মো: আশরাফুল আলম মাসুদ:
ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ যার রাজধানী জেরুজালেম। ১৯৮৮ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও) ও প্যালেস্টাইন জাতীয় পরিষদ (পিএনসি) একপাক্ষিকভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। ঘোষণার সময়ে কোনো অঞ্চলেই পিএলওর নিয়ন্ত্রণ ছিল না, যদিও তারা যে অঞ্চলগুলো দাবি করেছিল আন্তর্জাতিকভাবে সেইগুলো ইসরায়েলের দখলে ছিল। দেশটি জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র। জাতিসংঘের ১৩৮টি সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত।
ফিলিস্তিন সমস্যার প্রেক্ষাপট
ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী ফিলিস্তিন দেশটি ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল ব্রিটেন-বিরোধী জোটে। তখন যুদ্ধ জয়ে ফিলিস্তিনদের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন। যা ইতিহাসে ‘বেলফোর ঘোষণা’ হিসেবে পরিচিত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান। ফলে আনন্দিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান? উত্তর ছিল-অর্থ নয়, আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি আর তা হবে ফিলিস্তিন। ফলে ফিলিস্তিন ভূখ-টি ইহুদিদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় ব্রিটেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটেন স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে। মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরব-শূণ্য করার জন্য কাজে লাগায় ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি। ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকট নিয়ে আমরা অন্য সংখ্যায় আরও বিস্তারিত তুলে ধরবো।
এবারের সংখ্যায় ফিলিস্তিন ভ্রমণে যা করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো:
ফিলিস্তিন পর্যটক আকর্ষণ হিসাবে বিখ্যাত একটি দেশ। প্রতি বছর বিশ্বের অনেক দর্শনার্থী দেশটির সুন্দর জায়গা দেখতে সেখানে যেয়ে থাকেন। জেরুজালেম বিশ্বের প্রধান তিনটি ধর্মের পবিত্র স্থান। ফলে শহরটির ধর্মীয় গুরুত্বও তাৎপর্যপূর্ণ। জেরুজালেমের পুরনো শহরে প্রতিদিন তিন ধর্মের বিপুল সংখ্যক অনুসারী ভ্রমণ করেন। ইহুদিরা ডেভিড স্ট্রিটসহ আল বুরাক দেওয়াল থেকে আল খলিল গেট পর্যন্ত বা তারিক আল ওয়াদ থেকে আল আমুদ গেট (দামেস্ক গেট) পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় খ্রিস্টানরা। তারাও যিশু খ্রিস্টের শেষ দিনের পথ দিয়ে মুসলিম কোয়ার্টার হয়ে হারাম শরিফে পৌঁছায়। ব্যবসায়িক কিংবা পরিবার নিয়ে সময় করে আপনিও দেশটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। তবে যাওয়ার আগে দেশটির কিছু নিয়ম-কানুন জেনে রাখলে আপনার ভ্রমণ আরামদায়ক হবে।
ব্যবসায়িক শিষ্টাচার
ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য দেশটির কোনো অফিসে গেলে উপস্থিত সবাইকে আলাদাভাবে শুভেচ্ছা জানাতে হবে। ব্যবসায়িক আলোচনার সময় ফিলিস্তিনিরা খুব ভালো আচরণ করবে। এসময় চা, কফি এবং মিষ্টি পরিবেশন করা হয়। ব্যবসায়িক আলোচনার আগে সামাজিক আলাপ সেরে নিতে পারেন। নামাজের সময়ে আলোচনা বিরতি দেয়া হয়। তাই জোহরের নামাজের আগে বা দুপুরের খাবারের পরে আলোচনা সময় ঠিক করা ভালো। আলোচনার সময় মেজাজ হারানো এড়িয়ে চলুন। এটি আলোচনা ফলপ্রসূ করতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং সম্ভবত ফিলিস্তিনিদের আপনার সাথে ব্যবসা করতে দ্বিধাগ্রস্ত করবে।
সম্পর্ক
ফিলিস্তিনি ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তিগত পরিচিতি প্রায়শই পেশাদার কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়ক হয়। অনেক ব্যবসা স্থানীয় গ্রাহকদের উপর নির্ভর করে পারিবারিক মালিকানাধীন এবং পরিচালিত হয়। তার মানে ব্যবসায়িক লেনদেন বেশি ব্যক্তিগত এবং কম আনুষ্ঠানিক হয়ে থাকে। ফিলিস্তিনিরা তাদের সাথে কাজ করতে পছন্দ করে যাদের তারা জানে এবং নির্ভর করতে পারে, প্রায়শই এটি করার জন্য সম্ভাব্য অংশীদারদের সাথে শক্তিশালী বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে চায়। তারা আর্থিক যোগ্যতার পরিবর্তে ব্যক্তিগত গুণাবলীর ওপর ব্যবসার বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তি তৈরি করে।
