হাকিকুল ইসলাম খোকন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র:
১৪ মে ২০২২, শনিবার স্থানীয় সময় দুপুর আড়াইটা। হঠাৎ গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত শহর বাফেলোর একটি সুপার মাকের্ট। আধা-স্বয়ংক্রিয় একটি অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ। সামরিক পোশাকে শরীরে বর্ম পরে চালানো হয় ওই হামলা। সেখানেই শেষ নয়, নিজের রক্তাক্ত তা-ব অনলাইনে সরাসরি সম্প্রচারের জন্য একটি ক্যামেরাও ব্যবহার করছিল ওই তরুণ। হামলা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা করতে গিয়ে স্থানীয় এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এটা ছিল একটি হরর সিনেমার সেটের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো। কিন্তু সবই ছিল বাস্তব। এটি একটি যুদ্ধক্ষেত্র ছিল।
বাফেলোর ওই হামলায় গুলিবিদ্ধ হন ১৩ জন। তাদের মধ্যে ১০ জনই নিহত হন। পরে পুলিশ জানায়, গুলিবিদ্ধ ১৩ জনের মধ্যে ১১ জন ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এফবিআই) বর্ণনায় হামলাটি ছিল একটি ‘সহিংস চরমপন্থার’ ঘটনা। এফবিআইয়ের বাফেলো কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এজেন্ট স্টিফেন বেলঙ্গিয়া সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, এটি হেইট ক্রাইম এবং বর্ণবাদে উদ্বুদ্ধ সহিংস চরমপন্থা কিনা, উভয় দিকই আমরা তদন্ত করে দেখছি।
এ হামলার পরপরই পেইটন এস জেনড্রন নামে সন্দেহভাজন ওই বন্দুকধারীকে আটক করে স্থানীয় পুলিশ। ১৪ মে ২০২২ গভীর রাতে তাকে ‘ফার্স্ট-ডিগ্রি’ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর তদন্তে বেরিয়ে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জানা গেছে, শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যবাদী বিশ্বাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অনলাইনে ১৮০ পৃষ্ঠার ‘ইশতেহার’ পোস্ট করেছিলেন ওই তরুণ। ঘৃণা-ভরা লেখায় অভিবাসী এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে শ্বেতাঙ্গদের ‘প্রতিস্থাপনকারী’ হিসেবেও বর্ণনা করেন তিনি। আর এর মধ্য দিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের বিষয়টি।
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গদের ‘প্রতিস্থাপন’ করা হচ্ছে, এমন ধারণা সম্প্রতি দেশটির অতি-ডানপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে মূলধারার রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতিতেও চলে এসেছে। আর এ মতাদর্শকে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করছেন মার্কিন অনেক গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, যা নির্বিঘেœ রিপাবলিকান পার্টির বাগাড়ম্বরে আরও প্রভাবিত হচ্ছে। এমনকি আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য দেশটির দক্ষিণ সীমান্তে অভিবাসীদের আগমণকে ‘আক্রমণ’ হিসেবেও বর্ণনা করেছে দলটি।
অভিবাসীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গরা দুর্বল হয়ে পড়ছে, এমন মতাদর্শকে সামনে তুলে ধরেই নিজের পৈশাচিক আক্রমনকে যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা করেছেন বাফেলোতে হামলা চালানো তরুণ পেইটন জেনড্রন। আর তার ইশতেহার ছিল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের সম্পর্কে বর্ণবাদী কথায় ভরা।
গত ছয় মাস ধরে মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ডিসকর্ডে করা পোস্টগুলোতে ‘অভিবাসী’ শব্দটি খুব বেশি উল্লেখ করেননি হামলাকারী পেইটন। এর পরিবর্তে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে অপমানজনকভাবে নানা বর্ণবাদী লেখা লিখেছেন। ২০২১ সাল থেকে আর্কাইভ করা পোস্টগুলোতে ‘অভিবাসী’ শব্দটি ১২ বার, ‘প্রতিস্থাপন’ ১৮ বার এবং ‘প্রতিস্থাপনকারী’ শব্দটি ২২ বার ব্যবহার করেছেন ওই তরুণ। কিন্তু ‘কালো’ বা কৃষ্ণাঙ্গ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছেন ১০০ বারের বেশি।
