আহসান হাবিব:
সুপরিসর কক্ষে ঢুকেই চোখে পড়লো বৃত্তাকার কাঠের মেঝে। পরিধি বরাবর একাধিক সারিতে চেয়ারের আসন পাতা। নিচতলার একদিকে সঙ্গীত ও যন্ত্রশিল্পীদের বসার স্থান। কামরার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে নিঃশব্দতা, সঙ্গে রয়েছে আলোকস্বল্পতা। আর এ-দু’য়ে মিলে সৃষ্টি করেছে এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ।
তুরস্কের কোনিয়া শহরে অবস্থিত প্যানোরমা যাদুঘর, যেখানে ত্রয়োদশ শতাব্দীর কোনিয়ার সামাজিক জীবন এবং মওলানা জালাল উদ্দিন রুমির জীবনী প্যানোরমিক চিত্র ও ভাস্কর্যের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। এই যাদুঘরের একটি হলে প্রদর্শিত হয় সুফি নৃত্য। কোভিড-১৯ এর কারণে সাময়িক বন্ধ থাকলেও আমাদের জন্য মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ সংক্ষিপ্ত আকারে প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
প্যানোরমা যাদুঘর পরিদর্শন শেষে সুফি নৃত্য প্রদর্শনী হলে আমরা আসন নিলাম। কিছুক্ষণ পর সঙ্গীতশিল্পীগণ এসে নির্ধারিত আসনে বসলেন। তারপর একে একে কালো আলখাল্লা পরিহিত ছয়জন দরবেশ কক্ষে এসে গোলাকৃতি মেঝের উঠোনে প্রবেশ করলেন। দলনেতা প্রৌঢ়ত্বের কোঠায়, শিষ্যগণ তারুণ্যের ছোঁয়ায়। শান্ত, সৌম্য, অচঞ্চল। অবনত দৃষ্টি। উট-রঙা কুলফি-মালাই আকৃতির উঁচু টুপিতে মাথা ঢাকা। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন সামনে, যেখানে আগে থেকেই মেঝেতে পাতা ছোট কার্পেট।
গুরুশিষ্য প্রথমে দর্শকদের উদ্দেশ্যে মাথা নুইয়ে বাও করলেন। মহান স্রষ্টার প্রতি সিজদার ঢঙে মেঝেতে মাথা ছুঁইয়ে অতঃপর বসলেন অবিচল ভঙ্গিতে। ভেসে এলো একজন সঙ্গীতশিল্পীর বাদ্যযন্ত্রহীন সুরেলা কণ্ঠ যেন মহান সৃষ্টিকর্তার বিশালতার কাছে আত্মনিবেদন। সে-কণ্ঠ থামতেই বেজে উঠলো বাঁশির মোহনীয় সুর। তখনও নিশ্চল বসে আছেন ধ্যানমগ্ন গুরুশিষ্যগণ। তারপর বাঁশির সুরে সুর মিলিয়ে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে সমবেতকণ্ঠের সঙ্গীত যখন ধ্বনিত হলো, হঠাৎই যেন সবার শরীরে প্রাণ সঞ্চারিত হলো। একসঙ্গে মেঝেতে দু’হাতে চাটি মেরে চৌকিতে সিজদার পর উঠে দাঁড়ালেন।
আলখাল্লার কালো আবরণ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তুষারশুভ্র বস্ত্রে মোড়ানো পাঁচ দরবেশ। অহংবোধের কালো আবরণ ভেদ করে যেন জন্ম হলো পাপস্পর্শহীন নতুন প্রাণের। এবার শুধু ¯্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়ার নিরন্তর প্রয়াস। গুরু রইলেন অপরিবর্তিত বেশেই। ডানহাত ভাঁজ করে বাম কাঁধে আর বাঁহাত ডান কাঁধের ওপর রেখে অনেকটা আরবি আলিফ বর্ণের আদলে এমনভাবে নিজেকে বাঁধলেন যেন শরীর আর আত্মা বাঁধা হলো একই সুতোর বাঁধনে। বিক্ষিপ্ত মনকে আটকানো হলো দেহের সঙ্গে।
এরপর সুর-মুর্ছনার সঙ্গে শিষ্যগণ ঘুরতে শুরু করলেন। একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে দাঁড়িয়ে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত অভিমুখে হাত দুটি প্রসারিত করে নিমীলিত চোখে যেন নির্দিষ্ট একটি কেন্দ্রের চারদিকে অবিরত ঘুরছে বিশ্বব্রহ্মা-ের নক্ষত্রম-ল। সফেদ বস্ত্রের নিচের অংশ তৈরি করেছে এক-একটি ঘূর্ণনবলয়। সুরমুর্ছনা আর শিষ্যগণের ঘুর্ণন একাকার হয়ে এমনই এক অপার্থিব পরিবেশের উন্মেষ ঘটিয়েছে, দেখলে মনে হয় সূর্যকে কেন্দ্র করে নক্ষত্রপুঞ্জ ঘুরছে মহাশূন্যে।
