তিনি বাংলা গানের একজন ভার্সেটাইল শিল্পী। যার গান শুনে শ্রোতাদের মেঘাচ্ছন্ন হৃদয়ের নীল দুঃখবাড়ীতে সুখের বৃষ্টি ঝরে। কখনও কখনও তারা বর্ষার জলজ হাতের আদরের মিহি ছোঁয়া পান। আবার কখনও বা প্রগাঢ় নীল আকাশে খুঁজে পান পেঁজো তুলোর উড়ালসুখ। তার নাম আলম আরা মিনু। সম্প্রতি প্রবাস মেলাকে তিনি জানিয়েছেন তার জীবনের কথা, সঙ্গীত নিয়ে তার ভাবনার কথা। সেসব কথার সবিশেষ তুলে ধরা হলো প্রবাস মেলা’র অকৃত্রিম পাঠকদের জন্য।
জন্ম, বেড়ে ওঠা: আলম আরা মিনুর জন্ম কুমিল্লা জেলায়। সেখানেই কেটেছে তার শৈশব। তার পৈত্রিক বাড়ি ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার নীলকমল গ্রামে। একসময় তার পিতা মো: ইয়াকুব আলী তার মা বেগম আয়েশা খাতুনের জন্মস্থান কুমিল্লায় স্থায়ী হন। তার বাবা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। তারা তিন বোন এক ভাই। বোনেরা হলেন হোসনে আরা রুনু, শামীম আরা অনু এবং তাদের একমাত্র ভাইয়ের নাম জাহাঙ্গীর আলম গোলাম জিলানী। একসময় ব্যবসার কাজে তার বাবা স্বপরিবারে চট্টগ্রাম চলে যান। সেখানে তারা ৫ বছর ছিলেন।
যেভাবে শুরু সঙ্গীত জীবনের: আলম আরা মিনুর সঙ্গীত জীবনের শুরু ছোটবেলায়। তার বাবা ব্যবসায়ী হলেও গানের প্রতি তার বেশ আগ্রহ ছিল। এ প্রসঙ্গে আলম আরা মিনু বলেন, আমি ক্লাস ওয়ানে পড়া অবস্থায় বাসায় গুন গুন করে গান গাইতাম। আমাদের বাসায় রেডিও ছিল। রেডিওতে বাজানো যেকোন গান আমি শুনে শুনে গাইতে পারতাম। আব্বা আমার গান শুনে আমাকে গাইতে উৎসাহ দিতেন। তিনি ফোকসঙ্গীত বেশি পছন্দ করতেন। আমিও তাকে আব্দুল আলীমের গান, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া গান গেয়ে শোনাতাম। একসময় আব্বা আমাকে হারমোনিয়াম কিনে দেন। তার কাছে সারেগামা শিখেছি। তখন আমরা চট্টগ্রামে। বাবা আমার জন্য একজন গুরুজী ঠিক করে দেন। আমার গুরুজী শ্রদ্ধেয় রাখাল নন্দী বাবুর কাছে আমি গানের তালিম নিতাম। তিনি আমাকে নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, সেমিক্ল্যাসিক গান এবং উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিখাতেন। পরে আমি রেডিও শুনে যেকোন গান হুবহু হারমোনিয়ামে তুলতে পারতাম। ঢাকায় আমার গানের আরেকজন গুরুজী ছিলেন। তার নাম সঞ্জীব দে। তার কাছেও আমি ক্ল্যাসিকসহ সব ধরণের গানের তালিম নিতাম। আমার মনে আছে ২য় শ্রেণিতে থাকাকালীন আমি স্কুলে গান গেয়ে পুরস্কার পেয়েছি, অভিনন্দিত হয়েছি। বাবা ব্যবসার কাজে সারাদিন বাহিরে ব্যস্ত থাকতেন। সন্ধ্যা বা রাতে বাসায় এসে বলতেন মিনু একটা গান শোনাবি? ব্যস বসে যেতাম গানের আসরে। বাবার একটি ঘর ছিল। ব্যবসার কাজে ব্যবহার করতেন। সে ঘরেই চলতো গানের আসর। আমাদের আত্মীয় স্বজন, বাবার বন্ধু-বান্ধব অনেকে অংশ নিতেন সে আসরে। সবাই শ্রোতা আমিই একমাত্র শিল্পী। সবাই গান শুনে প্রশংসা করতেন, উৎসাহ দিতেন গানের জন্য। এরই মধ্যে রেডিওতে গান করা শুরু করি। ১৯৮৭ সালে আমি বাংলাদেশ বেতারে শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। বিভিন্ন সংগঠনের প্রোগ্রামে গান করি। এভাবেই আমার জীবনের সাথে সঙ্গীত এক হয়ে গেল। আমি জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় টানা ৮-৯ বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।
