মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত, রিয়াদ, সৌদিআরব:
একটু স্বচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে প্রতিনিয়ত হাজারো বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। জীবিকার তাগিদে মাতৃভূমির সকল মায়া তুচ্ছ করে, পরিবার পরিজনকে ফেলে ‘প্রবাসী’ পরিচয়ে কাটিয়ে দেয় যুগ যুগান্তর। অনেক সুন্দর আগামীর স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় হাজারো বাংলাদেশি। কিন্তু এসব প্রবাসীদের অধিকাংশের স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন-ই থেকে যায়। কিছু প্রবাসীদের স্বপ্ন হয়তো বাস্তবে রূপ নেয়। কিছু ব্যতিক্রম সবক্ষেত্রেই থাকে তাই ব্যতিক্রমদের নিয়ে কথা না বলে অধিকাংশ প্রবাসীদের বাস্তবতা নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
একজন মানুষ যেদিন থেকে প্রবাস জীবনকে বরণ করে নেয় সেদিন থেকে বদলে যায় তার সবকিছু। পরিবার পরিজনের প্রতি টান ও দায়-দায়িত্ব বেড়ে যায়। আত্মীয় স্বজন ও আপনজনদের চাহিদাও বেড়ে যায় প্রবাসীদের প্রতি। প্রবাসীর চারপাশের মানুষদের মানসিকতা এমন হয়ে উঠে যেন, চাইলেই পাওয়া যাবে যে কোন কিছু। তাই পরিবার কিংবা নিকট আত্মীয়রা বিভিন্ন আবদার করতে আলসেমি করে না। সামাজিক চাহিদাও বেড়ে যায় প্রবাসী পরিবারের প্রতি। সামাজিক যে কোন কাজকর্মে প্রবাসীদের থেকে তারা মোটা অংকের সাহায্য- সহয়তা কামনা করে। একজন প্রবাসী নিরন্তর চেষ্টা করে যায় নিজের পরিবার-পরিজনের চাহিদা মিটিয়ে তাদেরকে স্বচ্ছল জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য উপহার দেয়ার। শুরু থেকে অধিকাংশ প্রবাসী বেতন বা ব্যবসার আয়ের বেশির ভাগ দেশে পাঠিয়ে দেন পরিবার-পরিজনের জন্য। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ সবকিছু খুঁজে নেয় দেশে অবস্থানরত আপনজনদের মাঝে। দেশের পরিবার-পরিজন সুখে থাকলেই প্রবাসীরা সুখি। তাই তারা জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয় নিজ পরিবারের জন্য। ফলশ্রুতিতে জীবনের এক পর্যায়ে এসে প্রবাসীদের অবস্থা খুবই নাজুক আর করুণ হয়ে উঠে যা ভাষায় বর্ণনা দেয়ার মতো নয়। তারা দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে যায় নিজেদের জন্য তেমন কিছু রাখেন না। প্রবাসীরা মনে করে দেশের পরিবার-পরিজনদের জন্যই তো সে আজ প্রবাসী, তাই জীবনের সকল আয় তাদের জন্য পাঠিয়ে দিয়ে নিজে সুখ অনুভব করে কিন্তু পরক্ষণেই এক অবহেলিত ও লাঞ্চনার জীবনের দিকে এগিয়ে দেয় নিজেকে নিজের অজান্তে। যখন বুঝতে পারে যে, নিজের কিছু নেই তখন আর নতুন করে কিছু করার সামর্থ থাকে না। তখন আস্তে আস্তে দূরে সরতে শুরু করে আপন পরিবার-পরিজন সহ নিকট আত্মীয়রা। জীবনের স্বর্ণালী সময় প্রবাসের মাটিতে বিলিয়ে দিয়ে খালি হাতে যখন প্রবাস থেকে ফিরতে হয় তখন যে কী অবস্থা হয় তা ভুক্তভোগী ব্যতীত কে-ই বা বুঝতে পারে! অথচ এই প্রবাসীরা নিরাশার অতল গহ্বরে ডুবে থেকেও চোখের নোনাজল উপেক্ষা করে বুকের কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে পরিবার পরিজনকে ভালো রাখার তাগিদে অমানসিক খাটুনি খেটে দিনশেষে বলে- ‘আমি ভালো আছি’।
