মুহম্মদ আজিজুল হক:
(এই গল্পটি সম্পূর্ণ কল্পনা আশ্রিত। এর সব চরিত্রগুলি এবং তাদের নামসমূহ পুরোপুরি কাল্পনিক। বাস্তবের কারো সাথে কোনো মিল বা সাদৃশ্য দেখা গেলে তা নেহায়েত কাকতালীয়।)
১৪ জুন ২০২২, মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যে ৭টা ২০ মিনিট। শরীয়তপুর জেলার জাজিরার ও মুন্সিগঞ্জের মাওয়ার পদ্মাপারের মানুষের মধ্যে হঠাৎ করেই ভীষণ শোরগোল শোনা গেল। ঐ দুটি অঞ্চলের আশেপাশের বিশ ত্রিশ গ্রামের মানুষ সহসা সচকিত হয়ে উঠলো। শোরগোলের মাত্রা জাজিরা পাড়েই বেশি। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ির বাইরে এসে কান পাতলো। তারা প্রথমটায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ভালো করে কান পেতে বুঝলো যে ওটি শোরগোল হলেও তা বিপদসূচক নয়, বরং আনন্দ শোরগোল মূলত: গলা ফাটিয়ে আনন্দের হৈচৈ। হাজার হাজার গ্রামবাসী, যার যা পরনে ছিল তাই পরেই, ছুটলো পদ্মাপারের দিকে। ঐ মহা হৈচৈয়ের কারণ বুঝতে খুব বেশি বিলম্ব হয় নি কারো। তরুণ ছেলের দল ছুটে আসছে গ্রামসমূহের দিকে। অবয়বে ও কন্ঠে তাদের আনন্দোল্লাস যেন ধরে না। তারা বলছে, দ্যাহো দ্যাহো, পদ্মায় আসমানের চান নামছে। জলদি যাও সগগলি, দ্যাহো। আমাগো সব গেরাম তো ঢাহার শহর হয়ে যাতিছে। শেখ হাসিনা আমাগো সব গেরামরে তো ঢাহার শহর বানায় দিতিছে। আমাগো আর কোনো কষ্ট থাকপি না। যাও দ্যাহো, পদ্মা সেতু ক্যামনে আলোর মালা হয়্যা জ্বলতিছে। যাও, যাও, দৌড়াও।” কর্ণ পরম্পরায় বিদ্যুতের আলোর মতো মুহূর্ত মধ্যে বিশ ত্রিশ গ্রামে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো। খবর শুনে ওসব গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই ছুটছে পদ্মাপাড়ের দিকে। গ্রামগুলোর সব রাস্তাঘাট, খেত-খামার, মাঠঘাট, চষা-অচষা জমি-জিরাত অবলীলায় পার হয়ে সকলেই ছুটছে রাতের আঁধার টুটে হঠাৎ আলোকিত হয়ে ওঠা পদ্মা সেতুর দিকে। যেতে যেতে যখন এক এক দলের নিকট বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত সেতু এবং সেতুর নীচে পদ্মার জলে আলোর ঝলকানি চোখে পড়ছে, আনন্দের আতিশয্যে তারা সমস্বরে চীৎকার কোরে উঠছে। বিস্ময়াভিভূত হচ্ছে। হিন্দু-মুসলমান নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী স্রষ্টাকে স্মরণ কোরে তাঁর কাছে কৃ্তজ্ঞতা প্রকাশ কোরছে। বলছে, আর আমরা কেউ গরীব থাকপো না। স্রষ্টা আমাগো দিকে এবার মুখ তুইলা তাকাইছেন। পোরধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারে আল্লাহ হাজার বছর আয়ু দিক। “সত্যিই তো, আমাগো এহানে তো আরাক ঢাহার শহর হবি। ঢাহা আর না গেলিও আমাগো চলবি। কী করিছে দেহিছো বঙ্গবন্ধুর মাইয়্যা শেখ হাসিনা, দেহিছো তোমরা। এমন ছবি তো জীবনে দেহি নাই। পদ্মার গলায় এট্টা আলোর হার। কীরোম জ্বলতিছে দ্যাহো।”
হৈচৈয়ের মাঝে যে কতজন কত কথা বলছে। সকলেরই মুখ থেকে যেন কথার তুবড়ি ছুটছে। কেউ একজন তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস কোরছে, “এই আজকে পদ্মার বিইয়া হইতাছে নাকি রে? এত্তো সুন্দর পদ্মারে কোনো রাতেই তো লাগে নাই। আজ পদ্মার বর আইছে, বিইয়া হইতাছে…….,” ব’লে নিজেই হাসির ফোয়ারা ছুটাচ্ছে। সেই হাসিতে অন্যরা যোগ দিচ্ছে। হাসির দ্যুতিতে তাদের সকলের মুখাবয়ব উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
