সুপর্ণা বসু দে, কোলকাতা, ভারত:
প্লেন ল্যান্ড করার আগেই চোখে পড়ল সেই কুয়াশা ঘেরা উপত্যকা। নীল পাহাড়। মেঘগুলো কেমন আটকে আছে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে।
সবুজ গালিচা বিছানো সবুজ আসাম। এখানে রিয়া সেন শর্মার বাড়ি। বড় হওয়া। বড় প্রিয় তার আসাম। গৌহাটি এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বাড়ির পথে ডক্টর রিয়া সেন শর্মা। ভীষণ উত্তেজিত।
দু’দিনের ছুটিটা হঠাৎ ডিক্লেয়ার হলো, তার সঙ্গে শনি-রবিবার যোগ হয়ে মোট চার দিন। এমন সুযোগ হাতছাড়া করেনি রিয়া। কাউকে না জানিয়ে ফ্লাইটে কলকাতা থেকে সোজা গৌহাটি। এখানে বড় হওয়া, যদিও ক্লাস ফ্লোরে শিলংয়ের কনভেন্ট স্কুলে। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে। তুখোড় বুদ্ধি, বাবা ডক্টর সেন শর্মার মতন। ছোট থেকেই দেখেছে বাবার নাম, যশ, প্রতিপত্তি। ডিব্রুগড়, তেজপুর, শিব সাগর কত জায়গা থেকে বাবাকে কনসালটেন্সি জন্য নিয়ে যেত। শুনেছে বিশাল টাকার অফার থাকতো। ধনী বিত্তবানদের মেয়েদের মেয়েলি সমস্যার একমাত্র সমাধানের পথ নাকি ডক্টর রজত সেন শর্মা। যে অপারেশন সবাই করতে ভয় পায় সেই অপারেশনে নিখুঁত তার ছুরি-কাঁচি। সেই বাবার মেয়ে রিয়া। অসম্ভব বুদ্ধি। সবাই রিয়া বলতে অজ্ঞান। কারণ সে ছোট থেকে অসম্ভব মানবিক। সবার দুঃখেই তার প্রাণ কাঁদে। বাড়ির সমস্ত দাস-দাসীদের প্রতি তার অগাধ প্রেম। তাদের কখনো আলাদা সদস্য মনে করেনি।
কিন্তু আজ রিয়ার খারাপ লাগছে। মা-বাবা কেউ নেই বাড়িতে। একটা আর্জেন্ট কলে শিবসাগরের গেছে। সবাই আছে। সবাই দেখাশোনায় ব্যস্ত যদিও রিয়ার এতসব ভালো লাগেনা। বলে আরে বাবা এতো ব্যস্ত হোওনা। আমি কি কচি খুকি? আমি করে নেব! কিন্তু সেদিন রাতে। অনেক রাতে যখন চারধারে নিশীথের স্তব্ধতা তখন একটা হালকা গোঙ্গানির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। রিয়া বোঝার চেষ্টা করলো। কিসের শব্দ? না, গোঙ্গানির শব্দটা যেন নিচের থেকে আসছে। কে? কে হতে পারে? প্রশ্নটা কুরে কুরে খেতে লাগলো। রিয়া বিছানা থেকে উঠে স্লিপার পায়ে গলিয়ে ধীরে ধীরে, সন্তর্পনে নিচে নেমে আসে। রান্নাঘরের পাশের ঘরে, যেখানে মহিলা অ্যাটেনডেন্সদের ঘর। সেখান থেকেই আওয়াজটা তীব্র আসছে। ঘরে ঢুকে দেখে ফুল্লরা পেটে হাত দিয়ে গোঙ্গাচ্ছে। রিয়ার মনে পড়ল। তাইতো, বাড়িতে আসার পর থেকে তো ফুল্লরাকে সে দেখেনি। সেই কবে পুরুলিয়া থেকে এসেছিল ফুল্লরা। প্রায় তারই বয়সী, হয়তো দুই তিন বছরের বড় হবে। ছোটবেলায় একসঙ্গে কত খেলাধুলা করত। কাছে গিয়ে বলল রিয়া কি হয়েছে গো? তোর কোথায় ব্যথা? আমায় বল ফুল্লরা।
অনেক কষ্টে চোখ খুলে তলপেটে নির্দেশ করল ফুল্লরা। রিয়া ম্যাক্সিটা তুলতে অবাক হয়ে গেল। যৌনাঙ্গে এত বড় অপারেশন! কি হয়েছিল? কবে অপারেশন হলো? উত্তর শোনার অপেক্ষা না করেই অবশ্য ডক্টর রিয়া কাটা জায়গায় যেখানে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছে ভালো করে ড্রেসিং করে। নতুন করে পেইন কিলার ইনজেকশন দেয়। এই ঘরটার পাশেই ডক্টর রজত সেন শর্মার চেম্বার। তাই ওষুধপত্র এর কোন অভাব নেই। এখানে মাঝে মাঝে ডক্টর সেন শর্মা অপারেশনও করেন। এক একটা ছোট আধুনিক ওটি। ডাক্তারি চোখে রিয়ার বুঝতে বাকি রইল না যে ফুল্লোরা বেশ কয়েকবার মাও হয়েছে।
