ড. চমক হাসান, লস এঞ্জেল্স, যুক্তরাষ্ট্র:
মাঝে মাঝে এমন-সব সময় আসে, যখন চেনা ধ্যান-ধারণা আর দর্শন হঠাৎ সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে নিজের বোধ আর অনুভবের সাথে। শুঁয়োপোকা যেমন প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসে কোকুন থেকে- তেমনই আমাদের চিন্তাজগতে যেন বিরাট একটা ঝড় বয়ে যায়- বদলে যায় আমাদের দেখার চোখ। ক্ষুদ্র সময়ের মাঝে এই যে বড় পরিবর্তন হয়ে গেল, সেটাও এক রকম বিপ্লবই। যদিও নিজেকে সফল মানুষ দাবি করতে পারি না, তবু একজন সাধারণ মানুষের জীবনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সেই জায়গা থেকে আমার কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারি।
আমি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে বৈভব বিলাসিতার অবকাশ ছিল না। মা চাইতেন পড়ালেখায় ভালো করি, পড়ালেখার বাইরে কিছু করতে গেলেই তিনি ভয় পেতেন। ভাবতেন, তার ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে। আমিও বাধ্য ছেলে, স্কুলে যাওয়া আর বিকেলে বন্ধুদের সাথে টেনিস বলে টেপ পেঁচিয়ে ক্রিকেট খেলা- এর বাইরে আর কিছুই করি না।
এমন একটা সময়ে আমি কিছু অদ্ভুত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেলাম। আমার গৃহশিক্ষক ছিলেন ড. অখিল পোদ্দার, তিনি এখন একুশে টেলিভিশনের হেড অব নিউজ, তাঁর কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ আমার সামনে একটা নতুন দরজা খুলে দেয়ার জন্য। তিনি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন- প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য দর্শনের উপর তাঁর ছিল অসীম আগ্রহ। তিনি আমাকে শোনালেন ধ্রুপদী দর্শনের কিছু সহজ প্রশ্ন। আমি কে? আমি কেন? সুন্দর কী? সত্য কী? সত্য কিংবা সুন্দর, এরা কি নিজ গুণেই সত্য বা সুন্দর, নাকি আমরা অমন দেখি বলে?
প্রশ্নগুলো শুনে প্রথম দিকে হাসি পেত। অখিল স্যার এসব কী বলেন, পাগল নাকি? এরপর যখন আমি ভাবতে শুরু করলাম, একটু করে আটকে গেলাম। বুঝতে পারলাম প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর মোটেই সহজ না। বুঝতে পারলাম, পড়তে হবে, জানতে হবে।
স্কুলের বাইরের বই এর প্রতি ভালো লাগা ছিল। কিন্তু আমার মনভোলা স্বভাবের কারণে স্কুলের বইই এতবার হারাতাম যে সেগুলো কিনতেই মা অস্থির হয়ে থাকতেন। আবার বাইরের বই কিনে দিতে বলব- সে সাহস পেতাম না। বাবা ঢাকার বইমেলায় গেলে আমার জন্য কিছু বই কিনতেন, এছাড়া কেউ উপহার দিলে বই পড়তাম, না পেলে নেই। কিন্তু এবার মনে হলো যেভাবেই হোক অনেক পড়তে হবে। শুনলাম প্রতি শুক্রবার শিশু একাডেমিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ক্লাস হয়, সেখানে লাইব্রেরি আছে। সদস্য হয়ে গেলাম। পড়তে শুরু করলাম। এবার ক্লাসের পড়ালেখার বাইরে একটা নতুন জগত তৈরি হলো আমার।