কেউ একজন জানালো, “আজ সারারাত সব বাতি জ্বলবি। উদ্বেগের সুরে আরেকজন জিজ্ঞেস করলো, “ক্যান আজ থাইকা পোরতেক রাত্রি জ্বলবি না? স্থানীয় হাই স্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্র তাকে জানালো, “পঁচিশে জুন প্রধানমন্ত্রী এই সেতু উদ্বোধন করবেন। পরদিন ছাব্বিশে জুন থেকে প্রতিরাতেই সকল আলো জ্বলবে। এইখানে পদ্মার বুকে আর কখনো আঁধার থাকবে না”।
মতিদের বাড়ি থেকে পদ্মা সেতু স্পষ্ট চোখে পড়ে। সে গত পাঁচ বছর যাবৎ সৌদি আরবে ইলেক্ট্রিক্যাল মেকানিক হিসেবে চাকরি করে। ঢাকাস্থ বাংলাদেশ-জার্মান টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশ ওভারসীজ এমপ্লয়মেন্ট এন্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (BOESL)-এর মাধ্যমে সৌদি আরবে চাকরি পেয়েছিল। বাড়িতে মতির প্রৌঢ় বাবা মোখলেস মিয়া ও মা সখিনা বেগম থাকেন। মতি তাদের একমাত্র সন্তান। হঠাৎ কোরে পুরো সেতুতে আলো জ্বলতে দেখে তারা ভীষণ আনন্দিত ও কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। তারা মানুষের শোরগোলও শুনতে পান। দ্রত পায়ে এগিয়ে যান সেতুর দিকে। অন্যান্য অনেককেও দেখেন ছুটছে, তাদের সকলের অনেক আকাঙ্ক্ষিত ও প্রতীক্ষার সেতুর দিকে। নদীর বুকে আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত পদ্মা সেতু দেখে আনন্দে আত্মহারা তারা। বলতে গেলে তাদের চোখের সম্মুখেই গত সাত-আট বছর যাবৎৎ হাজার হাজার দেশী-বিদেশী কনসাল্ট্যাণ্টস, এক্সপার্টস, ইঞ্জিনীয়র্স, কন্ট্রাক্টরস ও দক্ষ শ্রমিকগণ তিলে তিলে নির্মাণ কোরেছেন প্রমত্ত পদ্মার ওপর এই বিশাল সেতু। এক মায়াময় ও স্বপ্নীল আলোকমালা নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত চলে গিয়েছে। ছয় কিলোমিটার দূরত্বের ওপারটা ঠিক দৃষ্টিতে আসে না, যদিও ওপারেও, অর্থাৎ মাওয়াপ্রান্তেও, এই সন্ধ্যায় মানুষের ঢল নেমেছে আলোর কুহকী আভরণে সজ্জিত পদ্মা সেতু দেখতে। এপারে আশেপাশের সব গ্রাম উজাড় কোরে মানুষের মিছিল এসেছে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক আজকের সান্ধ্যমিলনমেলায়। সংবাদ পেয়ে বেশ দূর থেকেও অনেকে এসে গেছে ইতোমধ্যে মটরবাইক, ভ্যান, পিকআপ, ইত্যাদিতে। কী এক অব্যাখ্যেয় সম্মোহনী ও আকর্ষণী শক্তি এসে ভর করেছে বিপুল এই ষ্টীল ও কংক্রীটের স্ট্রাকচারের ওপর! ভিড়ের মাঝে নিকটবর্তী এক ইউনিয়নের প্রবীণ চেয়ারম্যান খবীর মিয়াকে দেখা গেল। তিনি চীৎকার কোরে বোলছেন, “দ্যাখো তোমরা, চাইয়্যা দ্যাখো, বাপকা বেটি শেখ হাসিনার কীর্তি দ্যাখো! এক ভিত্তিহীন দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল বিশ্ব ব্যাংক। টাকা দ্যায় নাই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাতে দমে যায় নাই। দ্যাশের নিজস্ব টাকায় এই সেতু কোরেই ছাড়ছে আমাগো প্রধানমন্ত্রী। এমনটি কোরতে সাহস লাগে, বুদ্ধি লাগে, বুঝলে!
