মম মজুমদার, কোলকাতা, ভারত থেকে:
জিগীষা এবং চাঁদপুর উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট মনিরা আক্তারের আমন্ত্রণে সম্প্রতি আমার সুযোগ হয়েছিল পৃথিবীর একমাত্র বাংলা ভাষার রাষ্ট্র (যা আমার মাতৃভাষা) বাংলাদেশ ভ্রমণের। আমার চোখে সব থেকে মনোরম জায়গা মেঘনা, পদ্মা, ডাকাতিয়া সঙ্গমস্থলে অবস্থিত চাঁদপুর যা পৃথিবীর ইলিশ বাড়ি নামে পরিচিত।
ব্রিটিশ শাসনকালে বার্মা যাওয়ার একমাত্র বাণিজ্যিক পথ আজও ঘনবসতিপূর্ণ। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। পরিবহন এর প্রধান মাধ্যম জলপথ। স্থলপথেও চাঁদপুর যাওয়া যায়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল জল ও স্থল উভয় পথে ঢাকা থেকে চাঁদপুর ভ্রমণ করার।
লঞ্চ যখন সুবিশাল জলরাশির মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিল বহুদূরে দুইপারের সৌন্দর্য অসাধারণ। সঙ্গে সূর্যের আলোর খেলা চলেছে অতলান্ত জলরাশির সাথে। তার অপরূপ শোভা দেখতে দেখতে মাত্র তিন ঘণ্টায় চাঁদপুর পৌঁছে যাই।
শহরের প্রবেশদ্বারে বিশাল ইলিশ স্বাগত জানায় সকলকে। প্রায় ১০০বছর আগে ডাকাতিয়া নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল ইলিশ মাছের হাট। যা আজ চাঁদপুর ইলিশ মাছ ঘাট নামে পরিচিত।
মেঘনার জলের ইলিশের স্বাদ অতুলনীয়। আগে প্রতি মণ মাত্র ৫ টাকায় আশিটি করে ইলিশ মাছ কেনা যেতো। এখন তার দাম ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এখানকার মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা দিনরাত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য।
বছরে দুটি সময় নদী থেকে সব ধরণের মাছ ধরা বন্ধ থাকে, যাতে মৎস্য উৎপাদন ব্যাহত না হয়। অনেক কাহিনী কে বুকে নিয়ে চাঁদপুরে মেঘনা, ডাকাতিয়া, পদ্মা বয়ে চলেছে। এখানকার সঙ্গমস্থলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক কাহিনীর সাক্ষ্য প্রতিটি বালুকণা বহন করে চলেছে।
এখানকার অন্যতম আকর্ষণ কেন্দ্র ‘রক্তধারা’ যা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতো। স্বাধীনতায় অংশগ্রহণকারী নারী-পুরুষ-শিশুদের নৃশংসভাবে অত্যাচার করে খরস্রোতা নদীতে ভাসিয়ে দিত। একাত্তরের সেই দুঃসহ স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে আজও এখানকার বালুকণাগুলি।
পাকিস্তানিদের সাহায্য করেছিল রাজাকার আল বদর, আলসামসরা। এই স্থানকে মল হেড বলা হয়, কেননা তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলে প্রচন্ড জলের ঘূর্ণিতে ছোট্ট শহরটি যেন ভেঙে না যায়। তার জন্য গার্ডার দিয়ে ঘেরা ত্রিকোণাকৃতি অঞ্চলটি সবুজ ঘেরা। বিস্তীর্ণ বালুকাময় জলরাশির নৈসর্গিক দৃশ্য অপরূপ।
ব্রিটিশ এবং অন্যান্য জাতি বাণিজ্যের কারণে দীর্ঘদিন এখানে বসবাস করার ফলে সভ্যতা রীতিনীতি প্রভার এখনকার জনসাধারণের মধ্যে অনেক অংশে দেখা যায়। যে কারণে পাশ্চাত্য শিক্ষার উদারনীতি এখানকার মানুষ কে হিন্দু-মুসলিম খ্রিস্টান একত্রে শান্তিতে বসবাস করতে পারছে। বহু পুরনো মন্দির, মসজিদ, গির্জা এর সাক্ষী বহন করে।
একদিকে যেমন চলছে হরি-কীর্তন, অপরদিকে চলছে আজান। এখানকার হিন্দুদের দেবীর মন্দিরে মুসলিম সম্প্রদায় যায় এবং প্রসাদ গ্রহণ করে যা পশ্চিমবাংলার কিছু মানুষ গড়ার কারিগর মুসলিম ভাই-বোনদের কাছে আশাই করা যায় না। এখনো এখানে হিন্দু দেবদেবীর নামে রাস্তা আছে যেমন কালীবাড়ি, ঘোষপাড়া, হরিসভা ইত্যাদি।
মেঘনা নদীর পাড়ে দীর্ঘ দিনের পুরনো গাছ তলায় ইলেকট্রিক চুল্লি, যা হিন্দুদের অন্তিম যাত্রার সময় বিশেষ ভাবে কাজ করে থাকে। এছাড়াও রয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন। যা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ এই আদর্শকে মানব সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের মেলবন্ধন তৈরীর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এবার একটু মেলার অভিজ্ঞতার কথা জানাবো। চাঁদপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মাঠে উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত এই মেলা। নারী উদ্যোক্তারা অংশগ্রহণ করে যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাতে তৈরি জিনিস নিয়ে এসেছে মহিলাদের স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যে। এবং সেই জিনিস তুলে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের হাতে। এই ঘটনা একদিকে যেমন মহিলাদের স্বনির্ভর করতে পারে, অপরদিকে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ দেখাচ্ছে। লেখক, গবেষকরা পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়নের জন্য কর্মরত আছেন। যেমন- মনিরা আক্তার, পাপড়ি বর্মন, খুকি চৌধুরী, জেসমিন আক্তার, নাজমা আলম সহ একঝাঁক নারী উদ্যোগীকে সাফল্যের পথ দেখিয়েছেন তারা। সাফল্যের আলো দেখাতে সাহায্য করেছে এখানকার স্থানীয় প্রশাসন।
ছোট্ট সুন্দর দূষণমুক্ত শহর চাঁদপুর দর্শন করলে ভ্রমণপিপাসুদের জীবন সার্থক হবে। কাব্যের ভাষায় বলতে হয়-
আমি গঙ্গার অপর নিয়েছি জনম
দেখলাম পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ারে
আমার জনম হইল পূর্ণ!
আবার আসিব ফিরে তোমাদেরই এই সঙ্গম স্থলে!