মো: আশরাফুল আলম মাসুদ
কাজাখস্তান এশিয়া মহাদেশের একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এটি আয়তনে বিশ্বের নবম বৃহত্তম দেশ এবং আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ভূমি পরিবেষ্টিত দেশ। এর উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে গণচীন, দক্ষিণে কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান এবং পশ্চিমে ক্যাস্পিয়ান সাগর ও রাশিয়া। কাজাখস্তান প্রায় সম্পূর্ণভাবে এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত। তবে দেশটির কিছু অংশ উরাল নদীর পশ্চিমে ইউরোপ মহাদেশে পড়েছে। দেশের উত্তর অংশে অবস্থিত আসতানা শহর দেশটির রাজধানী। বৃহত্তম শহর আলমাতি। ১৯৯৭ সালের আগে আলমাতিই ছিল কাজাখস্তানের রাজধানী।
সংস্কৃতি সৌধ সর্বদা বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে, এগুলো বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন। এই স্মৃতিসৌধগুলোতে একটি নির্দিষ্ট দুর্দান্ত ইতিহাস থাকে, যেটিতে এর প্রধান মানগুলো দেখায়। কাজাখস্তানও এর ব্যতিক্রম নয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৭ সালের ভ্রমণ এবং পর্যটন প্রতিযোগিতামূলক রিপোর্ট অনুযায়ী, কাজাখস্তানের জিডিপির ৩.০৮ বিলিয়ন ডলার বা সম্পূর্ণ জিডিপির ১.৬ শতাংশ আসে ভ্রমণ ও পর্যটনশিল্প থেকে। কাজাখস্তানের চমকপ্রদ পাহাড় পর্বত, হৃদ এবং মরুভূমির ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্য বিশ্বের যেকোন পর্যটকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। পরিবার কিংবা ব্যবসায়িক কাজে আপনিও দেশটিতে যেতে পারেন। তবে তার আগে দেশটি ভ্রমণে করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো জানা থাকলে আপনার ভ্রমণ হতে পারে অনেকটা ঝামেলামুক্ত এবং আরামদায়ক।
কাজাখস্তানের মানুষ, সংস্কৃতি এবং সমাজ:
কাজাখ একটি তুর্কি শব্দ। এর অর্থ বিস্ময়। কাজাখস্তানের অর্থ বিস্ময়ের ভূমি। খ্রিষ্টীয় পাঁচ শতকে তুরস্ক ও ইরান থেকে বহু মানুষ এ দেশে গিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। এ দেশের উপর দিয়েই এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য হতো বিখ্যাত ‘সিল্ক রোড’-এর মধ্য দিয়ে। ‘কাজাখ’ শব্দটি দ্বারা কাজাখকদেরই বোঝানো হয়েছে। তবে ক্রমবর্ধমানভাবে এটি অ-কাজাখবাসীদের বোঝাতেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
কাজাখস্তানের মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগ মুসলিম। বাকি ৩০ ভাগ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগ কাজাখ। ৩০ ভাগ রুশ। বাকি ১০ ভাগ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর। ৭০ ভাগ মুসলিম হওয়ায় মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব পালন করতে দেখা যায়। অন্যান্য ধর্মালম্বীরাও তাদের উৎসব পালন করে থাকে।
কাজাখস্তানের ভাষা:
কাজাখস্তান একটি দ্বিভাষিক রাষ্ট্র। দেশটিতে কাজাখ, রুশ উভয় ভাষাই প্রচলিত। তবে কাজাখ ‘অফিসিয়াল’ ভাষা হিসেবে ব্যবসায়িকভাবে বেশি ব্যবহার করা হয়।
পিতৃতান্ত্রিক এবং শ্রেণিবদ্ধ সমাজ:
কাজাখরা বিশ্বে একটি পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছে। তারা বর্ধিত পরিবারে একত্রিত হয়ে বসবাস করে। স্বামী পারিবারিক জীবনে প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে এবং পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব তাকেই নিতে হয়।
কাজাখস্তান একটি অত্যন্ত শ্রেণীবদ্ধ সমাজ। পারিবারিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিন্যাসে প্রত্যেকেরই একটি স্বতন্ত্র স্থান রয়েছে। বয়স এবং অবস্থানের কারণে মানুষ সম্মানিত হয়। বয়স্ক ব্যক্তিদের জ্ঞানী হিসাবে দেখা হয় এবং তাদের সম্মান দেয়া হয়। কাজাখদের বিশ্বাস, সমাজে বা পরিবারে প্রবীণ বা সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তি এমন সিদ্ধান্ত নেবেন যা গোষ্ঠীর সর্বোত্তম স্বার্থে হয়ে থাকে।
সাক্ষাতকারের সময়:
কাজাখস্তানে কারো সাথে দেখা হলে অভিবাদন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। সাধারণত অভিবাদন উভয় হাতে হ্যান্ডশেক এবং হাসি দিয়ে করা হয়। কাজাখ মুসলিমপুরুষরা নারীদের সাথে করমর্দন করে না। ধর্মীয় পার্থক্যের প্রতি আপনাকে সংবেদনশীল হতে হবে। কাজাখস্তানের কারো সাথে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠলে একই লিঙ্গের হলে হ্যান্ডশেক করার পরিবর্তে আলিঙ্গন করতে পছন্দ করতে পারে।
উপহার দেয়া–নেয়া:
কাজাখস্তানে উপহার দেয়া খুব প্রচলিত নয়। যখন কারও বাড়িতে রাতের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন হোস্টেসের জন্য পেস্ট্রির মতো কিছু নিয়ে আসা সাধারণ ভদ্রতা বুঝায়। মুসলিমরা অ্যালকোহল পান করে না, তাই আপনি আপনার হোস্টকে অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় উপহার হিসেবে দেবেন না। প্রাপ্তির সময় উপহারগুলো সাধারণত খোলা হয়।
খাবারের নিয়মাবলী
কাজাখরা খুবই অতিথিপরায়ণ এবং তাদের বাড়িতে নৈশভোজের আয়োজন উপভোগ করে। কোথাও আমন্ত্রিত হলে আপনাকে চা এবং রুটি পরিবেশন করা হবে। কাজাখরা রুটিকে পবিত্র বলে মনে করে, রুটি পরিবেশন করা সেখানে সম্মানের বিষয় বলে মনে করা হয়। চা পরিবেশন করা হলে আপনার কাপ প্রায়ই অর্ধেক ভরা হয়। কাপটি পূরণ করার অর্থ হল আপনার হোস্ট চান যে আপনি চা পান করেই চলে যান। সময়মতো পৌঁছানো জরুরি নয়, তবে ৩০ মিনিটের বেশি দেরিতে পৌঁছানো উচিত নয়। আপনি অফিসে পরতে পারেন এমন পোশাক রক্ষণশীলভাবে পরুন। টেবিল শিষ্টাচার কাজাখস্তানে খুব একটা মানা হয় না। টেবিল আচার-ব্যবহার কন্টিনেন্টাল খাওয়ার সময় কাঁটা বাম হাতে এবং ছুরি ডান হাতে রাখা হয়। কিছু খাবার হাত দিয়ে খেতে হয়। আপনার হোস্ট বা অন্য অতিথি আপনাকে পরিবেশন করতে পারে। গ্রামীণ এলাকায় হলে আপনি মেঝেতে বসেও খেতে পারবেন। খাওয়া শেষ হলে প্লেটে কিছু রেখে দিন। এটি প্রমাণ করে যে আপনি যথেষ্ট পরিমাণে খেয়েছেন। আপনি যদি প্লেটের সবকিছু শেষ করেন তবে তারা মনে করতে পারে যে আপনি এখনও ক্ষুধার্ত এবং আপনাকে আরও খাবার পরিবেশন প্রয়োজন।
মিটিং এবং অভিবাদন:
হ্যান্ডশেক হল সাধারণ অভিবাদন রীতি। এসময় দুই হাত ব্যবহার করা হয়। অনেক কাজাখ পুরুষ মহিলাদের সাথে হাত মেলায় না। তবে কোনো কাজাখ মহিলা তার হাত প্রসারিত করলে তা যদি গ্রহণ না করা হয় তবে তাকে অপমান করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। শুভেচ্ছার সময় আই কন্টাক্ট (চোখের যোগাযোগ) ঠিক রাখুন। মিটিংয়ের শেষে বিদায় নেয়ার সময় হ্যান্ডশেক করুন। আপনি যদি একই দিনে একাধিকবার কারও সাথে দেখা করেন তবে আপনার প্রতিবার হ্যান্ডশেক করা উচিত। প্রত্যেকের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন। একাডেমিক এবং পেশাদার শব্দ ব্যবসায় ব্যবহার করা হয়। কারো নাম ব্যবহার করার আগে আমন্ত্রণ জানানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ব্যবাসয়িক কার্ড আদান-প্রদান করা হয়। আপনার ব্যবসায়িক কার্ডগুলোতে একদিকে রাশিয়ান এবং অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় মুদ্রিত করে রাখতে পারেন।
ব্যবসায়িক মিটিং:
ব্যবসায়িক ধরন অনুসারে মিটিংয়ের ধরন পরিবর্তিত হয়। ব্যবসায়িক মিটিংয়ে কাজাখরা একই পদমর্যাদার লোকদের সাথে দেখা করতে চাইবে। তাই, যেকোন মিটিংয়ের আগে দলের সকল সদস্যের জীবনী (ইরড়ং) ফরোয়ার্ড করা গুরুত্বপূর্ণ। টি-আকৃতির টেবিলগুলো প্রায়শই মিটিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয় যাতে উভয় পক্ষ একে অপরের বিপরীতে বসতে পারে। মিটিংয়ে একেবারে সামনে কাজাখ প্রধান বসবে এবং তার কর্মীরা পদমর্যাদার ক্রমানুসারে বসবে। আপনার দলকে একইভাবে নিজেদের বসার চেষ্টা করা উচিত। কিছু কোম্পানিতে, যোগাযোগের সুবিধার্থে একে অপরের পাশে সহকর্মীদের বসারও প্রবণতা রয়েছে। ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করার আগে সাধারণত অল্প কথা বলা হয়। সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সময়কে কাজে লাগান। পরিবারভিত্তিক মানুষ হিসেবে তারা নিশ্চিত হতে চায় যে আপনি বিশ্বস্ত, দয়ালু এবং নির্ভরযোগ্য। সভায় সবচেয়ে সিনিয়র কাজাখ আলোচনার সূচনা করেন এবং তার দলকে ক্রমানুসারে পরিচয় করিয়ে দেন।