এই স্বতঃস্ফূর্ত ও অপরিকল্পিত জনসমাবেশে শুধু ছেলেরাই আসে নি। বাবা-মা, চাচা-চাচী, ভাই-ব্রাদারদের সাথে অনেক বালিকা, কিশোরী ও তরুণীরাও এসেছে। সমাবেশের আরেক স্পটে সমবেত ছাত্র-ছাত্রী ও অনেক তরুণ-তরুণীদের সাথে কথা বোলছিলেন, জাজিরা ডিগ্রী কলেজের একজন শিক্ষক। শিক্ষক বোলছেন, “প্রমত্ত পদ্মার কারণে আমাদের দেশের এই দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল এতকাল দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সুসংহত ছিল না; নিবিড় ও দ্রুত যোগাযোগের পথে বড় অন্তরায় ছিল এই বিশাল নদী। এতে কোরে এই অঞ্চল আর্থ-সামাজিক খাতে যতটা অগ্রসর হতে পারতো ততটা এগোতে পারে নি। এখন থেকে দৃশ্যপটে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে, ইনশাআল্লাহ। বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিলক্ষিত হবে এখন থেকে এই অঞ্চলে। সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় নদীর উভয় তীরে এবং পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও শিল্পনগরীসমূহ গড়ে উঠবে। বিনিয়োগ বাড়বে এবং সেই সঙ্গে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে যুবক-যুবতীদের জন্য। তোমার সহজেই চাকরি-বাকরি পাবে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থাকলে। বিশেষ কোরে বিভিন্ন ধরনের টেকনিক্যাল এডুকেশন ও প্রশিক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয় নিয়ে শিক্ষা খুব গুরুত্ব পাবে। এই বহুমুখী সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতির শ্রীবৃদ্ধি করবে। মংলা ও পায়রা বন্দর সরাসরি ঢাকার সাথে যুক্ত হওয়ায় এ দুটি সমুদ্র বন্দরের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃ্দ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ হ্রাস পাবে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃ্ত পণ্য এ দুটি বন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ কোরে সেগুলো এই সেতু দিয়ে পদ্মা পার হয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে সহজেই পৌঁছে যাবে। এখানে আর ফেরীঘাটের প্রয়োজন হবে না। হাজার হাজার বাস-ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিক-আপ, ইত্যাদি যানবাহনকে ঘণ্টার পর ঘন্টা বা দিনের পর দিন নদী পারাপারের অপেক্ষায় থাকতে হবে না। এই বিশাল অঞ্চলের কৃ্ষিজাত পণ্য, মাছ ও মুরগির খামারে উৎপাদিত পণ্য, ইত্যাদি, অতি সহজেই ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরগুলোতে কম ব্যয়ে পরিবহন করা যাবে। তাতে আমাদের এই অঞ্চলের কৃ্ষকগণ তাদের উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পাবে। আমাদের এই অঞ্চলে এখন পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। হলি ডে রিজর্ট, এ্যামিউজমেন্ট পার্ক, ইত্যাদি স্থাপিত হবে। সেখানে তোমাদের অনেকের কর্মসংস্থান হবে। অদূর ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যায়। সারা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুতই দেড় থেকে আড়াই শতাংশ বেড়ে যাবে এবং আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়বে। এই সেতুর কারণে, পদ্মার দু’পাড়ে দুটি নতুন শহর গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আমরা যদি আমাদের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির বর্তমান হার ধরে রাখতে পারি তাহলে ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে সামিল হবে। সেতুটিতে অচিরেই একটি রেল লাইন যুক্ত হতে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকার সারাটা দেশব্যাপী রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন কোরছেন। তোমরা এখান থেকে ট্রেনে উঠে দেশের যে কোনো বড় শহরে বা দেশের যে কোনো প্রান্তে যেতে পারবে –যেমন ঢাকা হয়ে রাজশাহী, পঞ্চগড়, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট। আর ঐ সকল স্থানে তো ২৬ শে জুন সকাল থেকেই সড়কপথে –ফেরীতে পদ্মা নদী পার হবার বিরক্তিকর ও দুঃসহ ঝামেলা এড়িয়ে –এই সেতু দিয়ে যেতে পারবো আমরা। আবার খুব শীঘ্রই এখান থেকে ট্রেনে কোরে এই দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের খুলনা, মংলা, বরিশাল, কুয়াকাটা, যশোর, আমাদের জাতির জনকের জন্ম ও সমাধিস্থল টুঙ্গিপাড়া এবং অন্যান্য আরো অনেক গন্তব্যস্থলে যাওয়া সম্ভব হবে। কত সব অসামান্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে এই পদ্মা সেতু; এবং কী এক সুখস্বপ্ন বাস্তবায়নের সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে আসছে আমাদের দেশের নিজস্ব অর্থে নির্মিত এই সেতু।” তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীরা সকলে নিবিষ্টচিত্তে ঐ শিক্ষকের কথা শুনছিল। তিনি যেন কোনো এক স্বপ্নলোক হতে এসে তাদেরকে এসব খুশির খবর শোনালেন। এক অনির্বচনীয় আনন্দ তাদের অবয়বে ফুটে উঠলো। পদ্মা সেতু যেন এক স্বপ্নবিহঙ্গঙ্গ। সেই বিহঙ্গের ডানায় চড়ে তরুণ প্রজন্ম এক স্বপ্নলোক পরিভ্রমণে যাবে। আর সেই স্বপ্নলোককে তারা বাস্তবের বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত কোরবে।
ভিড়ের মাঝে ছয় বছরের এক বালক তার মা’কে জিজ্ঞেস করে, “মা আজ রাত্রিই কি এই সেতু খুলে দেয়া হবি? আজ রাত্রিই গাড়ী-ঘোড়া চলবি?”
-না, বাবা, আজ রাত্রি না।
-“আজ রাত্রি না ক্যান? সেতু তো বানানো হইয়া গ্যাছে।” ছেলেটির আর তর সইছে না।
-আর মাত্র ১১ দিন পর এখানে বড় অনুষ্ঠান হবি। লাখ লাখ মানুষ আসবি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসবি। এই সেতু উদ্বোধন করবি। তার পর থাইক্যা সেতুডা গাড়ি-ঘোড়ার জন্য খুলা হবি।
-মা, আমি শেখ হাসিনারে দেখতি চাই।
-ঠিক আছে বাপ। ঐ দিন আমরা দ্যাখবো।
সব মানুষ ঘরে ফিরতে রাত প্রায় দুটো বেজে গেল। ফেরার পথে তারা বারংবার তাদের প্রাণের সেতুর দিকে ফিরে তাকায়। সেতুতে এবং পদ্মার জলে ঝিলমিল আলোর খেলা তাদের হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে তারা বাড়ি ফেরে। সেই রাতে ঘুমের মাঝে কত মানুষ যে কত স্বপ্ন দেখলো তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবে সকল স্বপ্নের হেতু ছিল পদ্মা সেতু। অধিকাংশ স্বপ্ন এলো তরুণ-তরুণীদের ঘুমে। কেউ কেউ দেখলো তারা টাই-স্যুট পরে বড় বড় হোটেলে ও মোটেলে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের। সেখানে পরিপাটী সাজে সুন্দরী তরুণীরা তাদের সহকর্মী। কেউ কেউ দেখলো তারা তাদের নতুন মৎস-খামার থেকে রাশি