প্রবাস মেলা ডেস্ক: জীবনমুখী বাংলা গান লিখে সব শ্রেণী পেশার মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন দেশের বরেণ্য গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়জী। চলচ্চিত্র কিংবা অডিও এ্যালবামের গানে যার জাদুকরী স্পর্শ তাকে সঙ্গীতাঙ্গনে দেশজোড়াখ্যাতি এনে দিয়েছে। বিশেষ করে সব শ্রেণীর মানুষের অন্তরের বিরহ-বেদনাবিধুর গভীরতা ও অনুভূতিকে গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন। তার লেখা অসংখ্য গানের কথা শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে মানুষের মনে গেঁথে আছে। প্রেমে কিংবা বিচ্ছেদে যেসব গান আজও বাংলার শ্রোতাদর্শক মহলে অনায়াসে উচ্চারিত হয়। সোনা দানা দামি গহনা, দু’চোখ আমার শত্রু হলো, জীবন যদি বদল করা যেত, আমার মন্দ স্বভাব জেনেও তুমি, কষ্টে আছি জেনে যদি ভালো লাগে, দিন-রাত্রির হয়নারে মিলনসহ অসংখ্য গান তার লেখা। বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে ‘চন্দ্র সূর্য যত বড় আমার দুঃখ তার সমান’ গানটি আজও মানুষের মনকে বিষণ্ণ করে!
আলোচিত এই গানটির মতোই নন্দিত এই গীতিকারও যেন প্রবল দুঃখে আছেন! না, ব্যক্তিগত নয়, সময়ের আচরণে। শুধু দুঃখ নয়, বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখিও তিনি। গান লেখার চার দশকের ক্যারিয়ারে এই গীতিকারকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি আগে।
‘চন্দ্র সূর্য যতো বড় আমার দুঃখ তার সমান’ গানটি ১৯৯৮ সালের দিকে লিখেছিলেন ফরায়জী। গানটির সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন প্রয়াত শিল্পী বারী সিদ্দিকী। গানটি লেখার প্রায় দুই যুগ কেটে গেছে, অথচ এই সময়ে এসে একজন দাবি করে বসলেন- গানটি ফরায়জীর লেখা নয়! এমন দাবির প্রেক্ষিতে মর্মাহত এই গীতিকার।
গণমাধ্যমকে ফরায়জী জানালেন, সোশাল মিডিয়া ও ইউটিউব এর কল্যাণে এখন অনেক উঠতি শিল্পীরা গান কভার করেন। সেসব গানগুলোতে প্রায়শই দেখা যায় গীতিকার, সুরকারদের নামে নানা বিভ্রান্তি, ভুল তথ্য। ইউটিউবে দেখেছি, আমার লেখা ‘চন্দ্র সূর্য যত বড় আমার দুঃখ তার সমান’ গানটির অসংখ্য কভার। নতুন শিল্পীরা গানটির প্রতি ভালোবাসা থেকেই হয়তো কভার করেছেন। গানটির গীতিকার হিসেবে কেউ লিখেছেন বারী সিদ্দিকীর নাম, কেউ বা অন্যের নাম লিখেছেন। এটা হয়তো না জানা থেকে হয়েছে। কিন্তু আমার লেখা এই গানটিকে সরাসরি উকিল মুন্সির লেখা বলে মিডিয়ায় দাবি করেছেন তার নাতি!
নন্দিত এই গীতিকার বলেন, জনপ্রিয় সৃষ্টি নিয়ে কেউ যখন এমন দাবি করেন, তখন তার কাছে অকাট্য যুক্তি কিংবা ঠিকঠাক তথ্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যিনি এমন দাবি করে বিভিন্ন মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, তার কাছে কোনোরকম প্রমাণ নেই, যুক্তি নেই। আমার লেখা এই গান ইউটিউবে কেউ না জেনে গীতিকার হিসেবে উকিল মুন্সির নাম লিখেছে, সেটা দেখে তার নাতি এমন দাবি করছেন! হুট করে অযথাই এমন বিভ্রান্তি ছড়ানোর ফলে আমি সত্যিই বিব্রত বোধ করছি।
‘বেঁচে থাকতেই সৃষ্টি হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে’- এমন দাবি করে শহীদুল্লাহ ফরায়জী বলেন, ‘আমি বেঁচে থাকতেই আমার লেখা গান হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমার মৌলিক সৃষ্টি অন্য কারও বলে দাবি করছে। অথচ উকিল মুন্সির লেখার যে স্টাইল, তার সাথে আমার লেখা গানের কোনো মিল নেই। আমার গানের স্টাইল, বৈশিষ্ট্য- এগুলো কোনোভাবেই উনার লেখার সাথে মিলবে না। তাছাড়া উকিল মুন্সির গান নিয়ে বই আছে, তার লেখা নিয়ে প্রচুর নিবন্ধ পাওয়া যাবে- কোথাও তো ‘চন্দ্র সূর্য যত বড় আমার দুঃখ তার সমান’ এর কথা উল্লেখ নেই। তাহলে এমন দাবি কি তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে উঠলো?
গানটি নিয়ে ফরায়জী আরও বলেন, এই গানটি বারী সিদ্দিকী সুর করেছেন। তিনি গানটি নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন সেসময়। তার অ্যালবাম ‘দুঃখ রইলো মনে’তে ছিলো গানটি। সেই অ্যালবামটি সংগীতা থেকে প্রকাশিত হয়। ১২টির মতো গান ছিলো অ্যালবামে, সবগুলো গানই ছিলো আমার লেখা। এই অ্যালবামটির হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়েছিলো তখন। আমার লেখা ১২০টির মতো গান বারী ভাই সুর করেছিলেন।
আপনার লেখা গানগুলোর কপিরাইট হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে এই গীতিকারের সরলস্বীকারোক্তি,‘নিজের লেখা মৌলিক গানগুলো নিয়ে কেউ যদি প্রশ্ন করে, এটা এখন আমি কীভাবে প্রমাণ করবো! এটাতো কখনও ভাবিনি। বারী ভাই থাকতেই তার সন্তানরা বোধহয় কপিরাইট করিয়েছিলেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে কপিরাইট করিনি। ফর্ম পূরণ, স্টাম্প- অফিশিয়াল আরও নানান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়; এগুলো করার চেয়ে আরও একটা গান লিখে ফেলা আমার জন্য সহজ। এরকমটাই ভেবে আসছি।’
গুণী এই গীতিকার আরও বলেন, ‘নিজের গান সংরক্ষণের প্রয়োজন মনে করি নাই। এই যে মুঠোফোনে আমরা কথা বলছি, এটার আবিস্কারক কে- এটা না জেনেইতো সেটা ব্যবহার করছি, তাই না? ব্যবহারটাই হলো আসল। আমার লেখা গান মুহূর্তের জন্য হলেও শ্রোতাকে ছুঁয়ে যাবে, এটাই তো বেশি। শ্রোতাদের আমার নাম জানার দরকার নেই। কিন্তু একজনের সৃষ্টি আরেক জনের নামে বা ভুল যেন না জানানো হয়।’
সূত্র: চ্যানেল আই