রিয়া অবাক। কবে বিয়ে হল? কেউ কিছু জানালো না তো! যদিও যতবার বাড়িতে এসেছে ফুল্লরা সাথে দেখা হয়েছে, কই সেওতো কিছু বলেনি। কত প্রশ্ন? কত প্রশ্ন? ফুল্লরা তখন চোখ খুলতেই পাচ্ছে না। সে অচৈতন্য। রিয়া বসে রইল ফুল্লরার মাথার পাশে। আরেক দাসী অনিতা মাসীও বসে রইল রিয়ার সাথে। হাজার অনুরোধ সত্ত্বেও রিয়া গেলনা শুতে। নতুন সূর্য উঠলো। সেন শর্মা ভিলাতে। এখন অনেকটাই সুস্থ ফুল্লরা। রিয়াকে দেখে তার কৃষ্ণবর্ণ গাল বেয়ে অশ্রুধারা বয়েই চলেছে। তার গতিপথে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মাথায় হাত বুলালো। মাতৃস্নেহে বুকে টেনে নিল রিয়া।
তারপর শুনলো এক অন্য ইতিহাস। সেই আদিম ইতিহাস। সেই সুদূর পুরুলিয়ায় বেড়াতে গিয়ে ডক্টর রজত সেন শর্মা কিনে এনেছিল ছোট্ট ফুল্লরাকে। একটা মোটা টাকা দিয়েছিল তার হতদরিদ্র পিতা-মাতাকে। মা ছাড়তে চাইনি ফুল্লরাকে। বুকে জড়িয়ে তার কান্নার শেষ ছিল না। কিন্তু ডাক্তারবাবুর হাজার টাকার বান্ডিলটা খুব ভারী। আর তাই ছোট হালকা ফুল্লরা হয়ে গিয়েছিল ডাক্তারবাবুর গিনিপিগ। একটু বড় হতে হতেই, চলতে লাগল নানারকম শল্যচিকিৎসা। নারীর যৌনাঙ্গ ছিল তার গবেষণা কেন্দ্র। হাত পা পাকাতে লাগল ডাক্তার। নাম-যশ বাড়তে লাগল। চলতে লাগলো যৌনশোষণও। টাকার অনেক ক্ষমতা। নারী হয়েও ফুল্লরা হয়ে উঠল একটা মেয়ে গিনিপিগ। যেমন খুশি ব্যবহার করা যায়। রিয়া সব শুনে পাথর। তার শরীর অবশ। তার সম্মানীয় পিতা। তার আশ্রয়স্থল এমন অমানবিক হলো কি করে? সেই পিতার সন্তান হবার জন্য নিজের গায়ে ঘেন্নায় থু থু ছিটায়। ওর কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইলো। চোখের জলে ভাসলো ফুল্লরার সঙ্গে। ফুল্লরা কেমন যেন মৃতবৎ। কাটাছেড়া, দুঃখগুলো বহন করতে করতে কখন যেন মনটাও কেটেকুটে ছোট হয়ে গেছে। হয়তো বা মনটাই নেই। রিয়া আগলে রাখে ফুল্লরাকে। এর প্রতিবাদ সে করবেই। ডাক্তার রজত সেন শর্মার সামনে আজ তার মেয়ে ডক্টর রিয়া সেনশর্মা এক বিশাল প্রতিবাদী মশাল হয়ে জ্বলবে। সে জানাবে লোকসমাজে ডক্টর সেন শর্মার কীর্তিকলাপ। তার মহান ডক্টর হবার কালো ইতিহাস। তবে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগবে? ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতে এই গল্পটা কি সম্ভব? স্মার্টফোনের যুগে? না গল্পটা সেই ষাটের দশকে। যখন ইলেকট্রনিক্সের এমন বাড়বাড়ন্ত হয়নি। এত আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ ছিল না। সেই সময় একজন সাধারণ ডাক্তারের গুণী হাতযশ গাইনোকলজিস্ট হয়ে ওঠার গল্প। হয়তো তার দক্ষতা পরবর্তীকালে অনেক নারীকে অনেক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু ফুল্লরার কথা ঢাকা পড়ে যাবে। সে তলিয়ে যাবে অন্ধকারে। দরিদ্রতা, অশিক্ষা মানুষকে প্রতিবাদ করার ক্ষমতাও কেড়ে নেয়। রিয়ার মতন মানুষও অবশ্য আছে। শুনেছি ডাক্তাররা একটু নিষ্ঠুর হন। তাদের হতে হয়। অনেক কান্না, যন্ত্রণা, রক্ত দেখেও একাগ্রচিত্তে তাদের দায়িত্বে ফোকাস থাকতে হয়। দুঃখে কান্নায় মন ভিজে গেলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু একটা হৃদয় যখন অন্যের হৃদয়ের দুঃখের সাথে বিনা স্বার্থে যুক্ত হয়। তার অন্ধকার জীবনে সূর্যের মতো জ্বলে ওঠে। তখন তাকে আমরা প্রকৃত মানুষ বলে চিনি। রিয়া আজ ফুল্লরার জীবনে নতুন সূর্য। নতুন প্রভাত দেখবে ফুল্লরা। হাজার হাজার রিয়ার জন্ম হোক। এখনও অনেক ফুল্লরার জীবনে সূর্য উঠা বাকি যে।