রাশি রুই-কাতলা ধ’রে দেশ-বিদেশে চালান দিচ্ছে। অনেক সুন্দরী তরুণীরা নিজেদেরকে বড় বড় বিজনেস প্রতিষ্ঠানে, হাই টেক পার্কে, শপিংমলে, ইত্যাদিতে চাকরিরত দেখলো। স্বল্পশিক্ষিত বেকার যুবকদের অনেকেরই আকাংখিত কর্মসংস্থান নিয়ে এলো সেই রাতের স্বপন। কোনো কোনো বিবাহকামী যুবকের স্বপনে ল্যাবণ্যময়ী কনেদের মুখ ভেসে উঠলো। অনেকেই আবার স্বপ্নে তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে নির্মিত সড়কে অসংখ্য বাস, ট্রাক, গাড়ি, ইত্যাদি ছুটতে দেখলো।
মতির বাবা-মা বাড়ি ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলো। তাদের মাথায় অনেকগুলো পরিকল্পনা বারবার ঘুরেফিরে আসছে। মতিয়ার রহমান ওরফে মতি তাদের একমাত্র সন্তান। সৌদি আরবে ভালো বেতন পায়। কিন্তু একমাত্র সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে তার মা-বাবার মনে শান্তি নেই। মতির প্রেরিত অর্থ দিয়ে বছর দুই আগে মোখলেছ মিয়া পদ্মা সেতুর নিকটে প্রতিষ্ঠিত সেনানিবাসের বাইরে যেখানে নতুন দোকানপাট বসছে সেখানে দুই কাঠা জমি কিনেছে। সেখানে কি ধরনের দোকান দেয়া যায় তা নিয়ে স্ত্রীর সাথে নতুন কোরে আলোচনা করলো। মোখলেছ মিয়া স্ত্রীকে বলে, “শোনো মতির মা, মতিরে কও আর দুই এক বছর ওদেশে চাকরি কইর্যা্ দ্যাশে ফির্যাক আসতি। এ্যাহোন, দ্যাশে আমাগো এই অঞ্চলে তার কত কাজ হবি। নতুন নতুন দালান-কোঠা, আপিস-আদালত, কল-কারখানা, সব জায়গায়ই তো ইলেক্ট্রিক মিস্তিরির কত কত কাজ থাকপি। সৌদিতে তার আর বেশিদিন থাকপার দরকার নাইক্যা। দ্যাশে কাজ কোরলি এ্যাহোন তার টাহা পরেও খাবি। তাছাড়া, ছাওয়ালডার বিয়াশাদী করতি দেরী হয়া যাতিছে। ওর এহোন বিয়াথা করা দরকার, কি কও, বউ? মতির মা সখিনা বিবি স্বামীর সব কথায় সায় দেয়। গভীর রাত পর্যন্ত এমনতরো অনেক আলাপচারিতার পর দু’জনে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে তাদের একটু বিলম্ব হয়। তবে তাতে কোনো অসুবিধে নেই। মোখলেছ মিয়া এক সময় তার নিজের স্বল্প জমিতে কৃ্ষিকাজ করতো। মতি বিদেশে চাকরিতে যাবার পর সব জমি বর্গা দিয়ে দেয়। নিজে এখন বাড়ির সামনের রাস্তার পাশে একটি দোকান চালায়। গ্রামীণ রাস্তাটি সরূ হলেও পাকা। অনেক ভ্যান, রিক্সা, ছোট ছোট পিক-আপ, ইত্যাদি চলে। গ্রামের লোকজনের চলাচলও কম নয়। বিক্রি বেশ ভা্লোই হয়।
ঘুম থেকে উঠে মতির মা মতির বাবার দিকে তাকিয়ে মিট মিট কোরে হাসতে থাকে। মতির বাবা বলে, “কী হলো তুমার এত খুশি খুশি লাগতিছে ক্যান?”
স্বামীর নিকট হতে এমনই এক প্রশ্ন আশা কোরছিল মতির মা। বললো, “গেল রাত্রি এট্টা মজার স্বপ্ন দেখিছি গো, মতির বাপ”।
-কি স্বপ্ন দেহিছো, কও।
-“দেহি, আমরা রেলগাড়িতে উঠ্যা পদ্মা সেতু দিয়ে যাতিছি। যাবো ককসো বাজারে সমুদ্দুর দেখতি। রেলগাড়ি পদ্মা পার হতিছে। রেলগাড়ির মধ্যি চারপাশে আয়না আর আয়না। দেহি আমার পরনে থিরি-পীছ; মানে কামিজ, শালুয়ার, আর উড়না। কী সুন্দর যে লাগতিছে আমারে! আর তুমার পরনে শাট-প্যান্ট। শাট প্যান্টের মধ্যি গুঁজ্যা পরছো। মাজায় সুন্দর এট্টা বেল্টুও লাগাইছো। তুমারে দেইখ্যা আমার অবাক লাগতিছে। য্যানো ছিনিমার নাইয়ক তুমি। আর আমি নাইকা,” ব’লেই ফিক কোরে হেসে ফেলে সখিনা বিবি। স্মিত হেসে মোখলেছ মিয়া জিজ্ঞেস করে, “তারপর?”