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যারা ক্লাস নিতেন তারা ছিলেন শহরের স্কুলগুলোর নামকরা সব বিতার্কিক। তাদের মূল আগ্রহ ছিল বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা এসব নিয়ে। আমার বিতর্কের হাতে খড়ি ওই সময়েই। কুষ্টিয়াতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ছিল শিশু একাডেমির সাথে জড়িত। ফলে শিশু একাডেমির সঙ্গেও একটা পরিচিতি তৈরি হয়ে গেল। প্রতি বছর জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো। সেখানে গান, নাচ, অভিনয়, যন্ত্রসংগীত, উপস্থিত বক্তৃতা, রচনা প্রতিযোগিতা- নানান রকম প্রতিযোগিতা হতো। বহু ছেলেমেয়ে সেখানে অংশ নিত। এগুলোর সাথে জড়িত থেকে সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গণে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হলো। প্রথম প্রতিযোগিতা করেছিলাম আবৃত্তি। এখনও মনে পড়ে- ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম মঞ্চে দাঁড়িয়ে। বোধহয় সাতজনের ভেতর ষষ্ঠ হয়েছিলাম! কিন্তু থেমে যাই নি। এরপর প্রতিযোগিতা করাটাও একটা সহজ ব্যাপার হয়ে গেল, যেটার সুফল এখনও পাই। মঞ্চ, ডায়াস কিংবা ক্যামেরা- এখন আর ভয় করে না।
এখন ভাবি, দর্শন নিয়ে চিন্তার জন্য বই পড়া- এটা থেকে শুরু করে আমি পৌঁছে গেলাম বিতর্ক আর সংস্কৃতি চর্চার অঙ্গণে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বড় হয়ে গেল আমার পৃথিবীটা। একটা বিপ্লব ঘটে গেল আমার অজান্তেই।
এখন আমি যতটুকু মানুষ, তার একটা বড় অবদান ঐ সময়ের। সংস্কৃতির একেকটা মাধ্যম থেকে একেক রকম বিষয় সম্বন্ধে জেনেছি। বিতর্ক করতে গিয়ে আমি শিখলাম- অধিকাংশ মানুষ একটা কথা বললেই সেটা সত্য হয়ে যায় না। আমার মনে হয় এমন, তাই এটা সত্য, এটা যে খুব দুর্বল যুক্তি সেটা বুঝে গেলাম। বুঝলাম একই বিষয়কে কত রকম দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করা যায়, সূর্য পূর্বদিকে ওঠে’- এমন চিরন্তন সত্য বা টটোলজি নিয়েও চাইলে বিতর্ক করা যায়। আমি যদি সংজ্ঞায়ন করি, বিতর্কের ক্ষেত্র পৃথিবী নয়, বরং শুক্রগ্রহ- তাহলে বলতেই পারি এটা ভুল। কারণ শুক্রগ্রহে সূর্য ওঠে পশ্চিম দিক থেকে!
আবার একই সঙ্গে বিতর্ক আমায় শেখাল অন্য মানুষের চিন্তাকে সম্মান দিতে। বছরখানেক পরে দোল পূর্ণিমায় লালন শাহের আখড়াতে বাউলদের ধর্ম-আচার দেখে অনেক কিছুই নিজের চিন্তার সাথে মেলাতে পারি নি। কিন্তু তাদের দর্শনের গভীরতা মুগ্ধ করেছে বারবার। মানুষের জন্য তাদের সহজ সুন্দর অনুভূতি, অন্তরাত্মার সাথে মিলনের যে আকুতি- কী অসাধারণ! ‘মিলন হবে কতদিনে আমার মনের মানুষের সনে’ এই গানটি কোন মানব মানবীর প্রেমের গান নয়, এই গান জীবাত্মা আর অন্তরাত্মার মিলনের, ¯্রষ্টা আর সৃষ্টির মিলনের, এটুকু বুঝেই আমার সে কী আনন্দ!
অন্যদিকে বাচ্চাদের মতো শিখতে থাকলাম সক্রেটিসের ছাত্র প্লেটো, তার ছাত্র এরিস্টটল, তার ছাত্র আলেক্সান্ডারের কথা। সত্যের সন্ধান আর জ্ঞানের সাধনা করতে গিয়ে বিষের পাত্র হাতে তুলে নিলেন সক্রেটিস। প্লেটো শুনিয়ে গেলেন শাশ্বত সত্যের কথা- চোখ, নাক, নাক এসব ইন্দ্রিয় দিয়ে তার পুরোটা বোঝা যাবে না। এরিস্টটল বললেন উল্টো কথা, নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণ দিয়ে নাকি খুঁজে পাওয়া যাবে সত্যকে। এমন অদ্ভুত কথাগুলো ছোট মনে বড় প্রভাব ফেলেছিল তখন। জ্ঞানের পরিধি যখন সামান্য বাড়ে, শুরুতে নিজেকে একটু জ্ঞানী মনে হয়, অহংকার বাড়ে। যখন সত্যি সত্যি আমরা গভীরে জানতে শুরু করি, নিজেকে তত ক্ষুদ্র আর জ্ঞানহীন মনে হয়, তৃষ্ণা তত বাড়ে। আমারও তা-ই হলো সেসময়।
এত কিছুতে অংশ নিতে গিয়ে স্কুলের লেখাপড়ায় সামান্য ব্যাঘাত ঘটল। ক্লাস এইটের ফাইনালে গণিতে খারাপ করলাম। যদিও বিজ্ঞানে অনেক আগ্রহ ছিল, ক্লাস নাইনের ক্লাসটিচার বললেন মানবিক নিতে। আমি দমে গেলাম না। ঐ যে চিন্তা করার অভ্যেসটা তৈরি হয়েছে, সেটা আমায় সাহায্য করল অনেক। কেন খারাপ করলাম সেটা নিয়ে একা একা অনেক ভাবলাম। খুঁজে বের করলাম দুর্বলতা: আসলে অঙ্ক যা করি, পুরোপুরি বুঝি না- স্যারেরা যেভাবে বলেন ওভাবে করে যাই শুধু। তারপর ছোট ক্লাসের গণিত বইগুলো খুঁজে বের করে নিজে নিজে বুঝে বুঝে সব সমাধান করলাম। ঠিক করে ফেললাম দুর্বলতা। দেখলাম- যে সমস্যাই সমাধান করি সেটা আসলে একা একা বোঝা যায়। গণিতে গভীর ভালোবাসা জন্মালো। সত্য আর সুন্দর আরও নতুন করে সামনে এল। পৃথিবীটা আরও একটু বড় হয়ে উঠল…।
ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, ক্রমাগত নিজের গল্প করে যাওয়ার জন্য। ক্লাস সেভেন, এইট, নাইন- এই সময়ে আমার ভিতর যে পরিবর্তন ঘটে গেল সেটাকে আত্মিক বিপ্লব বলা যায়। একেবারেই ছোট পরিসরের বিপ্লব, খুব ব্যক্তিগত, তবু একজন মানুষের জন্য সেটা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।
যেকোন বিপ্লব শুরু হয় এক বা একাধিক ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ থেকে। আমার ক্ষেত্রে সেটা শুরু হয়েছিল চিন্তার ধাক্কা থেকে। এরপর পারমাণবিক শৃঙ্খল বিক্রিয়ার মতো গান, বিতর্ক, উপস্থাপনা, গণিত শেখানো, গবেষণা একের পর এক জমা হয়েছে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে।
চিন্তা করতে শিখেছি কিনা জানি না। তবে চিন্তার আনন্দ অনুভব করতে শিখেছি ঐ সময়টাতে। আমি চিন্তাবিদ হয়ে উঠি নি, কিন্তু আগের চেয়ে উন্নত মানুষ হয়েছি। আমি শিখেছি- আমি যতটুকু দেখি পৃথিবীটা অতটুকু নয়। আমি যতটুকু কল্পনা করতে জানি, পৃথিবী ততটুকুও নয়। আরও বহু মানুষ নিবিড় পর্যবেক্ষণে যতটুকু দেখতে পারেন, আরও জ্ঞান-গভীরতা নিয়ে যতখানি কল্পনা করতে পারেন, এবং আরও যতকিছু..আমরা এখনও কল্পনা করতে পারি না- তার সবটুকু নিয়ে পৃথিবী! আমি শিখেছি, মানুষ কী অসহায় রকমের ক্ষুদ্র অথচ কী অসীম সম্ভাবনার আধার! আমি শিখেছি- একটা সুন্দর প্রশ্ন কী করে একটা আশায় ভরা ভবিষ্যত জন্ম দেয়। শিখেছি- কিভাবে প্রতিটা আঘাত আমাদেরকে প্রস্তুত করে হাজার আঘাত থেকে প্রতিরক্ষার।
আমি শিখেছি, যা কিছু শিখেছি তার নিযুত লক্ষগুণ শেখার এখনও বাকি। চিন্তাকে ভালোবেসে শেখার সেই পথটাতে আমি নির্ভয়ে হেঁটে যাই।
চিন্তার পথ ধরে আত্মিক বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ খুঁজে পাক সবাই। আরও চিন্তাশীল, আরও গভীর মানুষ হয়ে উঠি সবাই- এই শুভকামনা রইল নিরন্তর।
লেখক: প্রাক্তন সহ-সভাপতি, বুয়েট ডিবেটিং ক্লাব ও অংক প্রেমী, লেখক, ইউটিউবার।