কামরুন্নেছা হাসান:
স্বাধীনতার পরপরই ঢাকা বেতারে প্রবাসীদের জন্য ব্যতিক্রমী একটি অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো। পাকিস্তানে তখন অনেক বাংলাদেশি আটকা পড়েন। বাংলাদেশে তাঁদের আত্মীয়স্বজনরা ভীষণ উদ্বেগে ছিলেন। কোনো যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। ঢাকা বেতারে সেই অনুষ্ঠানে স্বজনরা এসে নাম-ঠিকানা বলে বার্তা দিতেন। পাকিস্তান রেডিওতে সংশ্লিষ্টজনেরা সেই বার্তা শুনতে পেতেন। অনুষ্ঠানটি সে সময় অনেক সাড়া ফেলেছিল।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘প্রবাস মেলা’ শিরোনামে বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের যাপিত জীবন নিয়ে তথ্য ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার হতো। গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় ছিলেন মামুন ইমতিয়াজ। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা তুলে ধরা হতো। বিশেষ করে শ্রমিকদের অমানবিক জীবনধারা। কী নিদারুণ কষ্ট আর যন্ত্রণা, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বেকারত্ব আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত জীবন থেকে বাঁচতে নানা রকম ঝুঁকি নিয়ে তরুণরা বিদেশে পাড়ি দেন। হয়তো কেউ কিছুটা ভালো থাকেন, কিন্তু অনেকের জীবনই দুর্বিষহ। দেশে স্বজনরা তা কল্পনাও করতে পারেন না।
অনেক দিন আগে (সম্ভবত ১৯৮৩ সালে) বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে ভারতের মাদ্রাজে একবার ট্রেনিংয়ে গিয়ে ব্যাংকক হয়ে ঢাকা ফিরছিলাম। বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ দেখি কয়েকজন বাংলাদেশিকে পুলিশ পাহারায় নিয়ে এসেছে দেশে ফেরত দিতে। বিধ্বস্ত চেহারা, হাতে পলিথিন ব্যাগে দুই-তিনটি জীর্ণ কাপড়। সহ্য করা যায় না। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। আহারে, কোন মায়ের সন্তান! খোঁজ নিয়ে জানলাম- দালালের মিথ্যা আশ্বাসে অনেক টাকা দিয়ে বিদেশে এসেছিলেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তিন মাস জেলে ছিলেন। ধার-দেনা করে এসেছিলেন সুখের আশায়। শোধ করা তো দূরের কথা, এবার শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে মা-বাবা টাকা পাঠালেন। জেল থেকে পুলিশ সরাসরি বিমানবন্দরে নিয়ে এসেছে। কী অমানবিক আচরণ! সুখের আশায় বিদেশে যাওয়া তরুণের কী করুণ পরিণতি!
দালালদের দৌরাত্ম্য আজও তেমনি আছে। কত শত অশিক্ষিত ও অসহায় তরুণ আজও মানবেতর জীবনে বন্দি। এ হিসাব কে করে? পাক্ষিক প্রবাস মেলা গত ১০ বছর ধরে কিছু ভালো কাজ করছে। প্রত্যাশা অনেক। ১১ বর্ষে পদার্পণ-এ শুভকামনা রইল।
আমি প্রতিনিয়ত ‘প্রবাস মেলা’ পড়ি। এটা একটা ভালো উদ্যোগ। সাধুবাদ জানাই। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন খবর খুব যত্নসহকারে পাঠকের কাছে তুলে ধরে। সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফসল আজকের ‘প্রবাস মেলা’র অগ্রযাত্রা। এ ব্যাপারে মামুন ইমতিয়াজের একনিষ্ঠতা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। শুধু পত্রিকা নয়, বাংলাদেশ টেলিভিশনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘প্রবাস মেলা’র গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় যথেষ্ট মুনশিয়ানা রয়েছে তার। এ পথচলা সহজ ছিল না। শত বাঁধা পেরিয়ে নিরলস প্রচেষ্টায় আজ সে লক্ষ্যে পৌঁছেছে। প্রবাস মেলা’র আগামী পথচলা আরও সুন্দর হোক। সেই সাথে অনেক শুভ কামনা রইলো
লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বিটিভি ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য।