-তারপর আমি তো রেলগাড়ির জানালার সাথে ঘেইষ্যা বইস্যা পদ্মারে দেখতিছি। আমার আরেক পাশে তুমি। পদ্মায় ভীষণ ঢেউ হতিছে। পাহাড়ের মতন উঁচা। আর ভীষণ সোরোত।পানি পাক খাইয়া চলতিছে। ভীষণ রাগে য্যানো পদ্মা গজরাতিছে। ঢেউগুলো য্যানো আমাগো রেলগাড়ি ধইরা ফ্যালবো। কিন্তু ধরতি আবার পারতিছেও না। আমার খুব ভয় লাগতিছে। আবার ভালোও লাগতিছে। এমন সময় ঘুমডা ভাইঙ্গা গেল।
-যা দেহিছো ভালো দেহিছো, বউ। সেতু চালু হলি তো সেতু দিয়ে দুই একবার এদিক সেদিক যাওয়া লাগবি।
-এই, তুমি সত্যি সত্যি দুই এট্টা শাটপ্যান্ট বানাও না! তুমারে খুব মানাবি। জীবনে তো লুঙ্গি ছাড়া কিছু পইরল্যা না।
-বুঝছি, তুমার আর শাড়ীকাপড় ভাল্লাগছে না। জোয়ান মাইয়াগো মতো থিরি পীছ পরার ইচ্ছা হতিছে। ঠিক আছে; কিন্যা দিমুহানে। তয় দেইখো, হঠাৎ কইর্যার ওইসব পরলি মানষে কী কয়।
-শালুয়ার-কামিজ বানায় দাও আর না দাও, পদ্মা সেতুতে রেললাইন চালু হলি রেলগাড়িতে কইর্যাক আমারে কিন্তু একবার ককসো বাজার নিইয়া যাওয়া লাগবোই তুমার। সেহানে নাকি বড় সমুদ্দুর। কূলকিনারা নাই। খালি পানি আর পানি। শুনছি দশ তালা সমান ঢেউ। তার মধ্যিই লোকজন পানিতে নাইম্যা মজা করে। এই জিনিসডা দেহার বড় সাদ আমার। দেহা বা তো?
-আইচ্ছা, দেহাবো। আল্লারে ডাহো, বউ।
-তা ছাড়া আমাগো এই ছোট্ট টিনের ঘরডারেও বদলাতি হবি, মতির বাপ। এই গেরামে তো এহন বিল্ডিংযের পর বিল্ডিং উঠতিছে। আমাগো মতি রে বিয়া দিতি হবি না?
-ঠিকই কইছো, বউ। হাতে অনেক কাজ এহোন। তয় মনের মধ্যি ভারি সুখ লাগতিছে।
-আল্লারে ডাহো, মতির বাপ। আর বারো তেরো দিন পরে য্যানো ভালোয় ভালোয় পদ্মা সেতুডা চালু হইয়া যায়। আমাগো পোরধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো আইবো, তাই না?
-হ। এই মাসেরই পঁচিশ তারিক উদ্বোধন। সেদিন নাকি লাখ লাখ মানুষ আইবো এহানে। আমরা কি আর শেখের বেটির কাছে ভিড়তে পারমু! তয় বড় বড় টিবির পর্দা লাগানো হবি শুনতিছি। তাতে বঙ্গবন্ধুর কইন্যারে দূর থাইক্যাও দেহা যাবি নাকি।
-আইচ্ছা, কাছে যাতি পারি আর না পারি, আল্লা তাঁরে বাঁচায় রাহুক। দেশের জন্য আরো অনেক কিছু করুক।
এই ব’লে দু’জনে থামে। ঘরের জানালা দিয়ে সকালের সূর্যের সোনালী আলোয় উদ্ভাসিত অনতিদূরের পদ্মা সেতুর দিকে দু’জনেই নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আর সে দৃষ্টিতে মিশে থাকে প্রত্যাশার নানা রং।
লেখক: চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।