মনির আহমদ, সিঙ্গাপুর সিটি, সিঙ্গাপুর
গ্রামের ব্যক্তিবর্গ ভুল কিছু হলে প্রায়ই কথার ফাঁকে একটু উত্তেজিত হয়ে বলতেন
“আমরা কি এলাকায় ভাইসা আইছি?!”
দীর্ঘসময় আমি এর অর্থ বুঝিনি।
মুরুব্বিদের থেকে শেখা বচনটি আমি যে ব্যবহার করি নি তা নয়। একসময় বুঝলাম আসলে আমাদের এসব অঞ্চলে যারা নদী পার হয়ে নৌকায় ভেসে এসে বাড়িঘর করেছে আসলে অনেকটা তাদেরই ইঙ্গিত করে, ছোট করে কিংবা শ্রেণিভেদ করে এই উক্তির উদ্ভব।
কথার মধ্য দিয়ে ‘আসলি’ এবং অন্যান্য দুইটি শ্রেণির ভাগ বুঝানো হতো। আসলি মানে যারা দীর্ঘসময় এই ভূমিতে বংশপরম্পরায় বসবাস করছে সাম্প্রতিককালে অন্যকোথাও থেকে আসেনি।
শৈশব থেকে এরকম শ্রেণিবিভেদ নিয়ে বেড়ে ওঠা মানুষেরা এখন নৌকায় ভেসে মালয়েশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও যায়, অনেকে আকাশেও ভেসে যায়, পরবাসী হয় যা ভাবি আর অবাক হই!
পরদেশে শ্রেণিবিন্যাসের ভেতরে বেঁচে থেকে
জীবিকা অর্জন করতে করতে এদের ভেতরের সেই অহমিকা, অহংকার আর বেঁচে থাকে না, থাকার কথাও নয়।
আমাদের অঞ্চলের মানুষেরা পয়সার দুইপিঠ শাপলা ও সুখী পরিবারের মতো লক্ষ্য নির্ধারণ করে নৌকায় সাগর পাড়ি দেয়। কেউ কেউ বেঁচে যায় আবার কেউ কেউ জীবনের তরে ভেসে যায়।
রাষ্ট্র ও পরিবারের কাছে কতোটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠলে একটি যুবক এভাবে জীবনের ঝুঁকি নেয়?
জানা আছে আবার জানা নেই!
আমার পরিচিত অনেকেই এভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ কিংবা মালয়েশিয়া গেছেন। ইউরোপের জাতিসংঘ ক্যাম্পে থেকে ফোন দিয়ে প্রায়শই কথা বলেছেন।
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথা বলি যিনি ২০১২ সালে আমাদের অঞ্চলের শরীয়তপুর-২ লঞ্চডুবিতে যখন প্রায় তিনশত লোক মারা গেলেন তিনি কাকতালীয়ভাবে সেই লঞ্চ থেকে বেঁচে যান। রাত তখন প্রায় ৩টা, কেবিন থেকে বেরিয়েছিলেন সিগারেট পানের জন্য, সিগারেট নিয়ে দাঁড়িয়েছেন লঞ্চের একদম পেছনের বাইরে, হঠাৎ আকস্মিক একটি জাহাজের সাথে ধাক্কা খেয়ে লঞ্চটি কয়েক সেকেন্ডের ভেতরই তলিয়ে যায় বন্ধুটি ছিটকে পড়েন বাইরে।
মধ্যনদীতে দীর্ঘসময় সাঁতার কেটে অবশেষে জেলেদের সাহায্যে বেঁচে গেলেন, সেই বন্ধুটিও এভাবে লিবিয়া হয়ে নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশ করেছে, কথা হলে আমার সেই গল্পটার কথা প্রায়ই মনে পড়ে।
পরিচিত অনেক বড় ভাই ইতালির শরণার্থী শিবির থেকে কল করে বলতেন এখন খুব ভালো আছি,। এই শিবির থেকে আমাদের প্রতিদিন খাবার ও মোবাইলে কথা বলার জন্য অর্থ দেয়া হচ্ছে, থাকারও সুব্যবস্থা আছে। অথচ লিবিয়ায় দালাল ও স্থানীয়রা আমাদের বন্দী রেখে মুক্তিপণ আদায় করেছে তাদের সর্বোচ্চ ভালো ব্যবহার ছিল লাথি মেরে কথা বলা বহুবার বলেছি আমরা মুসলিম তোমরাও মুসলিম কিন্তু তার মূল্যায়ন নেই। এসব মুসলিম দেশ থেকে ইহুদি খৃষ্টানদের কাছে খুব ভালো আছি, শান্তিতে আছি।
পরিচিত এক ভাইয়ের কথা বলি, যিনি মসজিদের ইমাম ছিলেন বয়সে বড় হলেও একসাথে চলাফেরা ছিল প্রায় ১০ বছর আগে তার অবৈধ পথে ইউরোপ সফরের গল্প শুনিয়েছিলেন। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, আজারবাইজানসহ বেশকিছু রাষ্ট্র পাহাড়পথে হেঁটে, প্লেনে, জাহাজে পাড়ি দিয়ে শেষপর্যন্ত দেশে ফিরে এসেছেন। মাফিয়াসহ বেশকিছু দেশের বর্ডার সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি হয়ে পরিশোধ করেছেন বহু অর্থ। তাদের বহুদেশীয় সেই বহরে একজন পাকিস্তানী নারীও ছিল যেভাবে গরুর- ছাগলের পালকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় ঠিক সেভাবেই দালালেরা আগে-পিছে থেকে মানব পাচার করে শুনেছি। পাকিস্তানী নারীর সাথে ছিল তার ১৪/১৫ বছর বয়সী কন্যা। ভাগ্য পরিবর্তনের নেশায় এসেছিল ইউরোপে যেতে, দালালেরা পদে পদে কন্যাটির উপরে অমানবিক নির্যাতন করেছে যা অন্যান্যদের প্রতিবাদ করার কোন সুযোগ ছিল না। যেখানে মানুষের দাম ১০ পয়সাও থাকে না। বেশি বুঝলে মেরে ফেলে দিয়ে বাকিদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই থাকে লক্ষ্য।