২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে হামলা চালিয়ে ৫১ জন মুসলিমকে হত্যাকা-ের থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার দাবি করেছেন বাফেলোর হামলাকারী। তার এ দাবির মিল পাওয়া যায় ঘটনার সঙ্গেও। হামলার ঘটনা অনলাইনে সরাসরি সম্প্রচারের জন্য ক্যামেরা ব্যবহার করছিলেন ক্রাইস্টচার্চে হামলাকারী বেন্টন টারান্ট। হামলার আগে তিনিও প্রকাশ করেছিলেন নিজস্ব ইশতেহার। কিন্তু বাফেলোতে হামলাকারী ক্রাইস্টচার্চ হত্যাকা- থেকে যতটা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন স্বদেশি অসন্তোষ থেকে। তিনি জিপ কোডের মাধ্যমে তার কাছাকাছি বসবাস করা মানুষদের নিয়ে অনুসন্ধান করেছিলেন যাতে ‘যত বেশি সম্ভব কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যা করতে’ পারেন। আর তার এ গবেষণাই তাকে নিয়ে যায় শহরের পূর্বদিকে অবস্থিত জেফারসনের পাশের একটি সুপার শপে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের’ তথ্য অনুসারে, দেশটিতে গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক গোলাগুলি বা বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র হামলায় নিহতের হার সার্বিকভাবে প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে বাফেলো হত্যাকা- শুধু নিহতের সংখ্যার কারণে নয়, হামলার রাজনৈতিক প্রকৃতির কারণেও আলাদা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ঘটনাটিকে অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ এবং রাজনৈতিক সহিংসতার ক্রমবর্ধমান স্বাভাবিকীকরণের প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত।
বাফেলো হামলাকারী তার ইশতেহারে লিখেছেন, কৃষ্ণাঙ্গরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অনেক পশ্চিমা দেশে সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত জাতি। কিন্তু তারপরও তারা বলে যে তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। তার এ মন্তব্যের সঙ্গে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন মন্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ট্রাম্প তার শাসনামলে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে নানা মন্তব্য করে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের আকৃষ্ট করেছিলেন। তার এ প্রকাশ্য বর্ণবাদী মনোভাবই রিপাবলিকান পার্টিকে মূলধারার রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এডুকেশন উইকের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি রাজ্য সম্প্রতি ‘সমালোচনামূলক জাতি তত্ত্ব’ বা বর্ণবাদ এবং যৌন শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা বা কড়াকড়ি আরোপের আইনে স্বাক্ষর করেছে এবং আরও ১২টি রাজ্য একই ধরনের আইন করার বিষয়টি বিবেচনা করছে। এছাড়া বর্ণবাদী মনোভাবের বিস্তার ঘটতে পারে এমন কিছু বইও তুলে নেয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
তবে সম্মিলিত এ প্রচেষ্টাগুলো আমেরিকান বর্ণবাদ এবং জেনোফোবিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে উপহাসও তৈরি করেছে। কিছু ক্ষেত্রে এসব প্রচেষ্টাকে অসম্ভব করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী ইতিহাসের আলোচনা আজ দেশটির বিদ্যমান দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং সামাজিক বঞ্চনাসহ নানা বিষয়ের ওপর দৃষ্টি ঘুরিয়েছে। অনেক সমাজ বিজ্ঞানীর মতে, যুগ যুগ ধরে অবজ্ঞা, অবহেলা আর সুযোগের অভাবই যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের একটা বড় অংশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে দেশটির অনেক শ্বেতাঙ্গ নিজেদের ভাবছেন অনিরাপদ। আর সেই অনিরাপত্তা থেকেই জন্ম নিচ্ছে ঘৃণার।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, দেশটিতে চলতি বছর এখন পর্যন্ত বন্দুক হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন সংস্কারের দাবি আইনপ্রণেতাসহ বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, বন্দুক হামলার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, যা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ জন্য দরকার কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ।