আনোয়ার শাহাদাত হোসেন, রিয়াদ, সৌদিআরব থেকে: সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় আর সাংবাদিকগণ হলেন এই স্তম্ভের প্রকৃষ্ট উপকরণ। কোন রাষ্ট্রে সংবাদমাধ্যম যদি স্বাধীন ভাবে কাজ করতে না পারে বা কোন দূরভিসন্ধি নিয়ে কাজ করে তাহলে সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য স্তম্ভগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে সাধারণ জনগণ জানতে পারেনা এবং গণতন্ত্র মূল্যহীন হয়ে পড়ে। যুগে যুগে দেশে দেশে সাংবাদিক নির্যাতন নতুন কোন ঘটনা নয়। রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা প্রভাবশালী মহলের টার্গেটে পরিণত হয়ে সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়। বাংলাদেশেও আমরা প্রায়ই দেখি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা। গত দুদিন যাবত দেশের সবচাইতে আলোচিত বিষয় হচ্ছে দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের উপর বর্বরোচিত নির্যাতন ও গ্রেফতারের ঘটনা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দূর্নীতির ব্যাপারে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করায় স্বাস্থ্য সচিবের নেতৃত্বে তার দপ্তরে প্রজাতন্ত্রের কয়েকজন কর্মকর্তা, কর্মচারী দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা ধরে নির্যাতন, হয়রানি ও হেনস্তার পর দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ‘তথ্য চুরির’ অভিযোগ এনে পুলিশে হস্তান্তর এবং গভীর রাতে অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা বেগম সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গলা চেপে ধরেছে এবং বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে, যে বা যারাই মন্ত্রণালয়ের কোন দূর্নীতির প্রতিবেদন বা খবর প্রকাশ করবে তাদের কণ্ঠ এভাবে চেপে ধরা হবে! এই ন্যাক্কারজনক ও বর্বরোচিত নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দাবী করছি। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতো এবং সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কলম ধরতো তাহলে আজকের এই দৈন্যদশা হতো না। সাংবাদিকরা আজ বহুদা বিভক্ত। কেউ রাজনীতির ছত্রছায়ায়, কেউ কোন ব্যবসায়ীর হাতের মুঠোয় আর কেউ কোন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা কিংবা সম্পাদক বা মালিকের তল্পিবাহক হয়ে চলে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে সবসময় সত্য ও সুন্দরের পক্ষে থাকেনা তাদের কলম। রাতের অন্ধকারে যখন গণতন্ত্রের কবর রচিত হয় তখনো তারা অধিকাংশ চোখে কালো পর্দা ঝুলিয়ে রাখেন যাতে করে সত্যটা বলতে বা লিখতে না হয়। আপনারা যাদের জন্য সত্যকে মিথ্যে আর মিথ্যেকে সত্য বলে প্রচার করেন তারা যখন আপনাদের নির্যাতন করে তখন বিচার পাওয়া সত্যিই দুস্কর হওয়ারই কথা।
১৯৯৬ সাল হতে এই পর্যন্ত বাংলাদেশে অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এর চাইতে অনেক বেশি । বিচার শেষ হয়েছে মাত্র ৮ টি হত্যাকান্ডের। আবার এই ৮ টির মধ্যে ৫টির বিচার কাজ ভুক্তভোগী পরিবার প্রত্যাখান করেছে। এই সব হত্যাকান্ডের ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান কী? নাকি কয়েকদিন শোকবার্তা আর কালোব্যাজ ধারনের মধ্যেই আপনারা তুষ্ঠ! রক্ত হিম করা হত্যাকান্ড সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনির অভিযোগ পত্র জমা দেয়ার তারিখ ৯ বছরে পেছালো ৭৭ বার! সাংবাদিক বুরহান, শামসুর রহমান, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালু সহ জানা অজানা অনেক সাংবাদিক হত্যাকান্ডের কথা আপনাদের স্মরণে আছে নিশ্চয়। সাংবাদিক হত্যাকান্ড বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের আন্দোলন টেকসই নয়। বিভিন্ন স্বার্থের বশবর্তী হয়ে আন্দোলন ভাটা পড়ে যায় এবং বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদতে থাকে।
সময় এসেছে সকল সাংবাদিক একই মঞ্চে আসার অন্তত নিজেদের দাবী আদায়ের লক্ষে। মতের ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু তা যেন বৃহত্তর ঐক্যে এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনে কখনো বাধা সৃষ্টি না করে সেদিকে দৃষ্টি দেযা খুবই জরুরি। হীনমন্যতা বা স্বার্থপরতা খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে হবে নতুবা আপনাদের প্রতিবাদের ভাষা পত্রিকার পাতা কিংবা টিভির পর্দায় সীমাবদ্ধ থাকবে। চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের কথা নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে, তিনি বলেছিলেন- ‘আমি আর নিউজ করব না, আমাকে মারবেন না প্লিজ!’ কত অসহায়ত্ব মাখা তার এই মিনতি! এগুলো কি আপনাদের ধমনীতে কম্পন সৃষ্টি করেনা? সুনামগঞ্জের সাংবাদিক কামাল হোসেনকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতনের কথা কি আপনাদের মনের পর্দায় ভেসে উঠে না? তবু কী করে আপনারা হাত-পা গুটিয়ে নিজেদের ইগো আর রাজনৈতিক স্বার্থের তরে এই মহৎ পেশার তকমা নিয়ে যে যার মতো আচরণ করেন! আপনাদের ব্যানারে বড় বড় অক্ষরে শোভা পায়, ‘বিচার পাই না- তাই বিচার চাই না’ এই যদি আপনাদের অবস্থা হয় তাহলে এই নির্যাতন কখনো বন্ধ হবে না সেটা সহজেই অনুমেয়। নাকি আপনারাও প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক নিক ডেভিসের মতো বলবেন- ‘অবশেষে আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমি একটি দূর্নীতিপরায়ণ পেশায় কাজ করছি।’
লেখক: প্রবাসী কলামিস্ট