আখি সীমা কাওসার, রোম, ইতালি প্রতিনিধি: বাংলায় প্রচলন কথা, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে, অর্থাৎ অনেক বাঙ্গালীদের স্বভাব জালিয়াতি ঘুষ-দুর্নীতি করা, সেটা সভ্য দেশে এসেও ভুলতে পারেনি। এখন তার খেসারত গুনে গুনে দিতে হচ্ছে। ইতালীয় নাগরিকত্ব অর্জনের সময় আবেদনপত্রে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগে কয়েক’শ বাংলাদেশির ইতালীয় নাগরিকত্ব বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
গত দুই বছরে আরো কয়েক’শ বাংলাদেশিদের ইতালীয় নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছে, যা আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা চলছে। কয়েকজনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
পরিস্থিতি বর্তমানে এমন হয়েছে যে, ইতালি প্রবাসী এক বাংলাদেশি ইতালির নাগরিকত্ব পান ২০১৮ সালে, নাগরিকত্ব পেয়েই তিনি সপরিবারে চলে যান ব্রিটেনে, কিছুটা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে এখানে। গত ছয় বছরে ইতালির পাসপোর্ট পাওয়ার সাথে সাথে লন্ডনে চলে যাওয়ার যে ঢল নেমেছে, তা চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে বাংলাদেশিদের মধ্যে। একটি কথা আছে, যে থালায় ভাত খেলাম সেই থালা ছিদ্র করা। ইতালি সরকারও কম যায় না, খোঁজ খবর নিতে শুরু করলো কেন লন্ডনে যাওয়ার এত ঢল? আর এত পাসপোর্ট কিভাবে পেল তারা? যেমন ভাবা তেমন কাজ। শুরু হতে সত্যিকারের তদন্ত। ধীরে ধীরে প্রশাসন জেনে গেল কিছুটা উল্টো পথে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন এসব প্রবাসীরা। বাংলাদেশ থেকে যেসব পুলিশ ভেরিফিকেশন আনা হয়েছে সেখানেও ভুয়া কাগজপত্র ছিল। ঘুষ দিয়ে পাসপোর্ট বের করেছে কয়েক হাজার বাংলাদেশি। শুধুমাত্র বাংলাদেশিরা নয়, তদন্তে উঠে এসেছে অন্যান্য দেশের নাগরিকরা অসৎ পন্থা অবলম্বন করেছে। যেমন বাংলাদেশে সপরিবারে থেকেও, ছেলে মেয়ে স্কুল ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে তারপরেও এখানে এসে উকিল ধরে, ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে নাগরিকত্ব বের করেছে। এমন তথ্যও আছে প্রশাসনের কাছে।
চলতি বছর এপ্রিলে ব্যক্তিগত কাজে এক ফ্যামিলি ইতালি আসে, ফেরার সময় তার পাসপোর্ট আটকে দেয় ইতালি ইমিগ্রেশন। কারণ তিনি নাগরিকত্ব আবেদনের সময় প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঘুষ দিয়ে তার নাগরিকত্ব আবেদন করে সফল হন। ইতালিয়ানদেরকে ঘুষ দিয়ে প্রতারণা করে কাজ করা যায় এই বিদ্যাটুকু দিয়েছে মেধাবী বাংলাদেশিরা। এখন বিপদ হচ্ছে তার পুরো পরিবার ব্রিটেনে আর তিনি আটকা পড়েছেন ইতালিতে। তিনি ২০১৬ সালের এপ্রিলে তার নাগরিকত্বের আবেদন করেছিলেন।
এমন সংকটের ঝুঁকিতে রয়েছেন অন্তত ২ হাজারেরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি। এর মধ্যে অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ বাংলাদেশি আছেন যারা ব্রিটেনে আসা ইতালীয় প্রবাসী। ইতালির রাজধানী রোমের পাবলিক প্রসিকিউটর অফিসের ২০২০ সালের ২০ জুলাই জারি করা একটি চিঠির কপি কয়েকটি মিডিয়ার হাতে এসেছে বলে জানা গেছে।
ঐ চিঠিতে ১০ জনের একটি জালিয়াত চক্রের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। এদের মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা ও বাইরের দালাল রয়েছে। চিঠিতে ৪৮৬টি পাসপোর্ট আবেদনের রেফারেন্স নম্বরের উল্লেখ আছে। এ রকম আরও বেশ কিছু চিঠি ইতালির বিভিন্ন শহর থেকে ইস্যু করা হয়েছে। সে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ৪৮৬টি আবেদনের রেফারেন্স নম্বর দেওয়া আছে। এ ৪৮৬ পাসপোর্ট আবেদনের তদন্ত হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত। মূলত কোভিডের আগে এ নাগরিকত্ব বাতিলের চিঠি দেওয়া হলেও নতুন করে আবারও গত দুই মাস থেকে এ চিঠি দেওয়া হচ্ছে।