আতিথেয়তা
ফিলিস্তিনিরা উদারতা এবং আতিথেয়তার বিষয়ে খুবই সিরিয়াস। তারা মিষ্টি এবং আরবি বা তুর্কি কফিসহ অতিথি গ্রহণের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকে।
সম্মান
ফিলিস্তিনে নারীদের মধ্যে শালীনতা এবং সতীত্ব হলো মূল মূল্যবোধ। তবে বর্তমানে এই ধারণার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। ফিলিস্তিনি সমাজে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য শিক্ষা অত্যন্ত মূল্যবান।
খাওয়া–দাওয়া
ফিলিস্তিনি সংস্কৃতিতে পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাওয়ার আগে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে। আপনার হোস্টকে যেকোন খাদ্যের বিষয়ে আগেই অবহিত করতে পারেন। ফিলিস্তিনি হোস্টরা প্রায়শই তাদের অতিথিদের জন্য প্রচুর পরিমাণে খাবার সরবরাহ করে। তাদের তৈরি করা খাবার খেতে অস্বীকার করলে অসন্তুষ্ট হতে পারে। বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি পরিবার রমজানসহ তাদের প্রধান খাবার একসাথে খায়। কিছু পরিস্থিতিতে পুরুষ এবং মহিলারা আলাদাভাবে খেতে পারেন (যেমন যদি পরিবারটি অত্যন্ত ধার্মিক হয় বা খাওয়ার লোকের সংখ্যা খুব বেশি হয়)। খাওয়া শুরু করার আগে সবার উপস্থিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত বাবাকে প্রথম খাবার পরিবেশন করা হয়, এরপর মাকে। তবে অতিথি থাকলে তাকে প্রথমে পরিবেশন করা হয়। ফিলিস্তিনিরা সাধারণত ডান হাতে খায়। দেশটিতে বাম হাত দিয়ে খাবার মুখে দেয়া অভদ্রতা বুঝায়। ধার্মিক মুসলমানরা ইসলামিক রীতি অনুযায়ী অ্যালকোহল বা শুকরের মাংসযুক্ত কিছু খায় না।
মুসলিম প্রথা অনুযায়ী আপনার প্লেটের সব খাবার শেষ করার পরামর্শ দেয়া হয়। হোস্টরা সম্মানের জন্য অতিথির প্লেটে অতিরিক্ত খাবার রাখতে পারে বা তাদের অতিথিদের সম্ভাব্যভাবে খাওয়ার চেয়ে বেশি পরিবেশন করার জন্য অনুরোধ করতে পারে।
খাবার শেষ হওয়ার পর সাধারণত চা, ফল, মিষ্টি বা কফি পরিবেশন করা হয়। কফি প্রায়ই খাবারের উপসংহার হিসেবে পরিবেশন করা হয়। অতিথিরা কফি পান করার পরই চলে যান।
ফিলিস্তিন ভ্রমণে আরও যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে
শুক্রবার সমগ্র পশ্চিম তীর এবং গাজা জুড়ে মুসলমানদের জন্য একটি পবিত্র দিন। অফিসিয়াল কাজের জন্য রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার ঠিক করতে পারেন। শুক্র এবং শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকে। দেশটিতে ইংরেজিভাষী পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় সময়ানুবর্তিতা খুব কঠোরভাবে মেনে চলতে হয় না। ফিলিস্তিনের শ্রমশক্তি সুশিক্ষিত, প্রযুক্তি এবং বিদেশি ভাবধারার সাথে পরিচিত। তাদের প্রতি অবজ্ঞা করা বা তাদের দক্ষতা অবমূল্যায়ন করা এড়িয়ে চলুন।
ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিরা আগে থেকেই পরিকল্পনা করার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে পারে কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সহজেই ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নষ্ট করে দেয়।
পশ্চিম তীর এবং গাজার অর্থনীতি দরিদ্র এবং সংগ্রামী। বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগতভাবে উচ্চ এবং ইসরায়েলের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ওঠানামা করে।
ইসরায়েল দ্বারা আরোপিত ফিলিস্তিনিদের গতিবিধির ওপর বিধিনিষেধগুলো এই অঞ্চলে পণ্য ও পরিষেবার প্রবাহের উপর প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
ফিলিস্তিনি অঞ্চলে একাধিক মুদ্রা প্রচলন রয়েছে, যেমন ইসরায়েলি নতুন শেকেল, জর্দানিয়ান দিনার এবং আমেরিকান ডলার।