স্টেজ পারফরমেন্স: আলম আরা মিনু স্টেজে উঠলেই দর্শক শ্রোতারা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেন। জানা যায়, তিনি স্টেজ পারফরমেন্স সফল করার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। দেশে বিদেশে শত শত শো করেছেন। তিনি আধুনিক, ফোক, উর্দু, হিন্দি গানের সমন্বয়ে তার প্রোগ্রাম সাজিয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি সবধরণের গান নিয়ে স্টেজে হাজির হই। আধুনিক, পুরনো দিনের গান, ফোক, উর্দু, হিন্দি গান, গজল কোনটাই বাদ দিতাম না। তবে লতাজীর গান আমার খুব পছন্দ। একটা কথা বলতে হয় ছোটবেলা থেকেই আমি সব ধরনের গান চর্চা করার কারণে গানের জন্য আমার গলাটা ভার্সেটাইল হয়ে উঠে। আমি মনে করি আমার কণ্ঠটা ঐশ^রিক দান। এটা না হলে আমি এত সুন্দর করে গাইতে পারতাম না।
গানের অ্যালবাম: দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে মিনুর বহু অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। এক সময় নামীদামী অনেক সঙ্গীত প্রযোজনা সংস্থা তাকে অ্যালবাম প্রকাশের জন্য অনুরোধ করতে থাকে। বাংলাদেশের অনেক নামকরা সুরকার তাকে অ্যালবাম প্রকাশের জন্য উৎসাহ দিতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে প্রবাস মেলাকে তিনি বলেন, শ্রদ্ধেয় প্রয়াত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের হাত ধরে তার সুরে ১২টি গান নিয়ে আমার প্রথম অ্যালবাম বের হয় ১৯৮৯ সালে। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। এ অ্যালবামটি প্রযোজনা করে সারগাম। সেসময় এ অ্যালবামটির প্রতিটি গান শ্রোতারা বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করে। ‘তোমার দেয়া সে কথার মালা’- নামের সেই অ্যালবামের প্রথম গান ‘সে তারা ভরা রাতে, আমি পারিনি বোঝাতে তোমাকে আমার মনের ব্যাথা’ বেশ হিট হয়। এ গানটি এখনও মানুষের মুখে মুখে। এরপর একে একে আমার ২০টির মতো সলো অ্যালবাম বের হয়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো সাউন্ডটেকের প্রযোজনায় ‘বন্ধু তোর লাইগারে, কথা দিলাম, লিখলাম চিঠি তোমার নামে, তুমি জীবন আমার, নালিশ, যদি তুমি বলো, বেস্ট অব মিনু। দোয়েল প্রডাকশন থেকে প্রকাশিত হয় ‘ভালোবাসার বৃন্দাবন’ (সুর প্রণব ঘোষ), সিএমভি’র ব্যানারে বের হয় ‘দক্ষিণের জানালা, সঙ্গীতা বের করে ‘বন্ধু হয়ে যাবো’। এছাড়া অনেক ডুয়েট ও মিক্সড অ্যালবাম প্রকাশিত হয়।
বিটিভিতে তালিক্তভূক্তি ও গান করা: আলম আরা মিনু বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) তে তালিকাভূক্ত হন ১৯৯০ সালে। বিটিভি’র অসংখ্য অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শ্রোতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন গুণি এ শিল্পী। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, বিটিভিতে গান করতে পারা আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। সেখানে এখনো গান করতে গেলে চোখে পানি এসে যায়। কেমন যেন একটা নস্টালজিয়া কাজ করে। আমার মনে হয় এই বিটিভি-ই তো আমাদের প্রজন্মের শিল্পীদের উত্থান ঘটিয়েছে। দেশ বিদেশে আমাদের নাম ছড়িয়েছে। আমার মনে আছে আলোচিত প্রযোজক রিয়াজ উদ্দিন আংকেলের প্রযোজনায় ‘ঝলক’ অনুষ্ঠানে আমি নজরুলগীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত মিলে ৫টি গান গেয়েছিলাম। একটি টিভি নাটকে নুরুজ্জামান শেখের লেখা ও সেলিম আশরাফের সুরে ‘যে বাতাসে ফোঁটে ফুল’ গানটি করি। এ গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এর সাথে শহীদুল হক খানের একটি ম্যাগাজিনে ‘সবার যেমন মা থাকে, আমারও তেমন মা ছিল’- গানটি গেয়েছিলাম। বিটিভি’র জনপ্রিয় গানের অনুষ্ঠান গীতি বিচিত্রার উদ্বোধনী শো’তে প্রথম আমিই গান করি। সেদিন ‘সে তারা ভরা রাতে’ গানটি প্রচারের পর ব্যাপক প্রশংসিত হই। মুজাক্কির ভাইয়ের অনেক অনুষ্ঠানে আমি গান করেছি। এভাবে রেডিও, টিভিতে গান করতে করতে চারিদিকে আমার নাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আমাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
বিদেশে স্টেজ শো: আলম আরা মিনু গান নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন বহুবার। সবখানে তিনি ব্যাপক সমাদৃত হয়েছেন। ৮ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৯৮৮ সালে তিনি প্রথম লন্ডনে ৪টি গানের শো করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লন্ডনে শ্রদ্ধেয় সাবিনা ইয়াসমিন আপু, এন্ড্রু কিশোর এবং আমি ৪টি শো পারফর্ম করি। এটি সুপার প্রোগ্রাম ছিলো। এমপি ইউসুফ আংকেল এবং এমপি হারুন আংকেল এ শো এর আয়োজন করেছিলেন। সেখানে আমি দুর্দান্ত পারফর্ম করি এবং আমার নাম পুরো লন্ডনে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ৮/৯ বার আমি লন্ডন গিয়েছি। এভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইডেন, বেলজিয়াম, তুরস্ক, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, দুবাই, ওমানসহ পৃথিবীর ৩০টিরও বেশি দেশে আমি স্টেজ শো পারফর্ম করেছি।
জনপ্রিয় গান: অনেকেই মনে করে আলম আরা মিনুর গাওয়া ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা’ গানটির জন্য তিনি ইতিহাস হয়ে থাকবেন। প্রায় ২৫ বছর আগে রেকর্ডকৃত এ গানটির রচয়িতা ও সুরকার হলেন তার স্বামী সেলিম আশরাফ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় ঋদ্ধ এ গানটি তার ‘ইতিহাস হয়ে রবে’ অ্যালবামের প্রথম গান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সত্যি এ গানটি গাইতে পেরে আমি নিজেকে খুব ধন্য মনে করি। এ গানটির মিউজিক ভিডিও আমার করা। আবার এ গানটি ‘যে মাটির বুকে’ অ্যালবামেও পাওয়া যাচ্ছে। শ্রদ্ধেয় আব্দুল হাদী ভাইও এ গানটি গেয়েছেন। তিনি বলেন, আমার আরো কিছু জনপ্রিয় গান আছে। যেমন, রাজপ্রাসাদের সুখ, বাপ্পা দা’র সুরে ব্যান্ড প্যাটার্নের গান ‘যদি তুমি বলো’। শহীদুল্লাহ্ ফরায়জী ভাইয়ের লেখা ফিল্মের গান ‘সোনা দানা দামী গহনা, প্রেমের কাছে কিছুই মানায় না’ গানটিও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এছাড়া প্রায় ১০০টি ফিল্মের গানে আমি কণ্ঠ দিয়েছি।
