সিকদার গিয়াসউদ্দিন, লাসভেগাস, যুক্তরাষ্ট্র
বুধবার, ৪ জুলাই, ২০১৮ আমেরিকার মহান স্বাধীনতা দিবস। চতুর্দিকে আতশবাজি, আনন্দ ও উৎসবের অন্ত ছিলোনা। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তারই মাঝে সভা-সমিতিতে, সেমিনারে এককথায় সর্বত্র ধর্ম, বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের জাতীয় ও স্থানীয় বীরনায়কদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়। বিনম্রশ্রদ্ধা জ্ঞাপনের শেষ নেই। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতীয় ও স্থানীয় লাইব্রেরিগুলোতে স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে অসংখ্য বইপত্র ও লেখালেখি’র বিষয়টি সকলেই জানার কথা। এমনকি আমেরিকায় সকল বৈধ প্রক্রিয়া সমাপনের পর যখন কেউ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে-তাকে আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনসহ ইতিহাস বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয়। নাগরিকত্বের জন্য যা অত্যাবশ্যকীয়। দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শর্তের এই বিষয়টি অবশ্যই অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য।
আমেরিকার ও অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত জাতীয় ও স্থানীয় নায়কগণ ব্যক্তিগত, আদর্শগত বা চিন্তাচেতনার বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে মতবিরোধের কারণে ভিন্ন দল বা থিংকট্যাংক গঠন করেও সবসময় স্মরণীয় বরণীয় হয়ে আসছেন। স্বাধীনতা আন্দোলন ও অর্জনের সাথে সম্পৃক্ত নায়কদের ইতিহাস নিয়ে অপরাজনীতির ও বিরোধের বিষয়টি কখনও লক্ষণীয় নয়। ইতিহাসের নায়কদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক চরিত্র হননের বিষয়টি বিশ্বের প্রতিটি দেশে দস্তুরমতো নৈতিক স্খলন ও অপরাধের সামিল। স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রতিটি দেশ ঔপনিবেশিক ও জনস্বার্থ বিরোধী কালাকানুন বাতিল করে নিজেদের জনগণের সামগ্রিক অধিকারের কথা বিবেচনা করে নিজেদের দেশের উপযোগী করে আইন কানুন নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছে। এমন কোন আইনের অস্তিত্ব নেই- যাতে করে নিজেদের দেশের শাসক সম্প্রদায় জনস্বার্থবিরোধী কালাকানুন দিয়ে জনগণকে এক ধরণের পরাধীনতার বন্ধনে বা ভয়ভীতির মধ্য দিয়ে পরিচালনা করার পাঁয়তারা করতে পারে।
“যখনই কোন সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার, জীবন, স্বাধীনতা ও সুখান্বেষা ধ্বংস করতে লিপ্ত হবে- তখনই সে সরকার বদলানোর বা উৎখাত করার অধিকার জনগণের হাতে থাকবে। অধিকার থাকবে নিজেদের নিরাপত্তা ও সুখের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নীতিমালার ভিত্তিতে এবং রূপরেখা অনুযায়ী ক্ষমতার বিন্যাস ঘটিয়ে নতুন সরকার গঠনের। “আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণায় বর্ণিত এই গণতান্ত্রিক নীতিটি জনগণের স্বার্বভৌমত্বের ফলিত প্রকাশ।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসের চালচিত্র স্বাধীনতা অর্জনকারী অন্যান্য দেশসমূহের সাথে জনতার আদালতে যে বিরাট ব্যবধান বা ফাঁরাক দেখা যায়-তা আদৌ কি অস্বীকার করা যেতে পারে? একথা কারো অস্বীকার করার জো নেই যে, ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘বাংলাদেশ’ শব্দদ্বয় সমার্থক। তবে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ‘বঙ্গবন্ধু’ ও বাংলাদেশ কি রাতারাতি আসমান জমিন থেকে নাজিল হয়েছিলো? বাংলাদেশের স্বাধীনতা কি কেবলমাত্র ১৯৭১’ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত? তার আগে বা পরে কি কোন ঘটনাই ঘটেনি? গোপন ও প্রকাশ্য কোন ঘটনা কি নেই? একজন মহানায়ক তৈরীতে অন্যান্য নায়কদের ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ীভাবে লেখার কিংবা ইতিহাসের সকল ঘটনা এবং সকল ঘটনার সূতিকাগারের কথা কাগজে কলমে বা অনেকের লেখায় দেখা গেলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়টি কোথাও জানার অবকাশ আছে কি? ১৯৭২ ‘সালের ১০ জানুয়ারির পর থেকে যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিলো বা এসেছে, দলীয় রাজনীতির বাইরে এসে দেশের সকল সঠিক সত্যতথ্য সম্বলিত ইতিহাস কি রচিত হয়েছে? ইতিহাসের সকল নায়কদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতীয় আর স্থানীয়ভাবে তুলে ধরার কোন প্রয়াস কি আদৌ পরিলক্ষিত হয়েছে? ‘জয় বাংলা’ স্লোগান, বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদানের পুরো কাহিনী, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের আগে পতাকা তৈরীর সঠিক ইতিবৃত্ত, জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ, পতাকা উত্তোলন প্রক্রিয়া, ইশতেহার পাঠদিবসের বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন সিদ্ধান্ত বা জানানোর প্রক্রিয়া না নেয়ার পেছনে কোন কারণ আছে কি? স্বাধীনতা অর্জনের পর এতো দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এখনো ১৯৭১’সাল পরবর্তী প্রজন্ম এসব বিষয়ে অবহিত নয় কেনো?