সেই ভাইটি কোনরকম জীবন নিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছে বাংলাদেশে এবং বৈধভাবে এশিয়ার একটি দেশে প্রবাসী হয়েছেন।
আমার আর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথা বলি যিনি বৈধভাবে ব্রাজিল গিয়ে অবৈধ পথে আমেরিকা প্রবেশ করে এখন ভালো জীবন যাপন করছে।
ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন পাহাড়-পর্বত পায়ে হেঁটে অবশেষে আমেরিকার কারাগার, তারপরে মুক্তি ও কাজের অনুমতি।
দীর্ঘ ৬ মাস ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে অবস্থান। দিনের বেলা পাহাড়ের বিভিন্ন আবডালে বিশ্রাম নিতেন অন্ধকার হলেই হাঁটতেন মাইলের পরে মাইল আবার সূর্য উদিত হলে লুকিয়ে পড়তেন যাতে বর্ডারের সেনাবাহিনীর নজরে না পড়ে, এভাবে বহুপথ হেঁটেছেন ম্যানহোলের ঢাকনা সরিয়ে ড্রেন দিয়েও, এগিয়েছেন ট্রাকে করে কাঁচামালের নিচে লুকিয়েও। ব্রাজিল থেকে আমেরিকা; পদে পদে তার পরিবার খরচ করেছে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা, বন্ধুটি মেক্সিকোর এক হোটেলে পৌঁছে ওয়াইফাই সংযোগ দিয়ে আমাকে কল দিলেন জানালেন মোটামুটি আর কোন বড় বিপদ নেই, আগামীকাল সকালে বাসে করে আমেরিকা ঢুকবো এরপরে আমেরিকার পুলিশ কারাগারে নিয়ে যাবে এবং কয়েক মাস পরে ওখানের বিশেষ কোন বৈধ ব্যক্তি সিকিউরিটি বন্ডের নিদিষ্ট অর্থ পরিশোধ করে জামিনদার হলেই মুক্তি মিলবে। বন্ধুটি এখন ভালো আছে ভালো থাকুক।
চোখের সামনে বহু বন্ধুর প্রেমিকাকে দেখেছি প্রবাসীরা এসে বিয়ে করেছেন সেসব বন্ধুর কাছে স্বাভাবিকভাবেই আর্থিক সমৃদ্ধিই মূখ্য হয়ে গেছে পাঠশালায় যাতায়াতের চেয়ে কিংবা প্রবাসী অল্প শিক্ষিত বোনের যখন বিয়ে হচ্ছে একজন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত ছেলের সাথে কিংবা কোন পাঠশালার শিক্ষকের সাথে তখন স্বাভাবিকভাবেই সেসব পাঠশালার ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্য পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে সমাজ ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছে।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে বড় বড় সার্টিফিকেট নিয়ে যখন একজন মেয়ে অল্পশিক্ষিত প্রবাসীর ঘরের গৃহিনী হয়ে যায় কিংবা একজন শিক্ষিত যুবক বেকার ঘুরে বেড়ায়, শেষপর্যন্ত ব্যক্তিত্ব হারিয়ে মাদকের কাছে হেরে যায় তখন খুব সহজেই সেই সমাজের পাঠশালার অন্দরে অন্তরে ধূলোর আস্তরণ পড়ে।
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবি হলেই আমাদের আতংক থাকে সবচেয়ে বেশি আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই, এখানে আমাদের পরিচিত কেউ না কেউ অবশ্যই আছে, সত্যি সত্যিই কেউ না কেউ থাকে।
আমার খুব কাছের এক ভাই যিনি আমাদের অঞ্চলের বিত্তবান ৫ জনের একজনের সন্তান। উপায়ান্তর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত লিবিয়ার সাগর পাড়ি দেয়ার জন্য লক্ষ্য ঠিক করলেন। অতঃপর পারিবারিক চাপে সেই লক্ষ্য স্থগিতও করলেন।
স্থগিত না করলে স্বজন হারানোর যে কান্না পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে ভেসে আসছে তা আমাদের গ্রামেও হতে পারতো।
রাষ্ট্র কতটা ব্যর্থ হলে এভাবে একজন নাগরিক নিজের জীবনকে মূল্যহীন করে ফেলছে এবং রাষ্ট্র পরিচালকরা কতটা বিবেকহীন হলে এসব জানার পরেও সফলতার গান গাইতে পারে!