মিউজিক ভিডিও: অনেকগুলো মিউজিক ভিডিওর জন্যও শ্রোতাদের মনে গেঁথে থাকবেন আলম আরা মিনু। এসব মিউজিক ভিডিওতে তাকে সিম্পল বাঙালীয়ানা স্টাইলের একজন আইকন হিসেবে দেখা যায়। যেমন: ‘যে বাতাসে ফোঁটে ফুল’ রাজপ্রাসাদের সুখ, তারপর একযুগ, সে তারা ভরা রাতে, যদি তুমি বলো, বড় বেশি মনে পড়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সম্ভবত: বাংলা গানের মিউজিক ভিডিও শুরু আমার মাধ্যমেই। অডিও গান রেকর্ডের মতো মিউজিক ভিডিওতেও আমি খুব পারফেক্টলি কাজ করার চেষ্টা করেছি। খুব শীঘ্রই আমার নতুন ৬টি মিউজিক ভিডিও আসছে।
সাম্প্রতিক কাজ: আমার নিজস্ব অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলের জন্য বেশ কিছু গান করছি। করোনার পর স্টেজ শো গুলোও শুরু করেছি। খুব শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা যাচ্ছি বেশ কিছু শো করার জন্য। এইচএম ভয়েস থেকে ইতিমধ্যে আমার ২টি গান বের হয়েছে। ‘পালাতে যদি চাও বুকটা বেছে নাও’, তুমি সকাল তুমি আমার ভোর এদেশ তোমায় রেখেছি বুকের ভেতর’। দুটি গানই গীতিকবি শেখ নজরুল ভাইয়ের লেখা। সুর করছেন ফিদেল নাঈম, সঙ্গীতায়োজন করেছেন ওয়াহিদ শাহিন। অনেক যতœ করে নজরুল ভাই গান লেখেন। গান দুটি আমার বেশ ভালো লেগেছে। এছাড়া মিউজিক কম্পোজার হিসেবেও কাজ করছি। ২০২১ সালে বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষ্যে ‘শোনো পৃথিবী শোনো’ গানটির সুর করে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছি। রুমানা ইসলাম, রিজিয়া পারভিন, আঁখি আলমগীর, ন্যান্সী, নিশিতা বড়–য়া, দিলশাদ নাহার কনা, অবন্তি সিঁথী এবং আমি সহ একঝাঁক তারকা শিল্পী গানটিতে পারফর্ম করেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আলম আরা মিনু বলেন, আমি গানের মানুষ, গান নিয়েই সারাজীবন কাটিয়েছি। ভবিষ্যতেও গান নিয়েই থাকতে চাই। তবে বর্তমানে কম্পোজিশনে বেশি মনোনিবেশ করছি। নতুনভাবে নতুনরূপে বিশাল আকারের একটা কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সময় হলে মিডিয়াকে অবশ্যই জানাবো।
পরিবার: আলম আরা মিনুর স্বামী প্রখ্যাত সুরকার সেলিম আশরাফ সদ্য-প্রয়াত হয়েছেন। এই দম্পতির একমাত্র মেয়ে লামিয়া আশরাফ অদ্বিতীয়া কলেজে অধ্যয়নরত।
প্রবাস মেলা সম্পর্কে: প্রবাস মেলা সম্পর্কে গুণী এই শিল্পী বলেন, প্রবাস মেলা উৎকৃষ্টমানের একটি পত্রিকা। মূলত: প্রবাসীদের জীবন-যাপন এবং তাদের স্বার্থ নিয়েই এই পত্রিকাটি খবর প্রকাশ করে যাচ্ছে। এটা আমার খুব ভালো লেগেছে। দীর্ঘদিন প্রবাস মেলা বেঁচে থাকুক এই কামনা করছি।
(আলাপচারিতায় লেখা তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন– শহীদ রাজু)