ভিকতা, লোকদেখানো বাহাদুরি করার চিন্তা করতো না। তাই আমাদের সবার উচিত, প্রবাসীদের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং তাদের আয় যতদিন অব্যাহত থাকে, যথাযথ গুরুত্বের সাথে সেগুলো হিসেব করে খরচ করা। সর্বোপরি সেখান থেকেই কিছু অর্থ প্রবাসীর জন্য ধরে রাখা। তা হোক এক হাজার টাকা। এই ক্ষুদ্র সহযোগিতাও প্রবাসীর মনে অফুরন্ত সাহস ও হিম্মত যোগাবে।