ইসরাত জেবিন:
রুপা হক একজন বিশিষ্ট ব্রিটিশ-বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ। তিনি যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সদস্য এবং লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল ও অ্যাকটন আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। একজন একাডেমিক, লেখক এবং সমাজতাত্ত্বিক হিসেবে তার বহুমূখী পরিচিতি রয়েছে।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
রুপা হক ১৯৭২ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাতা বাংলাদেশের পাবনা থেকে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান ১৯৬০-এর দশকে। রুপার শিক্ষাজীবন শুরু হয় স্থানীয় বিদ্যালয়ে, পরে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, যেখানে তিনি সমাজতত্ত্ব বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি কিংস্টন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা শুরু করেন। গবেষণা এবং একাডেমিক কাজের পাশাপাশি তিনি লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন এবং বেশ কিছু প্রবন্ধ ও বই রচনা করেন। তার লেখাগুলোতে অভিবাসন, সংস্কৃতি এবং সমাজের নানা দিক উঠে আসে।
রুপার বাবা-মা তাকে সবসময় শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। পরিবার থেকে প্রাপ্ত মূল্যবোধই তাকে একটি আন্তর্জাতিক পরিচিতি অর্জনে সহায়তা করেছে। ছোটবেলা থেকেই সমাজের অসাম্যতার দিকে তার নজর ছিল, যা তার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও একাডেমিক জীবনের ভিত্তি স্থাপন করে।
রাজনৈতিক যাত্রা
রুপা হকের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় স্থানীয় রাজনীতি থেকে। ২০১৫ সালে তিনি প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকা ইলিং সেন্ট্রাল ও অ্যাকটনের বাসিন্দাদের জন্য কাজ করে প্রশংসিত হন। তার এই বিজয় শুধু তার নয়, পুরো ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য একটি বড় অর্জন ছিল।
তার প্রধান এজেন্ডাগুলোর মধ্যে রয়েছে সামাজিক ন্যায়বিচার, লিঙ্গ সমতা এবং পরিবেশ রক্ষা। তার নেতৃত্বে স্থানীয় বাসস্থান সমস্যা সমাধান, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধি নিয়ে কাজ হয়েছে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে একজন অভিবাসী পরিবারের সন্তান হয়েও ব্রিটিশ মূলধারার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য
রুপা হক বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরব। কয়েক মাস আগে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থাকে ‘স্বৈরাচারী’ আখ্যা দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অবনতির বিষয়ে সচেতন হতে আহ্বান জানান। যুক্তরাজ্যের একটি সংবাদমাধ্যমে তিনি লেখেন যে, যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত বাংলাদেশে স্বচ্ছতা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা।
তার এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ তার বক্তব্যকে সাহসী এবং ন্যায্য বলে প্রশংসা করেন, আবার অনেকে এটিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ হিসেবে সমালোচনা করেন। তবে রুপা তার অবস্থানে অটল। তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে নীরব থাকা উচিত নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তার বক্তব্য প্রবাসী বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করেন, রুপা তাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরছেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরছেন।
অর্থ পাচার ও প্রবাসীদের সমস্যা
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার এবং প্রবাসীদের সমস্যা নিয়েও রুপা হক বেশ কয়েকবার পার্লামেন্টে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে বড় বাঁধা হলো অর্থ পাচার। এই অর্থ দেশের মানুষের কল্যাণে ব্যয় হওয়া উচিত। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান যেন তারা এই বিষয়টিতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়।
রুপা ব্রিটেনে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের নাগরিক অধিকার এবং কর্মসংস্থানের উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রবাসী বাংলাদেশিরা শুধু যুক্তরাজ্যের নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের সমস্যা সমাধান করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
তাছাড়া, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো এবং তাদেরকে মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন রুপা। তার মতে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা তাদের সংস্কৃতিকে লালন করেও বিশ্ব মঞ্চে প্রতিযোগিতা করতে পারে।
সমাজতাত্ত্বিক এবং একাডেমিক অবদান
রাজনীতির বাইরেও রুপা হকের পরিচয় একজন সমাজতাত্ত্বিক এবং লেখক। তাঁর গবেষণা এবং রচনাগুলোতে তিনি সমাজের শ্রেণি বৈষম্য, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং অভিবাসনের নানা দিক বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর রচিত বইগুলো শুধু একাডেমিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং সাধারণ পাঠকের কাছেও সমাদৃত।
রুপা মনে করেন, অভিবাসন একটি বৈশ্বিক বিষয় এবং এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সঙ্গেও যুক্ত। তার গবেষণাগুলোতে এসব বিষয় খুবই স্পষ্ট। তার বই এবং প্রবন্ধগুলো পাঠককে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজকে বিশ্লেষণ করতে শেখায়।
নারীর ক্ষমতায়ন এবং ভবিষ্যৎ লক্ষ্য
রুপা হক বিশ্বাস করেন, রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ সমাজের অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিজেও এই লক্ষ্যে কাজ করে যাছেন। তিনি বলেন, নারীদের যদি সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তারা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
নারীর ক্ষমতায়নে রুপার ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার মতে, রাজনীতি শুধু পুরুষদের জন্য নয়, নারীদেরও এখানে সমানভাবে জায়গা করে নিতে হবে।
রুপা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে আরও দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন এবং প্রবাসী কমিউনিটির উন্নয়নে কাজ চালিয়ে যেতে চান। তার মতে, রাজনীতি হলো মানুষের জন্য। এবং আমি চাই আমার কাজ মানুষের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনুক।
ব্যক্তিগত জীবন
রুপা হক রাফি নামে এক পুত্র সন্তানের মা। ইংরেজি ছাড়াও তিনি বাংলা, ফরাসি এবং হিন্দি ভাষায় পারদর্শী। রুপা হকের অনুজ সহোদর ব্লু পিটার এর উপস্থাপিকা কনি হক।