ব্রিটেন প্রবাসী ইতালি থেকে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের কয়েকজন ২০২০/২০২১ সালে এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। তাদেরকে ইতালি এয়ারপোর্টে নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছ। এবং তাদেরকেও বলে দিয়েছে দশ বছর ইতালি থেকে আবার নতুন পাসপোর্ট এর জন্য আবেদন করতে।
একটি কথা বাংলাদেশিদের বুঝতে হবে, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন সেখানকার আইন, নিয়ম-কানুন যদি মানা হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো সমস্যা হবার কথা না। শুধু কেবল নাগরিকত্ব নয় সাধারণ একটি পাসপোর্ট করতেও বাংলাদেশিরা সব সময় ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে। কিছু টাকার বিনিময়ে সাথে সাথে পার পেয়ে গেলেও পরবর্তীতে তা কিন্তু আবার ধরা পড়ে প্রশাসনের হাতে। ফলে তাদেরকে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। তাই অভিজ্ঞজনরা মনে করেন, বাংলাদেশি কমিউনিটির যেমন বদনাম হয় তেমনি এ ধরনের কার্যক্রমে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হয়। কাজেই কেউ যেন দুই নাম্বারি পন্থায় কোন কাগজপত্রে ভুয়া তথ্য ব্যবহার না করে সেদিকে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে তথা ইতালি দূতাবাসকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। দূতাবাস থেকে বারবার যদি কাউন্সেলিং করা হয় এবং মাঝে মধ্যে বাংলাদেশি কমিউনিটি নিয়ে বসা হয়, ব্রিফিং দেয়া হয় তাহলে হয়তোবা কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ দুর্নাম থেকেও মুক্তি পাবে। আর যারা জাল ডকুমেন্ট দিয়ে বিভিন্ন কাগজপত্র টাকা দিয়ে তৈরি করে তারাও বড় রকম বিপদের হাত থেকে মুক্তি পাবে।
রোমে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে, যারা বাংলাদেশি প্রবাসীদের সমস্যা নিয়ে কাজ করে, তারা ধারণা করছেন আগামীতে আরো দুই থেকে আড়াই হাজার ব্যক্তির নাগরিকত্ব বাতিল হতে পারে। এর মধ্যে ইতালির প্রশাসনের নজরে অন্যান্য দেশের নাগরিকসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি আছেন। বিশ্বস্ত একটি সূত্র থেকে জানা গেছে যে, ইতালি থেকে ব্রিটেনে আসা অনেক বাংলাদেশি ইতালি দূতাবাসে নিবন্ধন করেননি। মানে ইতালির সরকারের হিসাবে তারা ইতালিতেই আছেন। তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরইমধ্যে যারা এখনো ইতালি ত্যাগের বিষয়ে ইতালি সরকারকে কিছু জানায় নি, তারা কিন্তু বড় রকম বিপদের মুখোমুখি হবে। তাদের অনেককেই ইতালির সরকার তাদের ইতালির ঠিকানায় চিঠি দিয়েছে।
সে চিঠির খবরই এখনও জানেনি অনেকেই। এখন ইতালিতে যাওয়ার পর তাদের পাসপোর্ট আটকে রাখা হচ্ছে। এখন যাদের পাসপোর্ট ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের আবারও সেই ১০ বছর বৈধভাবে ইতালিতে থেকে তারপর নতুন করে নাগরিকত্বের আবেদন করতে হবে।
এখন উচিত যারা এ ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তাদের যৌথভাবে অভিজ্ঞ একজন ইমিগ্রেশন আইনজীবী নিয়োগ করা, যিনি ইতালির আইন বোঝেন। তানাহলে সামনে তাদেরকে আরও কঠিন বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।