একজন প্রবাসীর কাঁধের উপর ভর করে কয়েকটা জীবন স্বপ্ন সাজায় ভালো থাকার, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার। আর প্রবাসীরাও সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের জন্য ব্যক্তিগত সকল চাহিদাকে কবর দিয়ে প্রাণপন চেষ্টা করে যায় প্রতিনিয়ত। দেশে আপনজনদের খাবার প্লেটে যখন বাহারী খাবারের পসরা বসে তখন প্রবাসীরা হয়তো ঠান্ডা ভাত বা রুটির সাথে কোন রকম কিছু একটা দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে। প্রবাসীরা বাসি-ঠান্ডা খাবার খেয়ে বেচেঁ থাকে বিধায় প্রবাসীদের পরিবার-পরিজন হয়তো দেশে গরম ভাত পায়। সেই প্রবাসীর অবসর জীবন যেন লাঞ্চনার শিকার না হয় তার জন্য প্রবাসীদের সতর্ক হতে হবে এবং সময় থাকতে সুচিন্তিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
পৃথিবীতে কারও উপর ভরসা করে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া এক ধরনের বোকামী। আমরা জানি না, আমাদের কার জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে, তাই নিজের আগামী দিনগুলির জন্য নিজেকেই কিছু করতে হবে নতুবা আপনি চরম লাঞ্চিত হবেন এবং অত্যন্ত দূর্দশায় কাটবে আপনার অবসর জীবন। আপনি বিশ/ত্রিশ বছর প্রবাসজীবন শেষে যখন নিজ গৃহে ফিরবেন তখন সকলের কাছ থেকে একটি কথা শুনবেন, সেটি হচ্ছে- ‘তুমি আমাদের জন্য কী করেছ?’ অর্থ্যাৎ আপনি কারো জন্য কিছুই করেন নি। আপনার সারাজীবনের সকল পরিশ্রম, ত্যাগ, ভালোবাসা সবই যেন মিথ্যে। আপনার টাকায় আপনার সন্তানরা হয়তো উচ্চশিক্ষিত, গ্রামের কাঁচা ঘরটি হয়তো আজ এলাকার সবচাইতে সুরম্য দালান। আপনার আর্থিক সহায়তায় হয়তো আপনার ভাইয়েরা প্রতিষ্ঠিত কিংবা আপনার প্রবাসী আয়ের সহযোগীতায় বোনদের উপযুক্ত পাত্রস্থ করেছেন। আপনার স্ত্রীর গলায় নতুন মডেলের স্বর্ণালঙ্কার শোভা পাচ্ছে আপনারই হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের টাকায়। অথচ যেই না আপনি প্রবাস ফেরত হয়ে ঘরে চলে এসেছেন সাথে সাথে মানুষগুলোর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে, পাল্টে গেছে আপনার প্রতি তাদের মনোভাব। আপনি যেই পরিবারের দশজনকে সব দিয়েছেন সেই দশজনের কাছে আজ আপনি একজন অত্যন্ত ভারী হয়ে গেছেন কারণ আপনার হাতে কোন অর্থ-সম্পদ নেই।
তাই যারা প্রবাসে আছেন আজ থেকেই এসব বিষয় ভাবুন আর নিজের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করুন এবং সেই মাফিক কাজ করুন। সবকিছুর জন্য আল্লাহর উপর ভরসা তারপরও মানুষ হিসেবে আমাদেরকে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের বিবেককে কাজে লাগাতে হবে। এটি মহান ইসলামের শিক্ষাও বটে। নিজে প্রবাসী হিসেবে লক্ষ প্রবাসীর মনোবেদনা আর দূরাবস্থার কথা অনুধাবন পূর্বক প্রবাসীদের প্রতি কয়েকটি পরামর্শ তুলে ধরতে চাই।
১. পরিবার বা আত্মীয়-স্বজন যার জন্যই যা-ই করেন প্রতিদানের আশা ব্যতীত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্ঠির উদ্দেশ্যে করবেন, তাহলে মনোকষ্টের কারণ হবে না এবং মহান রবের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান পাবেন।
২. আপনার যদি ব্যাংকে ব্যক্তিগত একাউন্ট না থাকে, আজকেই নিজের নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলুন এবং প্রতিমাসে যতটুকু পারেন ব্যক্তিগত একাউন্টে জমা রাখুন।
৩. নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিমাসে যত টাকার চাহিদা আপনার কাছে আসে তার চাইতে কিছু কম করে পরিবারের জন্য পাঠান যদিও আপনার সামর্থ্য থাকে। এতে করে পরিবার আপনার রোজগারকে যথেচ্ছা ব্যবহার করতে পারবে না এবং আপনার কাছে অভাব আছে এটি উপলব্ধি করতে পারবে।
৪. আপনি যদি বিবাহিত হন তাহলে স্ত্রীকে বলুন আপনার পাঠানো টাকা থেকে প্রতিমাসে কিছু যেন সঞ্চয় করে রাখে, যা যে কোন বিপদে আপদে কাজে আসবে।