শুধু তাই নয়, ১৯৭৫’ সালের বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর থেকেই যেভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন ও জনযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে ইতিহাসে তার নজীর দুনিয়ার আর কোন দেশে আছে কি? এককথায় নজীরবিহীন। ১৯৭১’সাল পূর্ববর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সমগ্র দেশে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭০’সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়ের কথা বাদই দিলাম। তাছাড়াও ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময়কালীন বঙ্গবন্ধু ও চার খলিফা খ্যাত ছাত্র নেতারা ছাড়া (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরাসরি নির্বাচনে নির্বাচিত সহ সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন, ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজকে জনগণ চার খলিফার অভিধায় অভিষিক্ত করেছিলো। পদাধিকারবলে আবু সাঈদ চৌধুরী ভাইস চ্যান্সেলর ও ডাকসু সভাপতি ছিলেন) ক’জনইবা তখন অন্যান্য নেতাদের কথা বলতো বা জানতো? ১৯৭১’ সাল পরবর্তী প্রজন্ম সত্যিকারভাবে দেশের সঠিক ইতিহাস আদৌ কি ধারণ করতে পেরেছে? তারা কি কনফিউজড নয়?
যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সহ জেল হত্যাকান্ডের শিকার চার জাতীয় নেতার বিষয়ে খুবই সাধারণভাবে জানা গেলেও সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, কাজী আরেফ ও চার খলিফার কর্মকান্ডের ইতিহাস নিয়ে জনগণকে জানানোর কোন সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ আদৌ আছে কি? ৩০ লক্ষ শহীদদের রক্ত, লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও জনযুদ্ধের স্থানীয় নায়কদের নাম চিরস্থায়ী করে রাখার জন্য সারাদেশ ও গ্রামাঞ্চলে স্থায়ী কোন ব্যবস্থা নেয়ার প্রসঙ্গটি এখনো আলোচিত সমালোচিত কেনো? বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে গণযোদ্ধারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেও এটি জনযুদ্ধ ছিলো কিনা এসব বিষয়ে রাষ্ট্রীয় কোন নির্দেশনার বিষয়ে কারো কোন কিছু জানা আছে কি? টেলিভিশনের টক’শোতে মাঝে মধ্যে জনযুদ্ধ শব্দটি আলোচিত সমালোচিত হতে দেখা যায় কেনো?
হিমালয়ের চতুর্পার্শ্বের পর্বতরাজিগুলো বাদ দিলে এভারেষ্ট শৃঙ্গের স্থায়িত্ব বিধান আদৌ আশা করা যায় কি? তা জানার জন্য আওলিয়া হওয়ার প্রয়োজন আছে কি? এককথায় একটি দেশপ্রেমিক ও দুর্নীতিমুক্ত জাতিগঠনের জন্য দেশের জাতীয় ও স্থানীয়, গোপন ও প্রকাশ্য নায়ক ও বীরদের জানার বিষয়টি অত্যাবশ্যক নয় কি? মতপার্থক্য যতই থাকুক- অন্যান্য দেশের মতো জাতীয় স্বার্থে আমরা কেনো স্বাধীনতা আন্দোলন ও জনযুদ্ধের বীর ও নায়কদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক চরিত্র হননকে নৈতিক স্থলন ও অপরাধ মনে করি না?
আমাদের দেশে পরিবার ও সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে মুক্তির জন্য, দেশপ্রেমিক নাগরিক ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে ছোটবেলা থেকে দেশ ও জাতির সত্য ও অবিকৃত ইতিহাস জানিয়ে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার কোন ব্যবস্থা আদৌ কি রেখেছি? দেশের শিক্ষানীতি আদৌ কতটুকু গণমুখী? এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সকল মতপার্থক্য একপাশে রেখে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে ও দেশপ্রেমিক জাতি গঠনে দেশের গোপন ও প্রকাশ্য সকল সত্যিকারের ইতিহাসের দ্বারোন্মোচন করা প্রয়োজন। মহানায়ক থেকে শুরু করে সকল জাতীয় ও স্থানীয় নায়কদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ তাঁদের জীবন কাহিনী নতুন প্রজন্মদের জানানোর মধ্য দিয়ে একটি দেশপ্রেমিক প্রজন্ম তৈরী করে দুর্নীতিমুক্ত সমাজের এবং এভারেষ্ট শৃঙ্গের স্থায়িত্ব বিধানের ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি এ আশাবাদের বিকল্প নেই।