সবই জানি আবার কিছুই জানি না।
একটি রাষ্ট্র যখন স্বনির্ভর জীবনের সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয়, পাঠশালায় যাওয়ার মূল লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যর্থ হয় তখনই এই সংকট আসে। একটি সমাজ যখন অর্থনৈতিক উন্নতিই জীবনের প্রধান লক্ষ্য আর সফলতা বলে ঠিক করে নেন তখন সেই সমাজে সচেতনতা, সুশিক্ষা ও সৌন্দর্য সবকিছুই নিহত হতে পারে এটাই স্বাভাবিক।
বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি, সৌদিতে মা-বোনদের কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা যখন সরকারের সাফল্য ও গর্বের অংশে রূপ নেয়, এক কোটির বেশি মানুষ প্রবাসে থাকা যখন সফলতার অংশ হয়ে যায়। তখন লজ্জা নামক শব্দটির লজ্জিত হতে দোষ কোথায়?
এই যে আমরা প্রতিনিয়ত ডুবে যাচ্ছি, তবুও কোন সমাধান নেই, একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই পিতা ঠিক করে ফেলছেন লালনপালন করে তাকে কোন রাষ্ট্রে দাসত্বের জন্য পাঠানো হবে।
এরকম প্রবণতা থেকে মানুষকে বের করে আনতে পারে সহনশীলতা, সুন্দর, সফল ও ব্যক্তিত্ববান কিছু জীবনের ইতিহাস। একটি শিশুকে অল্প বয়স থেকেই নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা, পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য গঠনমূলক বই পড়াতে আগ্রহী করে গড়ে তোলা, সৃজনশীল জগতকে শক্তিশালী করা, সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি সচেতন করা, সমাজসেবায় উদ্ভূদ্ধ করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরেও কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়ার সাথে পরিচিতি ঘটানো, নিজস্ব অর্জন, দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের ভেতরেই নিজের সফলতা এই বিষয়ে সচেতন করা, বিশ্বের অগ্রযাত্রা সাথে তালমিলিয়ে চলার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগ্রহণ যেমন তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান, আগামীর পথচলায় নতুন ও ব্যতিক্রম কৌশল গ্রহণের জন্য মেধা খরচ করা। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হলো এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ।
পাশাপাশি এটাও মনে হচ্ছে যে আমাদের অঞ্চলের পাঠশালার বেশিরভাগ শিক্ষকদের মাঝেই ঘুরপাক খায়, ছাত্রগুলো পরবাসী হবে, ছাত্রীগুলোর একটু বয়স্ক প্রবাসীর সাথে বিয়ে হয়ে যাবে, বরং দিন যাবে টিউশনি হবে কোচিং হবে মাস ফুরবে, কিছু ছাত্রছাত্রী ভালো রেজাল্ট করবে এটুকুই। এসব প্রতিষ্ঠানের স্টুডেন্টরা দেশের নেতৃত্ব দেবে চিকিৎসা সেবা দেবে, বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ করবে, ব্যবসার নেতৃত্ব দেবে, কর্মসংস্থান তৈরি করবে সেভাবে একটি স্টুডেন্টকে গড়ে তোলার মানসিকতা এই অঞ্চলের খুব কম সংখ্যক শিক্ষকের মাঝেই আছে।
আমরা কেবল ভেসে যাচ্ছি ভুলপথে। পথটি যে ভুল ছিল তা কেউ কেউ সাগরে চিরতরে ভেসে গেলে বুঝি আবার কেউ কেউ ভেসে গিয়ে পার পেয়ে আর্থিক উন্নতি ঘটায় ফলে আর বুঝতেই পারি না।
আমরা ডুবে যাচ্ছি নদীভাঙনে, ডুবে যাচ্ছি ভূমধ্যসাগরে, ডুবে যাচ্ছি ঢাকা থেকে ফেরার পথে। আমাদের শরীয়তপুরের মানুষের কাছের কিংবা দূরের খুব চেনা কিংবা অল্পচেনা কেউ না কেউ প্রতিনিয়ত এভাবেই ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে অন্য কোথাও।
যে জীবন পরবাসী, ভেসে যায় সাগরে তারা বেঁচে থাকুক, তাদের মানসিক উন্নতি হোক, তারা জ্ঞানার্জনে উদ্বুদ্ধ হোক, স্বপ্ন দেখুক বৃহদাকারে, সুন্দর সমৃদ্ধিশালী জনপদ গড়তে হোক নিবেদিত প্রাণ। এই যেমন প্রত্যাশা ঠিক তেমনি সবাই যারা যার স্থান চেষ্টা করুন, চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিদিন, ডুবে যাওয়া দিন, শেষ হবে একদিন।