এটা হলো সুফি নৃত্যের ধারা। প্রসারিত দুই হাতের প্রলম্বিত অবস্থান সৃষ্টিকর্তার একাকীত্ব ঘোষণা করে। ডান হাত প্রসারিত হয় সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ অর্জন এবং বাঁ হাত প্রসারিত হয় স্বর্গের সঙ্গে পৃথিবীর যোগসূত্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে। বাম পা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে, ডান পায়ের সাহায্যে ঘুরতে থাকেন দরবেশগণ। এভাবে দুই হাত প্রসারিত করে ক্রমাগত ঘূর্ণনের ফলে তাঁরা আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা অর্জন করেন।
সুফি নৃত্যের ঘূর্ণায়মান আবর্তনের এই বিন্যাস মূলত পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহের নিজস্ব কক্ষপথে থেকে সূর্যকে আবর্তন করার নিয়ম অনুসরণ করে প্রণয়ন করা হয়েছে। আমাদের শরীরের বাঁ দিকে অবস্থিত হৃদপি-ের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দরবেশগণ কল্পিত গ্রহের কক্ষপথে ঘুরতে থাকেন এক মনোনিবেশে।
সাদা বিশুদ্ধতার প্রতীক। একারণেই হয়তো সুফি নৃত্যের জন্য সাদা পোশাক নির্বাচন করা হয়েছে। সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তা যেভাবে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে, তেমনইভাবে সাদা পোশাকের ঘূর্ণনদ্যুতি চারপাশ আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাই সুফি নৃত্যের পরিবেশ স্বর্গীয় আর পবিত্র হয়ে ওঠে। সুফি নৃত্যের নিগুঢ় কথা শরীর ও মনের সমর্পণ। ক্রমাগত ঘূর্ণনের মাধ্যমে বিক্ষিপ্ত মনের চিন্তাচেতনা এক বিন্দুতে থিতু হয়। ফলে শরীর ও মন চলে আসে নিয়ন্ত্রণে।
ত্রয়োদশ শতকে আনাতলিয়ার (বর্তমান তুরস্কের এশিয়া অংশ: এশিয়া মাইনর) কোনিয়া শহরের বিখ্যাত কবি, আইনজ্ঞ, ধর্মীয় নেতা মওলানা জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ রুমি ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের বালাখে জন্মগ্রহণ করেন। মানুষকে নীতিবোধে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মসনবী’, যা একটি শিক্ষামূলক নীতিবাক্যের সমাহার। চল্লিশ হাজার লাইনের মসনবীতে পঁচিশ হাজার শ্লোক সংকলিত হয়েছে। রুমি বিশ্বাস করতেন, সঙ্গীত, কবিতা এবং নৃত্য সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছানোর একেকটি পন্থা। তার এই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই কালক্রমে সুফি নৃত্য চর্চিত হতে থাকে।
১২৭৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর মাওলানা রুমি কোনিয়া শহরে মৃত্যুবরণ করেন। এই শহরেই রয়েছে তাঁর সমাধি। ৩০ সেপ্টেম্বর মাওলানা রুমির জন্মদিন। এ লেখাটি তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হলো।
লেখক: অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, এলজিইডি।