৫. প্রবাস জীবন কারো চিরস্থায়ী নয়, একদিন আপন ভূমিতে চলে যেতে হবে তাই প্রবাসে থাকাকালীন সময়ে চিন্তা করুন দেশে কোন একটি আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করার। পরিবারের অন্য সদস্য যদি থাকে যেমন- বাবা বা ভাই তাদের দিয়ে অথবা বিশ্বস্ত অন্য কাউকে দিয়ে সামর্থানুযায়ী কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করুন যাতে করে আপনি দেশে চলে গেলে আপনার একটি আয়ের ব্যবস্থা থাকে বা অবসর সময় কাটানোর মতো একটি প্রতিষ্ঠান থাকে, হোক না সেটি ছোট বা কম পুঁজির।
৬. আপনি যদি পরিবারের ভার মুক্ত হন অথবা পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকে তাহলে আপনার প্রবাসী আয় প্রবাসে অপচয় না করে সযত্নে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিন বা যে কোন লাভজনক খাতে বিনিয়োগের চেষ্টা করুন যাতে দীর্ঘদিন প্রবাসে কাটাতে না হয়।
৭. প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড়, স্বর্ণালঙ্কার বা অন্য যে কোন সামগ্রী বাড়িতে পাঠিয়ে আপনার ঘাম ঝরানো বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় করবেন না। আপনার এই অতি ভক্তি বা ভালোবাসার কারণে পরিবারের চাহিদা দিন দিন বেড়ে যায় এবং আপনাকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করে তুলে যেখান থেকে আপনি সহজে ফেরত আসতে পারেন না।
৮. সারাজীবন প্রবাসে থাকবার মানসিকতা পরিহার করে শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য থাকতে প্রবাসজীবন ত্যাগ করে নিজ দেশে কিছু একটা করার পরিকল্পনা করুন।
৯. অনেক বছর প্রবাসে থাকার পর দেশে গিয়ে আমি এই কাজ কী করে করব, এসব ছোট-খাট কাজ করলে মানুষ কী বলবে এই ধরনের মানসিকতা ছেড়ে দিন। আপনি অর্থাভাবে থাকলে আপনিই কষ্ট পাবেন সুতরাং কে কী বলবে তা না ভেবে নিজে যা জানেন বা পারেন তা করার জন্য সবসময় মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকুন। আপনি একসময় বিদেশে ছিলেন ভালো রোজগার করেছেন বা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ঘুমিয়েছেন, পরিচ্ছন্ন পরিবেশে জীবন যাপন করেছেন অথবা আপনি কী কাজ করে অর্থ উপার্জন করেছেন কেউ দেখেনি, এখন সবাই দেখবে এসব হীন মানসিকতা বাদ দিয়ে প্রবাসফেরত জীবনকে কীভাবে উপভোগ করবেন সেই চিন্তা করে কাজে নেমে পড়ুন।
১০. যার জন্য যা-ই করেন বা যাকে যা দেন সবকিছুর হিসেব রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসীরা সাধারণত হিসেব রাখে না এই ভেবে যে, আমি তো যা করছি মা-বাপ, পরিবার-পরিজনের জন্য করছি, তাতে আবার হিসেবের কী আছে! এটি আসলে বোকামী। বেহিসেবি হলে জীবনে কষ্ট পেতে হয়। তাই নিজের আয়-রোজগার কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে তার একটি হিসেব যেন আপনার হাতে থাকে সেই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এই হিসেব প্রয়োজনে একদিন কথা বলবে।
অবশেষে বলবো, প্রবাসীরা সচেতন হোক নিজের ব্যাপারে, মিতব্যয়ী হোক, পরিকল্পিত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হোক, নিজের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সময় থাকতে কার্যকর ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করুক যাতে প্রবাসফেরত জীবনটি অবহেলায়-অনাদরে দুর্বিষহ হয়ে না উঠে। গোধূলি লগ্নে ক্লান্ত চোখ কপালে তুলে শুকিয়ে যাওয়া সাদা ঠোঁটের মলিন মুখে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে না হয় কোন প্রবাসীর।