ইসরাত জেবিন:
বাংলাদেশে গত প্রায় দেশ দশক ধরে সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে দেশে বা প্রবাসে যখন কেউ সাহস করে কথা বলতেন না, তখন থেকেই প্রতিবাদী, আপোষহীন কণ্ঠস্বর অব্যাহত রেখেছেন তিনি। দেশি-বিদেশি রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে নিবিড়ভাবে কাজ করে গেছেন। স্বৈরাচারের দুঃশাসন এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কখনও কলাম লিখেছেন, কখনও আবৃত্তি করেছেন, কখনও রাজপথে আন্দোলন করেছেন, নিয়মিত টক শোতেও উপস্থিত থেকে স্বৈরাচার ও ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করেছেন। বলছিলাম ব্রিটেন প্রবাসী তাসলিমা তাজের কথা।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা জীবন
তাসলিমা তাজের জন্ম ঢাকা শহরে। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহসী এবং প্রতিবাদী মনোভাবের অধিকারী ছিলেন। তার শিক্ষা জীবনের শুরু হয়েছিল ঢাকা শহরের মনিপুর স্কুলে, যেখানে তিনি এসএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তী শিক্ষা জীবন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তিনি অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য ব্রিটেনে পাড়ি জমান তাসলিমা তাজ। সেখানে বিজনেস অ্যান্ড ফাইনান্স ইকোনমিক্সে পড়াশোনা করেন।
ব্রিটেনে শিক্ষাজীবন চলাকালীন তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং নারীদের অবস্থান নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন।
পেশাগত জীবন ও সামাজিক কার্যক্রম
তাসলিমা তাজ বর্তমানে ব্রিটেনের এডুকেশন সেক্টরে কর্মরত আছেন। লোকাল গভর্নমেন্ট এর অধীনে সোশ্যাল সার্ভিস এবং যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থায় লিঙ্গুইস্টিক হিসেবে কাজ করছেন। আকর্ন ইন্টারন্যাশনাল, রাম্প, ওয়ার এর মতো সামাজিক সংগঠনগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। এছাড়া মানবাধিকার, নারী অধিকার, শিশু অধিকার এবং শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি। তার কাজের উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন এবং শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে সমাজে প্রতিবাদী ভাবনা তৈরি করা।
তাসলিমা সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে তার সাহসী অবস্থান নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া এবং টেলিভিশনে নিয়মিত বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট এবং বিগত আওয়ামী সরকারের দমনমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব রয়েছেন। বিশেষ করে তিনি হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে অনলাইনে স্বৈরাচারবিরোধী কবিতা আবৃত্তি ও ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে টকশোতে বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে জনগণকে সচেতন।
স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা
তাসলিমা তাজ বিগত শেখ হাসিনার শাসনকে ‘ফ্যাসিস্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার মতে, আওয়ামী স্বৈরাচার সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে তাদের নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করেছে। তাছাড়া, তিনি ভারতের বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক হস্তক্ষেপের বিষয়েও কঠোর সমালোচক। তিনি বাংলাদেশকে শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
তাসলিমা তাজ ইন্ডিয়া আউট মুভমেন্ট-তিস্তার পানির সুষমবণ্টন, সীমান্ত হত্যা, ৫৭ জন সেনা অফিসারকে নির্মম হত্যা, ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র ও বিদ্দেশমূলক মন্তব্য প্রচার ও ঘৃণা ছড়ানো, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের ক্রিমিনালদেরকে লালন পালন এবং পর পর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অবিরাম নগ্ন হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে দীর্ঘ দিন ধরে অনলাইনে জনসচেতনতা তৈরি করেছেন।
তিনি স্বৈরাচার ও ভারতীয় আগ্রাসনের প্রতিবাদে ‘তুই অবৈধ’ শিরোনামে একটি কবিতার ক্যাসেট বের করেছেন। এছাড়া ‘সাঁওতালি কথা’ শিরোনামে নিজের লিখা ও পরিচালনায় একটি শর্ট ড্রামা তৈরি করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকদের নিপীড়নের ওপর নির্মিত সাড়ে ৩ মিনিটের এই ড্রামা সেই সময় জোরালো ভূমিকা রাখে।
পতিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়তে তাসলিমা তাজ নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। কখনো হাউজ অব কমন্স এর কক্ষে, কখনো ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্ট এর সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন। গত জুলাই মুভমেন্টে তাসলিমা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি জুলাই গণহত্যা তুলে ধরতে বিভিন্ন ইংলিশ ভার্সনে ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করে বিভিন্ন এমপি, সিনেটর, চ্যানেল ৪, বিবিসিতে সরবরাহ করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে তাসলিমা
তাসলিমা তাজ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব, তার নেতৃত্বে জনগণের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। তবে, তিনি সরকারের কিছু কর্মকাণ্ডে হতাশা প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে ২০২৪ সালে ঘটে যাওয়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের যথাযথ চিকিৎসা ও আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে। তার মতে, সরকারের উচিত ছিল কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এবং জনগণের প্রতি ন্যায্যতার ব্যবস্থা করা।
ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাসলিমা
ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করছে বলে অভিযোগ করেন তাসলিমা। স্বৈরাচারী হাসিনার কারণে ভারত দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে বিভিন্ন দিক দিয়ে আগ্রাসন চালিয়েছেন উল্লেখ করেন তাসলিমা তাজ বলেন, কালচারাল থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী সবকিছুতে ভারত বাংলাদেশে আগ্রাসন চালিয়েছে। কিন্তু হাসিনার নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করার সাহস করেনি। বর্তমান অন্তর্বতী সরকার কিছুটা হলেও পররাষ্ট্রনীতিতে স্বোচ্ছার রয়েছে।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, মালদ্বীপের মুইজ্জু সরকার, নেপাল ও ভুটান সরকার ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারলে আমরা কেন পারব না? কূটনৈতিকভাবেই আমাদের এগুলো হ্যান্ডেল করতে হবে।
বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার জন্য ভারতের যোগসাজস আছে বলে অভিযোগ করেন তাসলিমা তাজ। এসব ঘটনার মাধ্যমে ভারত ফায়দা হাসিল করতে চায়। ভারত আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রমাণ করাতে চায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হচ্ছে।
পারিবারিক জীবন
তাসলিমা তাজ সুস্থ রাজনৈতিক ও সাংকৃতিক চর্চ্চার মধ্যে বড় হয়েছেন। তার বাবা মরহুম এম এ আজিজ ছিলেন ষাট এর দশকের একজন সফল ব্যবসায়ী এবং রাজনীতির একজন অন্যতম নিবেদিত সংগঠক। কলেজ জীবন সম্পন্ন করার পর পুরান ঢাকায় নিজের প্রকাশনীর ব্যবসা শুরু করেন এবং নির্ভীক ভাবে স্বাধীনতার পক্ষে সকল প্রচারণার কাজ গুলো দায়িত্বের সাথে অব্যাহত রাখেন। মাদারীপুরের আরেকজন কৃতি সন্তান সাবেক মন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদার, সাবেক মন্ত্রী সোহরাব হোসেন দের সাথে নিয়ে নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কাজ পরিচালনা করার জন্য অবাধে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়েছেন। পাকিস্তানের দ্বারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর্থিকভাবে হয়েছেন সর্বশান্ত। শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পরও যুদ্ধ জয়ের মনোবল হারাননি তার বাবা।